হালদা নদী ওয়াসার কারণে ঝুঁকির মুখে 

ডেস্ক নিউজঃ

দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনমিক জোন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’-এ পানি সরবরাহের জন্য হালদা নদীর তীরে আরও একটি পানি শোধনাগার স্থাপন করতে চায় চট্টগ্রাম ওয়াসা। মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-২ নামের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডিও শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে হালদা নদী থেকে দৈনিক আরও ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করবে ওয়াসা। এতে হালদায় পানির প্রাপ্যতা কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন হালদা নদী সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। তাই পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে তারা হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

তাদের দাবি, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শুষ্ক মৌসুমে হালদায় পানির প্রাপ্যতা কমে নদীতে মৎস্য প্রজনন বিঘ্নিত হতে পারে। সেই সঙ্গে নদীতে লবণাক্ত পানি বেড়ে হারিয়ে যেতে পারে নদীর বৈশিষ্ট্য।

তবে গবেষকদের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কারণে হালদা নদীর কোনও সমস্যা হবে না। পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ হালদা প্রবহমান নদী। খাগড়াছড়িতে উৎপত্তির পর ৮৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে এসে পড়ছে। পানি উত্তোলন না করা হলে সেই পানি কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে।

চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার ৩০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর স্থাপনের কাজ করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জমি বরাদ্দ নিয়ে ইতোমধ্যে ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ। তার আগেই ওই অঞ্চলে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় বেজা। চালুর আগেই শিল্প নগরীতে পানির চাহিদা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায় প্রতিষ্ঠানটি। যাতে বলা হয়, ২০৪০ সাল নাগাদ এই শিল্প নগরে দৈনিক সাড়ে ৯৬ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হতে পারে। বিপুল পরিমাণ পানির এই চাহিদা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে হালদা নদীর মোহরা পয়েন্টে ওয়াসার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানি, মুহুরী নদী, ফেনী নদী, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং সাগরের পানি ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাবও রয়েছে।

এর অংশ হিসেবেই ওই শিল্প নগরীতে ‘মোহরা পানি শোধনাগার পর্যায়-২’ প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়াসা দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে যাচ্ছে। ওয়াসার প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এরপর চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরে প্রকল্পটির এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) প্রতিবেদন জমা দেয় ওয়াসা। ওই প্রতিবেদন নিয়ে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চল পরিচালকের কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কেউ কেউ ওয়াসার এই প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের (চট্টগ্রাম অঞ্চল) মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যে ইআইএ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, সেখানে কিছু অপূর্ণতা ছিল। আমরা তাদের সেগুলো ঠিক করে পুনরায় জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি।’

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যে বলছে হালদা থেকে পানি উত্তোলন করলে সমস্যা হবে না, সেটি তারা কীসের ভিত্তিতে বলছেন? এটির কোনও দালিলিক প্রমাণ আছে? পানি উত্তোলন করলে অবশ্যই ক্ষতি হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারেই, পানি শোধনাগার ও সেচ প্রকল্পে প্রায় ৪২ কোটি লিটার পানি দৈনিক তোলা হয়। প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তা হবে ৫৬ কোটি লিটার। দৈনিক এই পরিমাণ পানি উত্তোলন করলে শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীর এক তৃতীয়াংশ পানি শুকিয়ে যাবে। এর ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র অবশ্যই নষ্ট হবে।’

মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি শিল্পায়নের বিপক্ষে নই। তবে সেটি আমাদের ঐতিহ্য হালদা নদীর ক্ষতি করে নয়। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের পাশেই ফেনী নদী, মহুরী প্রজেক্টসহ আরও অনেক পানির উৎস আছে। ওয়াসা সেগুলো থেকে পানি উত্তোলন করতে পারে। সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে অনেক কম খরচ পড়বে। যেখানে কাছে পানির উৎস আছে, সেখানে ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে তাদের মিরসরাই পানি নিতে হবে কেন? এতে প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনেক বেশি টাকা খরচ হবে।’ তিনি হালদা বাদ দিয়ে কর্ণফুলী নদী থেকে পানি উত্তোলনের পরামর্শ দিয়েছেন।

হালদা নদীর পানি দূষণের উৎস নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমন বড়ুয়া।

ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নে হালদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নে হালদার মৎস্য প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা না। ওয়াসা দাবি করছে, তারা চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ দশমিক ২ শতাংশের মতো পানি উত্তোলন করবে। তাই এটি পানির প্রাপ্যতা কমতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না। ওয়াসা অনেক আগ থেকেই হালদা থেকে পানি উত্তোলন করছে। তখন যেহেতু মৎস্য প্রজননের ক্ষতি হয়নি। তাই এখনও না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কৃষি কাজে হালদা থেকে বেশি পানি উত্তোলন করা হয়। সেটিকে রোধ করতে হবে।’

লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে নদীতে যখন পানি কম থাকে তখন জোয়ারের সাথে লবণাক্ত পানি হালদায় প্রবেশ করে। গত কয়েক বছর ধরেই হালদায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। এর জন্য কাপ্তাই বাঁধের দুইটা-তিনটা গেট শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারের সময় ছেড়ে রাখলে ওপরের দিক থেকে আসা পানির চাপে হালদায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারবে না। গত কয়েক বছর এইভাবেই লবণাক্ত পানি রোধ করা হচ্ছে। সামনেও একইভাবে এটি রোধ করতে হবে।’

ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইডব্লিউএম’র সমীক্ষা অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে হালদা নদীতে পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ ঘনমিটার। এখন দুই প্রকল্পের জন্য তোলা হয় ২ দশমিক ২০ ঘনমিটার/সে। আর নতুন প্রকল্প হলে তা হবে মোট ৩ দশমিক ৮৮ ঘনমিটার/সে। তা মোট প্রবাহের মাত্র ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিনটি প্রকল্পের অধীনে শুষ্ক মৌসুমে আমরা গড়ে ১ দশমিক ২৮ শতাংশ পানি উত্তোলন করি। ওই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, হালদা নদীতে বর্ষাকালে যখন মাছ ডিম ছাড়ে তখন নদীতে যথেষ্ট পানি প্রবাহ থাকে। তাই পানি আহরিত হলে ডিম ছাড়ার ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না।’

অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘আইডব্লিএম যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তার ১৩৬ পৃষ্ঠায় ফেব্রুয়ারি-মার্চে পানির প্রবাহ দেখানো হয়েছে ১৯-২৫ ঘনমিটার/সে। ওই তথ্য সঠিক হলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানি উত্তোলন হবে।’

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিরসরাইতে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী যেটি হয়েছে, সেখানে তারা হিসাব করে দেখেছে তাদের প্রচুর পানির প্রয়োজন। তারা সেখানে পানির যেসব সোর্স আছে, সেগুলো স্টাডি করে দেখেছে ওই পানি দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে না। তখন তারা আমাদের কাছে পানি সরবরাহের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। চেম্বার অব কমার্সের সভাপতিও মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন যে, পানি সরবরাহের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে শিল্প নগরী। তখন আমাদের বলা হলো সেখানে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তখন আমরা স্টাডি করে দেখলাম আমাদের পানির একমাত্র সোর্স হচ্ছে হালদা নদী। সেখানে প্রচুর পানি আছে। আমরা চাইলে সেখান থেকে অনেক পানি উত্তোলন করতে পারবো। সেটির ওপর আমরা একটি প্রস্তাবনা তৈরি করলাম। এরপর সেটি উপস্থাপন করার পর আমাদের ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে বলা হয়। আমরা সম্ভাব্য নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, হালদা নদীর পানি উত্তোলন করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে নদীর কোনও সমস্যা হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কর্ণফুলী হালদা নদী যেখানে মিশেছে সেখান থেকে দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-১ প্রকল্প। তার পাশেই আমরা ১৪ কোটি লিটার পানির মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-২ এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। আমাদের আরেকটি প্রকল্প মদুনাঘাট এলাকায়, যেটি হালদা এবং কর্ণফুলী নদীর সংযোগস্থল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। অন্যদিকে মাছ যেখানে ডিম পাড়ে সেটি হচ্ছে আরও অনেক ওপরে। কর্ণফুলী নদীর সংযোগস্থল থেকে অন্তত ৪০ কিলোমিটার ওপরে। তাই এটি মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’

এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘এটি জোয়ার-ভাটার নদী। পানি জোয়ারে আসে, ভাটায় নেমে যায়। এই পানি পুকুরের মতো আটকানোর কোনও সুযোগ নেই। তাই পানি কম বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা যদি পানি উত্তোলন না করি, তাহলে পানিগুলো কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে।’


শেয়ার করুন