সিরীয় ছোটগল্প: বাঘ

shajahanমূল: জাকারিয়া তামির

অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান

[জাকারিয়া তামির। সিরীয় ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। জন্ম ১৯৩১ সালে। সিরিয়ার আল-বাশা শহরে। আধুনিক আরবী কথা  সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী। স্বৈরশাসন-বিরোধী বুদ্ধিজীবী। শিশুতোষ রুপকথার আড়ালে প্রচন্ড রাজনীতি-সচেতন লেখক তিনি। এখানে মূল আরবী থেকে ‘টাইগারস অন দি টেন্থ ডে’ শিরোনামে ইংরেজিতে অনুদিত তাঁর ছোটগল্পটির বাংলা অনুবাদ পত্রস্থ করা হলো।]

খাঁচা-বন্দি  বাঘটি বন্য জীবনকে ভুলতে পারে না।

খাঁচার বাইরের মানুষগুলোকে ঘৃণা-ভরা চোখে দেখে সে। নির্ভয় লোকগুলো আগ্রহভরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এদের মধ্যে একজন শান্ত, কর্তৃত্বপূর্ণ কন্ঠে বলে:

– তোমরা যদি সত্যি সত্যি আমার কাজটি শিখতে চাও অর্থাৎ পশু পোষ-মানানো বিদ্যা রপ্ত করতে চাও, তাহলে এক মূহুর্তের জন্যেও ভুলো না যে, পশুটির পেটই তোমাদের প্রধান লক্ষ্য। দেখবে, এই পেশাটি একই সঙ্গে সহজ, আবার কঠিনও। এই বাঘটিকেই দেখো না; বেশ হিংস্র, বেয়াড়া, স্বাধীনচেতা আর শক্তিশালী, তাই না? কিন্তু সে বদলে যাবে- দুর্বল, ভদ্র আর বিনয়ী হয়ে উঠবে- ঠিক শিশুদের মতো। যার হাতে খাবার আছে আর যার হাতে তা নেই- এদের দুজনের মধ্যে কী ঘটে দেখো, শিখে নাও।

অন্য লোকগুলো পোষ-মানানো বিদ্যার প্রতি তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে ছুটে আসে। পোষ-মানানো বিদ্যার প্রশিক্ষক খুশি হয়। সে বাঘটিকে লক্ষ্য করে রসিকতাপূর্ণ কন্ঠে বলে:

– তো, কেমন আছে আমাদের সম্মানিত অতিথি?

– আমার খাবার প্রস্তুত করো; আমার খাওয়ার সময় এখন। বাঘটি বলে।

– আমার হাতে বন্দী হয়ে আমাকেই নির্দেশ দিচ্ছিস, তুই? খুব মজার বাঘ তো, তুই? তোর তো এটা বুঝা উচিত যে, এখানে আদেশ-নির্দেশ দেবার মালিক একমাত্র আমিই। প্রশিক্ষক কৃত্রিম বিস্ময়ে বলে।

– বাঘদের কেউ নির্দেশ দিতে পারে না।

– কিন্তু তুই তো বাঘ নস আর। বনে তুই বাঘ, কিন্তু এখানে তো খাঁচা-বন্দী তুই। এখন তুই আমার আদেশ-নির্দেশ-মানা অধীনস্থ দাসানুদাস ছাড়া কিচ্ছু না।

– আমি কারও দাস না।

-আমার নির্দেশ মানতেই হবে তোর। কারণ, এই দেখ, তোর খাবারটা আমার হাতেই কিন্তু।

– আমি তোমার খাবার চাই না।

– তোর যা ইচ্ছে। না খেয়েই থাক, তাহলে। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোকে কিছু করতে বাধ্য করতে চাইছি না। প্রশিক্ষক বলে।

এরপর প্রশিক্ষণার্থীদের দিকে তাকিয়ে সে বলে:

– দেখবে কী করে সে মত বদলায়। কেবল মাথা উঁচু করে থাকলেই তো পেট ভরবে না আর।

বাঘটি না খেয়ে থাকে। বনে বাতাসের বেগে ধেয়ে গিয়ে শিকারের উপর হামলে পড়ার স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।

পরদিন প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীরা খাঁচার কাছে এসে জড়ো হয় আবারও।

– তোর কি ক্ষিদে পায়নি? নিশ্চয় পেয়েছে, কী বলিস? খুব কষ্ট হচ্ছে তো? একবার শুধু বল, তুই ক্ষুধার্ত। তারপর যতো পারিস, মাংস খা। প্রশিক্ষক বলে।

বাঘটি চুপ করে থাকে।

– আমার কথা শোন। বোকামি করিস না। শুধু এটা স্বীকার করে নে যে, ক্ষিদে পেয়েছে তোর। সাথে সাথে খেতে দেবো তোকে। প্রশিক্ষক আবারও বলে।

– আমি ক্ষুধার্ত। বাঘটি বলে।

প্রশিক্ষক হেসে উঠে। সে প্রশিক্ষণার্থীদের বলে:

– এখন সে এমন এক ফাঁদে পা দিয়েছে যা থেকে আর কখনও বেরুতে পারবে না।

সে বাঘটিকে খাবার দিতে বলে। ফলে প্রচুর মাংস খেতে দেয়া হয় বাঘটিকে।

তৃতীয় দিন প্রশিক্ষক বাঘটিকে বলে:

– যদি খেতে চাস তো, আমার কথামতো কাজ কর।

– আমি মানবো না তোমার কথা। বাঘটি বলে।

– অতো তাড়াতাড়ি ‘না’ বলিস না। আমার অনুরোধটা তো খুব ছোট। তুই এখন খাঁচার ভেতর পায়চারি করছিস। আমি যখন বলবো ‘থাম’, তুই থেমে পড়বি।

– এটা তো ছোট একটা অনুরোধ; এভাবে নাছোড়বান্দার মতো গোঁ ধরে না খেয়ে থেকে লাভ কি খামাখা? বাঘটি মনে মনে ভাবে।

– থাম! প্রশিক্ষক কর্কশ কন্ঠে উচ্চ স্বরে নির্দেশ দেয়।

বাঘটি তৎক্ষণাৎ থেমে পড়ে।

– এই তো, এই তো চাই। বন্ধুত্বপূর্ণ কন্ঠে বলে প্রশিক্ষক।

বাঘটিও পেটপুরে খেতে পেয়ে খুশি হয়।

– দিন কয়েকের মধ্যেই বেটা কাগুজে বাঘ হয়ে উঠবে। প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলে প্রশিক্ষক।

চতুর্থ দিনে বাঘটি প্রশিক্ষককে বলে:

– আমি ক্ষুধার্ত- আমাকে থামতে বলো।

– দেখো, সে আমার নির্দেশ মানতে শুরু করেছে। প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণার্থীদের বলে।

এরপর সে বাঘটির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে:

– বিড়াল ছানার মতো মিও মিও করে না ডাকলে আজ কোন খাবার পাবি না তুই।

– বিড়াল ছানার মতো মিও মিও ডাকতে ভারি মজাই লাগবে। রাগ সংবরণ করে মনে মনে বলে বাঘটি। এরপর সে মিও মিও ডাকার চেষ্টা করে।

– জঘন্য! নাকে গরগর শব্দ করলেই কি মিও ডাক হয়? বেজার কন্ঠে বলে প্রশিক্ষক।

বাঘটি আবারও চেষ্টা করে। কিন্তু প্রশিক্ষক খুশি হতে পারে না।

– চুপ কর! তোর মিও ডাকটি এখনও জঘন্য। মিও ডাক শেখার জন্যে একদিন সময় দিচ্ছি। আগামীকাল তোর পরীক্ষা নেবো। পাস করলে খেতে পাবি, না হলে পাবি না।

প্রশিক্ষক ধীর পায়ে প্রস্থান করে সেখান থেকে। প্রশিক্ষণার্থীরাও তার পেছন পেছন চলে যায়। বাঘটি অবাধ বন্য জীবনের কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কিন্তু তার করুণ আর্তি অনেক দূরের সেই বনে গিয়ে পৌঁছোয় না।

পঞ্চম দিনে প্রশিক্ষক বাঘটিকে বলে:

– বিড়াল ছানার মতো ডাকতে পারলে তাজা মাংসের একটা বড় টুকরো খেতে পাবি।

বাঘটি মিও মিও করে ডেকে উঠে। প্রশিক্ষক খুশিতে হাততালি দিয়ে বলে:

– চমৎকার! এই তো, বিড়ালের মতো সুন্দর ডাকছিস। প্রশিক্ষক বাঘটির দিকে মাংসের বড় একটি টুকরো ছু্ঁড়ে দেয়।

ষষ্ঠ দিনে প্রশিক্ষক খাঁচার কাছে যেতে না যেতেই বাঘটি বিড়ালের মতো ডেকে উঠে। কিন্তু প্রশিক্ষক খুশি হতে পারে না।

– কিন্তু আমি তো বিড়ালের মতোই ডেকেছি। বাঘটি বলে।

– গাধার মতো করে ডাক। প্রশিক্ষক নির্দেশ দেয়।

– আমি তো একটা বাঘ। বনের পশুরা আমাকে ভয় পায়। গাধার মতো ডাকবো? আমি বরং মরে যাবো। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে বাঘটি।

প্রশিক্ষক কিছু না বলে নীরবে প্রস্থান করে।

সপ্তম দিনে প্রশিক্ষক হাসি হাসি মুখে খাঁচার পাশে এসে হাজির হয়:

– খেতে চাসনে তুই?

– হ্যাঁ, চাই। বাঘটি বলে।

– তুই যে মাংসটা খাবি তার তো একটা দাম আছে। গাধার মতো ডাক, খেতে পাবি। প্রশিক্ষক বলে।

বনের মুক্ত জীবনের কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করে বাঘটি। কিন্তু পারে না। সে চোখ দুটো বন্ধ করে গাধার মতো ডাকতে চেষ্টা করে।

– তোর গাধার ডাকটা ভালো হচ্ছে না। কিন্তু দয়া করে এক টুকরো মাংস খেতে দিচ্ছি তোকে।

অষ্টম দিনে প্রশিক্ষক বলে:

– আমি একটা বক্তৃতার শুরুর অংশটা বলবো। আমি শেষ করার সাথে সাথে তুই এমনভাবে হাততালি দিবি যেনো বক্তৃতাটা খুব পছন্দ হয়েছে তোর।

– ঠিক আছে, তা-ই হবে। বাঘটি বলে।

প্রশিক্ষক বক্তৃতা শুরু করে:

– নাগরিকগণ—–আমাদের এখনকার মূল লক্ষ্যটি আপনাদের নিকট বহুবার ব্যাখ্যা করেছি। আমাদের শত্রুদের ষড়যন্ত্র যতোই শক্তিশালী হোক না কেনো, আমরা ঈমানের সাথে যুদ্ধ করে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বিজয়ী হবোই।

– আমি তোমার বক্তৃতাটা বুঝিনি। বাঘটি বলে।

– আমি যা কিছু বলি তার সবই পছন্দ করা তোর জন্যে আবশ্যক। আর স্যোৎসাহে হাততালিও দিবি।

– আমাকে ক্ষমা করো।আমি মূর্খ। তোমার বক্তৃতাটি দারুণ! আমি তোমার ইচ্ছেমতোই হাততালি দেবো। বাঘটি হাততালি দিতে শুরু করে।

– আমি দু’ মুখোদের পছন্দ করি না। আজ না খেয়ে থাকবি তুই- এটিই তোর শাস্তি।

নবম দিনে প্রশিক্ষক কিছু খড় নিয়ে এসে হাজির হয়। খড়টুকু সে বাঘটির দিকে ছুঁড়ে দেয়।

– খা। প্রশিক্ষক বলে।

– এটা কী? আমি তো মাংসাশী। বাঘটি বলে।

– আজ থেকে খড় ছাড়া আর কিচ্ছু খেতে পাবি না।

বাঘটির ক্ষিদে বাড়তে থাকে। সে খড়টুকু খেতে চেষ্টা করে। খড়ের বিদঘুটে স্বাদে তার গা গুলিয়ে উঠে। কিন্তু সে আবারও চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে খড় খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে বাঘটি।

দশম দিনে প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থীরা, বাঘটি ও তার খাঁচাটি  উধাও হয়ে যায়। বাঘটি একজন নাগরিকে ও খাঁচাটি একটি নগরীতে রুপান্তরিত হয়।

মোহাম্মদ শাহজাহান: অনুবাদক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।


শেয়ার করুন