হাহাকারে ভরা বিএনপির আরেকটি বছর

Sabbir447_1372067508_1-Sab-e-barat-sm20130624014656সিটিএন ডেস্ক:
বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দল প্রতিষ্ঠা করেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বেসামরিক করার উদ্দেশ্য ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন। জেনারেল জিয়া যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি রাষ্ট্রপতির পদের জন্য নির্বাচন করবেন তখন তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রীক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
বিএনপির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো।
বর্তমানে ক্ষমতা ও জাতীয় সংসদের বাইরে থেকে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আরেকটি বছর পার করতে যাচ্ছে একধিকবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম বড় এ রাজনৈতিক দল।
ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে থেকে জন্ম নেওয়া দলটি বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ড গড়েছে। বিষয়টি বিএনপির জন্য অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ‘অসম্ভবকে’ ‘সম্ভব’ করার ‘অলীক’ স্বপ্ন নিয়ে প্রচ- ‘দ্রোহে’ বছর শুরু করা বিএনপি অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বছর শেষ করছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
তারা বলছেন, কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ‘অপরিণামদর্শী’ কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চালানোর ঘোষণা দিয়ে কোনো অর্জন ছাড়াই মাঝপথে ঘরে ফিরেছেন খালেদা জিয়া।
অন্যদিকে বছরের শেষে- ‘সেই নির্বাচন কমিশন’ ‘সেই প্রধানমন্ত্রীর’ অধীনে নৌকার সঙ্গে ধানের শীষের লড়াই মেনে নিয়ে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন বিএনপি প্রধান।
তবে কেউ কেউ আবার বিষয়টিকে আত্মসমর্পণ হিসেবে না দেখে আত্মোপলব্ধি হিসেবে দেখছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে রাজনীতির মাঠে দর্শক বনে যাওয়া বিএনপি দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নের ভিত্তিতে পৌরসভা নির্বাচন অংশ নিয়ে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে বলে তাদের ধারণা। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি আবার মূলধারার রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেল-এমনটিই মনে করছেন তারা।

যেভাবে শুরুৃ
২০১৫ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখ। রাত সাড়ে ১০টা। নয়াপল্টন কার্যালয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব (দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) রুহুল কবির রিজভী।
জাতীয় জীবনে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটার কয়েকদিন পরে যিনি আড়মোড়া ভেঙে ওঠেন, সেই খালেদা জিয়াই অসুস্থ রিজভীকে দেখতে রাত পৌনে ১১টায় নয়াপল্টনের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে চাইলেন।
এদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন ঢাকায় বড় ধরনের গণসমাবেশের ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন বিএনপি প্রধান। সুতরাং হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া রিজভীকে দেখতে তার নয়াপল্টনে যাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হয়নি কোনো মহলেরই। গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়েই তাকে আটকে দেওয়া হলো।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই একটা খোলা পিক-আপ ভ্যানে ত্রিপল দিয়ে আটঁ-সাট করে বাঁধা লেপ-তোশক, বালিশ-জাজিম, বেডসিট, ম্যাট্রেস এসে হাজির। বুঝতে আর বাকি রইলো না, গুলশান অফিস বা অন্য কোথাও দীর্ঘ সময় অবস্থানের প্রস্তুতি নিয়েই বাসা থেকে বের হয়েছেন ‘আপসহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়া।
গুলশান কার্যালয়ে আটকে পড়া নেতাকর্মীদের নিয়ে ৫ জানুয়ারি ফের বের হতে চাইলেন ২০ দলীয় জোট নেত্রী। উদ্দেশ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন রাস্তায় নেমে সরকারকে প্রচ- এক ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়া।
কিন্তু হার্ডলাইনে থাকা সরকার এবারও তাকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে দিলো না। দলের কয়েকজন সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য গুলশান কার্যালয়ের গেট ভেঙে খালেদা জিয়াকে নিয়ে রাস্তায় নামার চেষ্টা করলেন। পুলিশের ছোড়া পিপার স্প্রে সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল।
গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে না পেরে ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে সেখানেই অবস্থান নিলেন। সাফ জানিয়ে দিলেন ‘জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি’ আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে, তিনিও অবস্থান করবেন গুলশান কার্যালয়ে।
শুরু হল অবরোধ কর্মসূচি, সঙ্গে নজিরবিহীন নাশকতা। এরই মধ্যে গুজব ছড়ানো হলো, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির চেয়ারম্যান ‍অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে ফোন করে সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
পরে জানা গেল, অমিত শাহ ফোনই দেননি। বিষয়টি নিয়ে ‘নির্জলা মিথ্যাচার’ করেছে বিএনপি। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
টানা অবরোধ কর্মসূচি ও নজিরবিহীন নাশকতার মধ্যে ২৪ জানুয়ারি খবর এলো খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
ছোট ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত খালেদা জিয়াকে সান্ত¡না দিতে ওইদিন সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়ে ছুটে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তাকে গেট থেকে ফেরত পাঠানো হলো।

২থ৫৪৫২২৪০১০সারাদেশে নজিরবিহীন নাশকতা ও ছেলে হারানোর শোকেও ‘আপসহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচি শিথিল বা প্রত্যাহার করলেন না। গুলশান কার্যালয়েই মৃত ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে চির বিদায় দিলেন।
এদিকে নাশকতা নির্ভর আন্দোলন যতো দীর্ঘায়িত হচ্ছে পেট্রোল বোমার শিকার হয়ে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও ততোই বাড়ছে। তবুও ক্ষান্ত দিলেন না খালেদা জিয়া। তার সাফ কথা ‘কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে’।
এরই মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় টানা হাজিরা না দেওয়ায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। চারদিকে গুঞ্জন ওঠে, যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হচ্ছেন বিএনপি প্রধান।
শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া গ্রেফতার না হলেও ৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে গ্রেফতার হন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২৬ জানুয়ারি বারিধারার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার হন রুহুল কবির রিজভী।
এছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুসহ বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হন। বাকিরা চলে যান আত্মগোপনে।
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ১০ মার্চ। ওই দিন উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। দুই মাস পর তাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই আটক অবস্থায় আছেন।
অবশেষে টানা অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখে গুলশান কার্যালয়ে ৯২ দিনের অবস্থানের ইতি টেনে ৫ এপ্রিল আদালতে হাজিরা দিতে যান খালেদা জিয়া। সেখান থেকে সোজা বাসায় ফেরেন তিনি।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও খালেদা জিয়া ঘরে ফেরার পর অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির অবসান ঘটে। স্বস্তি ফিরে আসে মানুষের মনে।
যেভাবে শেষৃ
গুলশান কার্যালয় থেকে ফিরে বাসায় যাওয়ার পর আর কোনো কর্মসূচির কথা বলেননি খালেদা জিয়া। বরং দল গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি।
গত ১০ আগস্ট দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানকে দিয়ে তৃণমূলে চিঠি পাঠান দল পুনর্গঠনের জন্য। সময় বেঁধে দেন ৩০ সেপ্টম্বর পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা ও পৌরসভায় কাউন্সিল করে জেলা সম্মেলনে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দল পুনর্গঠনের কাজেও খুব একটা এগোতে পারেনি বিএনপি।
এদিকে অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে বার বার তারিখ পিছিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত সফরে লন্ডন যান খালেদা জিয়া। সেখানে চোখ ও পায়ের চিকিৎসা করান তিনি। টানা দুই মাস অবস্থানকালে সেখানে পরিবারের সঙ্গে ঈদ-উল আজহা উদযাপন করেন বিএনপি প্রধান।
প্রবাসী বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় ও একটি নাগরিক সভায় বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। বিদেশে থাকা বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গেও বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও করণীয় নিয়ে বৈঠক হয় তার।

১৬৩৬০৯থ১টানা ২ মাস ৬ দিন লন্ডন অবস্থান শেষে ২১ নভেম্বর ফিরে এসে ২৫ নভেম্বর ও ২৬ নভেম্বর বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।
ওই বৈঠক থেকেই সিদ্ধান্ত নেন দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নের ভিত্তিতে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেবে তার দল ও জোট।
এই মুহূর্তে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন খালেদা জিয়া এবং তার দলের শীর্ষ নেতারা।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পণ করলেও রাজনীতিতে টিকে থাকার শেষ সুযোগ হিসেবে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, ফলাফল ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণাও দিয়েছে তারা।
বিষয়টিকে ‘দ্রোহে শুরু ও আত্মসমর্পণে শেষ’ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।


শেয়ার করুন