সোশ্যাল ও অনলাইন মিডিয়া: বন্ধু যে, সেই শত্রু!

socia-media-sm20170109074842এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়া পাঠক-দর্শক-শ্রোতার জন্য যেনো বিশেষ এক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সমাজের একটি বড় অংশ বিমলানন্দে সামাজিক মিডিয়ায় পড়ে থাকছেন। লাইক, রিঅ্যাক্ট আর ইমোদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন। আর তাতে উদ্বেলিত সনাতনী ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো উদ্বাহু হয়ে ডিজিটাল হয়ে ওঠার তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। পাঠক ধরার খেলায় হেরে যাওয়া চলবে না এটাই যেনো পণ। কিন্তু কেনো?

এ প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে যে- এই পাঠক-দর্শক কিংবা শ্রোতা যে নামেই তাদের ডাকি না কেন, প্রধানত ভোক্তা শ্রেণি। তারা নিজেরাই এখন ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে কনটেন্ট তৈরি করছেন। হোক তা টেক্সট, ফটো, অডিও কিংবা ভিডিও। আর সামাজিক মিডিয়া তাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, অতি সহজেই তারা সেগুলো বন্ধু ও বন্ধুর বন্ধুদের নেটওয়ার্কে শেয়ার করতে পারছেন। গুগল বুকে প্রকাশিত অ্যালান বি আলবারানের লেখা ‘দ্য ট্রান্সফরমেশন অব দ্য মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’ বইয়ে এভাবেই বলা হয়েছে।

আর সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ঠিক এই কারণেই ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক নেটওয়ার্কের প্ল্যাটফর্মগুলো এখন হুলুস্থুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

তাতে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে নিউজ মিডিয়া!

প্রধানত এ কারণে যে এতদিন কোনটি খবর আর কোনটি খবর নয়, যে সংজ্ঞায় নির্ধারিত ছিলো তা এখন বিবেচিত হচ্ছে কোনটি মিডিয়ায় (সামাজিক কিংবা সংবাদ মাধ্যম) যাবে কোনটি যাবে না এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

আর স্যোশাল মিডিয়া যেহেতু সর্বভুকের মতো, যা পায় তাই খায়। তাই মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের পক্ষে আর সংবাদের সনাতনী সংজ্ঞায় আটকে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না।

পরিণামে মিডিয়া কোম্পানিগুলো এখন পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের তৈরি কনটেন্টকেও তার খবরের পেগ হিসেবে যেমন ব্যাপকহারে নিচ্ছে, তেমনি ব্যাপ্ত করেছে কভারেজের বিস্তৃতিও।

গেলো ক’টি বছরে নিউজ মিডিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জটা বাড়ছেই। একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তো নতুন চ্যালেঞ্জ এসে হাজির। এই যে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, তাতেই পাল্টে যাচ্ছে সাংবাদিকতার ধরন-ধারণ।

এনালগ মিডিয়ার বিশ্বে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতো মিডিয়া কোম্পানিগুলো, আর এখন ডিজিটাল বিশ্বে মিডিয়া সে নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। ট্রেডিশনাল মিডিয়াগুলো সকালের ঘটনাকে রাতে সংগ্রহ করে পরের দিন সকালে প্রকাশ করেও বাহবা পেতো। কিন্তু এখন সকালের খবর সকালেই দিতে হচ্ছে। না হলে তা প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সে কাজে পিছিয়ে থাকা মানেই কনটেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।

যে কোনো যোগাযোগ মাধ্যমেরই একটা প্রধানতম বিবেচনা হচ্ছে মিথষ্ক্রিয়া। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। বলা চলে এর মডেলটাই মিথষ্ক্রিয়ার। সে দিক থেকে সনাতনী সংবাদমাধ্যমগুলো সবচেয়ে পিছিয়ে। এক পাক্ষিক যোগাযোগের মাধ্যম টেলিভিশন, রেডিও ও সংবাদপত্র- এ মিথষ্ক্রিয়ায় ভর করা সামাজিক মাধ্যমের জয়জয়কারে পিছিয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটকে অবলম্বন হিসেবে নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো। কিন্তু এ কথাতো বলাই বাহুল্য মিথষ্ক্রিয়ার দৌড়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক মাধ্যমই এগিয়ে।

সমস্যা সেখানেও নয়। সমস্যা হয়ে গেছে ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যখন খবরাখবর সন্নিবেশের নতুন ধারার সংযোজন করলো তখন। প্ল্যাটফর্মটিকে যতটা সম্ভব ইন্ট্যারঅ্যাকটিভ করে ইউজারদের সক্রিয় করে তোলা হলো এমনভাবে যে তারাই এখানকার কনটেন্টের সরবরাহকারী, তারাই ব্যবহারকারী। কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে সোশ্যাল মিডিয়া ধীরে ধীরে সব মিডিয়ার জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে নিজেদের সর্বাগ্রে তো বটেই, অন্যদের চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে গেলো। এতে একটা শ্রেণির পাঠক গড়ে উঠলো যারা সামাজিক মাধ্যমে পড়ে থেকেই খবর নেয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো একটা শ্রেণি ভাবতেই শুরু করেছে- খবর যা পাওয়ার তা সোশ্যাল মিডিয়াতেই পাওয়া যাবে।

কেউ কেউ তো এমনও বলতে শুরু করেছেন- আরে ফেসবুকে দেখলাম। অর্থাৎ তারা ফেসবুকেই বিচরণ করেন আর ফেসবুকেই খবর পড়েন।

এ অবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদে পা দিলো মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো। তারা নিজেদের খবরকে জনপ্রিয় করে তুলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করতে শুরু করলো। লাইক-রিঅ্যাক্ট-কমেন্ট আর শেয়ারের দৌড়ে তারা এটাও ভুলে গেলো তারা হারিয়ে ফেলছে নিজেদেরই নাম। অর্থের বিনিময়ে করা সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনে তারা হয়তো নিজেদের লোগো পরিচিত করাতে পারছেন, কিন্তু কেউই (অধিকাংশ অর্থে) জানছেন না এই মিডিয়াগুলোর ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর (ইউআরএল) নামটি।

ফলে পাঠক এসব মিডিয়ার খোঁজ কেবল সোশ্যাল মিডিয়াতেই পাচ্ছেন কিংবা পাবেন। কেউ আর ইউআরএল লিখে ব্রাউজ করেন না। যা এক সময় সংবাদ মাধ্যমকে অস্তিত্ব সংকটেই ফেলবে।

একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম কি করতে পারে? তাকে তো কেবল নামের পেছনে আর বাণিজ্যিক দিকটি ভাবলে চলবে না। তার প্রধান ও অন্যতম কাজই হচ্ছে খবরের পরিবেশক হিসেবে নিজের নামটিকে উচ্চে তুলে ধরে রাখা। সবাই জানবে এ অনলাইন পোর্টালে গেলেই খবর পাওয়া যাবে। এটিকে জনগণের কিংবা পাঠকের প্রতি দায়িত্ব হিসেবেই নিতে হবে।

তখনই প্রশ্ন আসবে সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে সংবাদ মাধ্যমগুলো কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে। পাঠক যেনো তাকেই খবরের উৎস কিংবা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে করণীয়গুলো চিহ্নিত করে তবেই এগুতে হবে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদ সংস্থা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। অনেক মিডিয়াই এখান থেকে খবর সংগ্রহ করে তাদের মিডিয়ায় প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে এসব মিডিয়ার জন্য খবরের উৎস হিসেবে আস্থা অর্জনটাও জরুরি।

সোশ্যাল মিডিয়া যতটা গুছিয়ে আর জেঁকে বসেছে তাতে সহসাই এ ধারায় পরিবর্তন এসে যাবে তেমনটা নয়। সুতরাং সংবাদ মাধ্যম আর সংবাদ কর্মীদেরই দায়িত্ব নিজেদের পথ খুঁজে বের করা। যাতে পেশাদার সংবাদকর্মী আর সারাক্ষণের জন্য সংযুক্ত পাঠক শ্রেণি দু’য়ে মিলে কিছু একটা করা যায়। রয়টার্সের সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে এমনটাই বলা হয়েছে।

সাংবাদিকতার এ ধারায় কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মারিও আর. গার্সিয়া পুরো প্ল্যাটফর্মটিকে ব্যবহারের পথ খুঁজতে বলেছেন। আর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক অ্যাঙ্গেলা ফিলিপস জোর দিয়েছেন ‘গতি এবং মান’-এর ওপর। বলাই হয়, অনলাইনে ‘গতি আর শুদ্ধতা (মান অর্থে) হাতে হাত ধরে চলে।’

সোশ্যাবিলিটি, স্পিড অ্যান্ড কোয়ালিটি ইন দ্য চেঞ্জিং নিউজ এনভায়রনমেন্ট ইন জার্নালিজম প্র্যাকটিস নিবন্ধে ফিলিপস এখনকার সাংবাদিকতার চর্চায় একটি তৃতীয় স্তম্ভের কথা বলেছেন।

তার মতে অনলাইনে ভালো সাংবাদিকতায় গতি ও মান যদি হয় প্রথম দু’টি স্তম্ভ, তাহলে তৃতীয় স্তম্ভটি হবে সোশ্যিয়েবিলিটি বা মিশুকতা। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বা আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।

ফিলিপস বলেন, এটা সত্য খবরের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে বর্তমানে এ একাত্ম হয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে খবর হিসেবে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার পথ বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ খবরটিকেই এমন ভাবে তৈরি করতে হবে, যে তা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে।

এই যে ছড়িয়ে দেওয়া- এর জন্য ভর করতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকতেই হবে। হোক তা মধুর কিংবা তিক্ততার। যা পুরোই অনিশ্চিত। শুধু এটাই মনে রাখতে হবে… বন্ধুত্ব মানেই নির্ভরতা নয়। অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পর্কটি হচ্ছে ঠিক সেই গানের মতো- একজনই তুমি বন্ধু আমার… শত্রুও তুমি একজনা।

 


শেয়ার করুন