রূপের রাজা শিলং

34f842fe-0130-4399-8635-99e2454a9ebf

মুহাম্মদ শামসুল হক শারেক

মহান আল্লাহ তায়লার অপার কুদরতের সৃষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মিরকে ভূস্বর্গ বলা হলেও, দাড়জিলিংকে বলা হয় রূপের রাণী। আর শিলংকে বলা হয় রূপের রাজা। এক সময়ের ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত শিলং এখন মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী পূর্ব খাসি পাহাড় এলাকার পরিচ্ছন্ন একটি শহর শিলং। শিলং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং ভূটান-ভারত সীমান্তের প্রায় ১০০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। এটি খাসি পাহাড়ে প্রায় ১৫০০ মিটার (৫০০৬ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। শিলংয়ে সারা বছর মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করে। তবে মার্চ ও জুন মাসে এখানে বেড়াতে যাওয়াই নাকি ভাল। গ্রীষ্মে হাল্কা উলের পোশাক ও শীতে ভারি গরম জামার ব্যবস্থা রাখতে হয়। মাথায় রাখতে হবে এ অঞ্চলে যখন তখনই বৃষ্টিপাত হতে পারে।
এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমানে পাইন অরণ্য, জলপ্রপাত এবং পার্বত্য জলধারার সমারোহ। বলতে গেলে গোটা শিলং শহর যেন পাইন অরণ্যে ঢাকা। এক সময় এটি ‘প্রাশ্চ্যের স্কটল্যান্ড’ নামে পরিচিত ছিল। এখনো এর সৌন্দর্য কমেনি।। ১৮৯৭ সালে এক ভূমিকম্পে শহরটি নাকি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর এটিকে পুনরায় একটি পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ভূমিকম্প প্রবণ বলেই এখানে তিন তলার উপরে বিল্ডিং খুবই কম। এর বেশী উচুঁ বিল্ডিং করতে সরকারের পার্মিশন ছাড়া হয় না।
ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ পরিবারদের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় পাহাড়ি রিসোর্ট ছিল। এখনও এখানে প্রচুর ব্রিটিশ ধাঁচে নির্মিত কান্ট্রিহাউজ দেখতে পাওয়া যায়। শিলং-এ আশে পাশের এলাকায় উৎপাদিত কমলা, তুলা, আলু ইত্যাদি কেনাবেচা হয়। এখানে মাইকা, জিপসাম এর মত মূল্যবান পাথর এবং প্রচুর কয়লার মজুদ থাকার সম্ভাবনার কথা জানাগেলেও এগুলি এখনও তেমন করে উত্তোলিত হয়নি। এখানে কোন বড় শিল্পকারখানা নেই বলে জানাগেছে। শিলংকে একটি একশত ভাগ পর্যটন সিটি বলা যায়।
জানাগেছে, ভারতের ২০০১ সালের আদম শুমারি অনুসারে শিলং শহরের জনসংখ্যা হল ১৩২,৮৭৬জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫০%, এবং নারী ৫০%। এখানে সাক্ষরতার হার ৮০%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮৩%, এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭৮%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%। কিন্তু তার চাইতে শিলং এর সাক্ষরতার হার বেশি। জনসংখ্যার ৯০ ভাগ খ্রিষ্টান। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খাসিয়া ও গারো সব মিলে ১০ ভাগ। b04493d1-7c2e-48ef-9e55-89e93c197719
খ্রিষ্টানদের এশিয়ার ২য় বৃহত্তম র্চালচ শিলং শহরেই অবস্থিত। আমরা ওই র্চালচের সামনে দাড়িয়ে ছবি তুললাম। ওখানে কথিত জিশুর ছবি ও লেখা দেখে বুঝতে পারলাম ওখানকার খ্রিষ্টানরা ‘ত্রিনিটি বা তৃত্ববাদে বিশ্বাসী’। তাদের ধর্ম বিশ্বসের প্রতি আঘাত না দিয়ে আমি বলতে পারি আল্লাহর উপর বিশ্বাসীরা তো তৃত্ববাদ বা বহুত্ববাদে বিশ্বাস করতে পারে না।
দেখলাম শিলং শহর ছাড়াও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন নয়। তবে সম্প্রতি আইএস মোকাবেলায় সারা ভারত জুড়ে সর্তকতার কারণে ৬হাজার ফুট উচুঁ পর্যটন ষ্পট শিলং পিক বন্ধ রেখেছে সরকার। দেখা গেছে রাত ৯টার মধ্যে শহরজুড়ে নিরবতা। আর সকাল ৯টার অগে দোকান পাট তেমন একটা খুলে না। রাত দিনে তাপ মাত্রার ব্যাপক তারতম্য। আমরা যেদিন গেলাম তাপমাত্রা দিনে ১৯-১৬ থাকলেও রাতে তা ৬ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে আসে। শেষ রাতে দেখাগেছে আবার পরিবর্তন।
পাইন গাছ এক ধরণের ফায়ার ওড হলেও এই পাইন গাছে ঢাকা যেন গোটা শিলং শহর। শহরে দেখা গেছে পাইন বাগান আর পাইন বাগান। অনেক বড় বড় পাইন গাছ গুলো যেন শিলং শহরের অতীতের সাক্ষি হয়ে আছে। শহরের বাইরেও দেখাগেছে মাইলের পর মাইল পাইন বাগান। জানাগেছে, পাইন গাছ গুলোই নাকি সেখানকার মাটি ও আবহাওয়ার সাথে এডযাষ্টেবল।
শিলং বা চেরাপুঞ্জিতে থাকা, খাওয়া এবং গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর খরচটা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কিছুটা বেশি বলে আগেই জেনেছিলাম। এছাড়া শিলংয়ের মতো শহরেও ডলার ভাঙানো সহজ নয় এবং টাকা ভাঙানো প্রায় অসম্ভব। তাই সিলেট থেকেই আমরা বাংলাদেশী টাকা পরিবর্তন করে রুপী করে নিয়েছিলাম।
সেই থেকে এ পর্যন্ত শিলং শহরেই ভারতের ইষ্টার্ণ কমান্ডের সদর দপ্তর অবস্থিত। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল আরোরার নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী এখান থেকেই সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সেভেন সিস্টার বা পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের ইস্টার্ণ কমান্ড এখনো শিলং-এ অবস্থিত। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের সময় এই জায়গা গুলো তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়নি। তিনশত বছর অগে থেকে ভারতের এই সাত রাজ্য ও বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে বৃটিশদের সুদূর প্রসারী কোন ষড়যন্ত্র ছিল না, একথা বলা যাবেনা। কিন্তু স্ট্রাটেজিক্যালী এই রাজ্য গুলোর একইঞ্চি জমিও ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয়নি।
ছোট বেলায় রেডিও শিলং থেকে বিখ্যাত গায়ক লতা মুঙ্গেসকর ও আশা ভুঁসলের গান শুনতাম। না দেখলেও সেই থেকে শিলং এর নামটা ছিল আমার কাছে পরিচিত। ভারতের চীফ মিনিস্টার মুকলের বাড়ি শিলং শহরেই। আমরা যে কয়দিন শিলং ছিলাম মিনিস্টার মুকুল ছিলেন তখন বাংলাদেশে। তাঁর বাড়ির গেইটে গিয়ে ছবি তুলতে চাইলে গাড়ি চালক না করলেন। তবে কোন পুলিশ দেখিনি সেখানে। কোথাও দেখা যায়নি কোন পরিচ্ছন্ন কর্মী। দেখাগেছে যেখানেই গেছি দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট ও আশপাশের এলাকা নিজেদের উদ্যোগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখছেন নিজেরাই।
শিলং শহরে আমরা যে কয়দিন ছিলাম দর্শনীয় স্থান গুলোতে ভালই ভ্রমণ হয়েছে। পুলিশ বাজার মূল ষ্টেশন থেকেই সব জায়গায় যোগাযেগের বাহন টেক্সী পাওয়া যায়। আমরা এলিফ্যান্ট ফল জলপ্রপাত, ওয়াডলেক, এশিয়ার ২য় বৃহত খ্রিষ্টান র্চালচ ও চিড়িয়া খানা ঘুরে দেখেছি। তবে চিড়িয়া খানার অবস্থা তেমন ভাল না। শিলং এর সর্বোচ্চ গিরি শৃঙ্গ শিলং পিক নিরাপত্তাজনিত কারণে কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখায় সেখানে যাওয়া হয়নি।
শিলং এর মানুষ সচেতন তা বুঝাগেল দৈনিক সংবাদপত্র গুলো দেখে। ইংরেজী, বাংলা ও গৌহাটি ভাষায় বেশ ক’টি দৈনিক কাগজ দেখাগেছে। সবকটি সংবাদ পত্রের কাটটি ভালই মনে হল। এর মধ্যে ইংরেজী দৈনিক ‘শিলং টাইমজ’ ও বাংলা ‘দৈনিক যুগসঙ্খ’এর প্রচার সংখ্যা ভাল মনে হল। শিলং টাইমজ এর পাঠক দেখাগেছে বেশী।
হোটেলে খাওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। খোঁজ নিয়ে মুসলিম হোটেল পাওয়া যায়। গাড়ি চালক ও আবাসিক হোটেল থেকে জানাযায় মুসলিম রেস্টুরেন্ট কোথায়। খাবারে গরুর গোস্ত আমার পছন্দের হলেও একটু ভয় ছিল শিলংও যেহেতু ভারতে, সেখানে গরুর গোস্ত চেয়ে কোন বিপদে পড়ি কিনা? ভারতে এসেই গরুর গোস্ত খাব-আমার সহযাত্রী ইলিয়াছের অনেকটা এরকম মনোভাবের কারণে হোটেলে গরুর গোস্ত দিয়ে আমরা আহর করি।
আবাসিক হোটেল গুলো তুলনামূলকভাবে আমাদের কক্সবাজারের মতই কষ্টলী। সেখানে হালাল খাবার পাওয়া য়ায়। সবচাইতে মজার কথা হলো শিলং এ গরুর গোস্ত পেতে কষ্ট হয়নি। জানতে পারলাম শিলং এ যেহেতু খ্রিষ্টানেরা সংখ্যাধিক্ষ্য, তারা গরুর গোস্ত খায়। তাই শিলং এ গরুর গোস্ত পাওয়া যায় সহজে। গোড়াঁমী সেখানেও আছে, কিছু কিছু আবাসিক হোটেলে সাইনবোর্ড সাঁটা আছে শুধুমাত্র ভিজেটেরিয়ানদের জন্য।
শিলং এ পর্যাপ্ত মসজিদ না থাকলেও কয়েকটি মসজিদ দেখা গেছে। এর মধ্যে শহরের ৪তলা মদিনা মসজিদটি খুব সুন্দর। প্রকাশ ঃ ২১.০২.২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ। মোবাইল ঃ ০১৮১৯-১৭০১৯০। ব সধরষ: ওহয়রষধন.পড়ী@মসধরষ.পড়স


শেয়ার করুন