সিটি নির্বাচনে স্বস্তি, তারপর?

আবুল মোমেন

কার্টুন: তুলি

ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম মহানগর—এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা এবং সমাজে স্বস্তি ফিরবে কি না, এ প্রশ্ন সবার মনে। আন্দোলন ও দাবি আদায়ের অংশ হিসেবেই বিএনপি নির্বাচনে আসছে। এটি যে শুভ চিন্তা, তা মানতে হবে। নিকট অতীতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা পাঁচ-পাঁচটি সিটি মেয়র নির্বাচনে বড় ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা তাদের নিশ্চয় বয়কট ও নেতিবাচক রাজনীতি থেকে সরে আসতে অনুপ্রাণিত করেছে। এবার যেকোনো রকম ইতিবাচকতাকে স্বাগত জানাবে জনগণ।
আসন্ন এই তিনটি স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে বলার সময় এখনো আসেনি। আমরা বরং নির্বাচনগুলোকে ঘিরে রাজনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে কি না, তা দেখতে পারি। মানুষ ব্যগ্রভাবে সেটাই চায়।
সত্যিই জনগণ দীর্ঘ প্রায় তিন মাসের আন্দোলন নিয়ে আতঙ্কিত ও হতাশ। আন্দোলনের ধরন থেকে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি এ-ও মনে হয়েছে যে সাধারণ মানুষের জন্য তাদের দরদ নেই। আন্দোলনের ভয়ংকর দুঃসহ যন্ত্রণাময় ধকল তারাই তো ভোগ করেছে। মানুষ শারীরিকভাবে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই আত্মরক্ষার কথাই আগে ভাবে, তাদের পক্ষে সংগঠিত প্রতিবাদে নামার উদ্দীপনা থাকার কথা নয়। বরং চরম দুর্ভোগের সময় তারা কাউকে পাশে চায়, কারও সাহায্য চায়। বিএনপি সেটা করেনি। ফলে এ আন্দোলন তাদের বিপক্ষেই গেছে এবং যাচ্ছে।
জনগণের এই মনোভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার মতো অত সরল নয় পরিস্থিতি। সাম্প্রতিক কালে বিএনপির পরিচিত দুজন নেতার গুম বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। সাম্প্রতিককালে আরও মানুষ গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন। এসব ঘটনা ভুক্তভোগী পরিবারকে যে যন্ত্রণায় ঠেলে দেয়, তা আগুনে পোড়া পরিবারের যন্ত্রণার মতোই। তা ছাড়া, এ রকম ঘটনা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে চাপা আতঙ্ক, গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, যার প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদি। নির্বাচনে মানুষের এই অসংগঠিত নীরব আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে নীরবেই।
সরকার ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে দুর্বল করে ফেলার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে হয়। এ রকম কৌশল জেনারেল জিয়াও নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন তো দূরের কথা, দুর্বল করাও সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে একুশ বছর পর দলটি ক্ষমতায় ফিরেছিল। এর আগে পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, জনপ্রিয় আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান মুসলিম লীগ কেবল ক্ষমতাই হারায়নি, এই প্রদেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনো দল নিশ্চিহ্ন হয়, কোনোটি হয় না। তখনকার বিশ্বে, বিশেষত উপনিবেশমুক্ত দেশে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক দর্শন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একদিকে দলকে জনগণের ভেতরে সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভিত্তি দিতে পেরেছিল আর অন্যদিকে উদীয়মান শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দর্শনগুলো গ্রহণ করেছিল। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় মেলে। তিনি বুক চিতিয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ, দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বঙ্গবন্ধুকে সবার চেয়ে এগিয়ে রেখেছিল এবং শেষ পর্যন্ত এক মহানায়কে রূপান্তরিত করেছিল।
বিপরীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের নেতারা ছিলেন জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কবিহীন অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের, বিশেষত বাংলার মুসলমানদের মনের কথা বলে দলটি অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সহজেই জনসমর্থন পেয়ে নেতারা আর দলের সাংগঠনিক ভিত্তি ও বিকাশের বিষয় নিয়ে ভাবেননি, কাজ করেননি। এই হলো ক্ষমতা গ্রহণ ও ভোগের জন্য তৈরি দল।
১৯৭৫–এর শেষ ভাগে আকস্মিকভাবে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমানকেও রাজনৈতিক দল গঠন করতে হয়েছিল। তখন তিনি একদিকে ক্ষমতার জবরদস্তি চালিয়ে সামরিক-বেসামরিক অস্থিরতা দমন করেছেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি অর্থাৎ মুসলিম জাতীয়তার রাজনীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বিএনপি ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। তবে পরবর্তী শাসক জেনারেল এরশাদ কেবল ক্ষমতা গ্রহণের ধরন ও ধারাবাহিকতায় নয়, রাজনৈতিক মতাদর্শেও তাঁর উত্তরসূরিই ছিলেন। তা সত্ত্বেও স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্রের আন্দোলনের সূত্রে, অনেকটা আন্দোলনের মাঠপর্যায়ে মুখ্য দল আওয়ামী লীগের সহযোগিতাতেই বিএনপি টিকেও গেল। শুধু টিকে নয়, ১৯৯১-এ গণতন্ত্রে উত্তরণের পরে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকারও গঠন করল। এ পর্যন্ত এই দলের অগ্রযাত্রা বিবেচনা করে বলা যায় যে বাংলাদেশে মুসলিম লীগ ধারার রাজনীতির ভিত্তি যথেষ্ট ব্যাপক। এমন হতেও পারে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে প্রবল সরকারি চাপে ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘদিন টিকতে পারবে না এই দলও। কিন্তু তাই বলে এই মতাদর্শের সমর্থক-ভোটার কমবে না। বিএনপি না পারলে অন্য নামে তারা সংগঠিত হবে। সমর্থকদের চাহিদা ও প্রণোদনা তো থাকবেই।
ফলে মানতে হবে আওয়ামী লীগসহ যারা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা জনকল্যাণমূলক অর্থনীতির আদর্শে দেশ চালাতে চায়, তারা জনগণের মধ্যে এর মতাদর্শিক ভিত্তিটা দাঁড় করাতে পারেনি। দেখা গেছে, অত্যন্ত সস্তা স্লোগান দিয়ে বিপক্ষ দল ভোটারদের টানতে পেরেছে। এর মধ্যে প্রধান ছিল ধর্মনিরপেক্ষ দল ক্ষমতায় এলে ধর্ম থাকবে না এবং সেই সূত্রে দেশ ভারতের কুক্ষিগত হয়ে পড়বে—এমন প্রচারণা। এখনো অনেক মানুষ এসব কথা বিশ্বাস করে। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সোজাসাপ্টা কৌশল নিয়েছে—তারা নেতা-কর্মীদের ধর্মচর্চাকে দৃশ্যমান করেছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে, রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ দলের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি পাল্টে ধর্মভিত্তিক রূপ দাঁড় করিয়েছে। হয়তো এসব কৌশল ভোটের রাজনীতিতে কাজ দিয়েছে। কিন্তু এতে সমাজের প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগগুলো ব্যাহত হয়েছে, সমাজের স্বাভাবিক উদার মানবিক বাতাবরণ দুর্বল হয়েছে। আমরা লক্ষ করলে দেখব, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকলেও পশ্চিমের উন্নত দেশের কোথাও ধর্মহীনতার প্রকোপ নেই, সেসব দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কেউই নিজের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দেয় না, গির্জায় যাতায়াতেও কমতি নেই, ধর্মীয় পর্বগুলোও ঠিকঠাক পালিত হয়। এমনকি অভিবাসী বা ধর্মান্তরিত মানুষও তাদের নিজ নিজ ধর্ম ঠিকঠাকমতোই পালন করে থাকে। বরং দুঃখের সঙ্গে বলতে হবে, সেসব সমাজে সাধারণ মানুষের নীতিবোধ ও মূল্যবোধ আমাদের চেয়ে ভালো। আমরা কোনোভাবে মিথ্যাচার, কপটতা, প্রতারণা, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারছি না। ধর্মের দোহাই দিয়েও পারছি না।
আমি পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ও সচেতন। তৃতীয় বিশ্বের ওপর তাদের শোষণ-নির্যাতনের কথাও আমরা জানি। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া আক্রমণের এবং প্যালেস্টাইন নিয়ে তাদের অসদুদ্দেশ্যও গোপন নেই। আপাতত আমি একটি দেশের সমাজজীবন কীভাবে আলোকিত, উন্নত, স্থিতিশীল ও নাগরিকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ করে গড়ে তোলা যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দিচ্ছি। আমরা যেন বহিঃসম্পর্ক ও স্বদেশীয় স্বার্থ সংরক্ষণ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলছি। ধর্ম বা মাতৃভাষা দুটিই মানুষের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক উপাদান। দুটিই রক্ষা ও চর্চা করে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক নাগরিক হওয়া সম্ভব। কারণ, যুগে যুগে সব সমাজেই দেখা গেছে যে অধিকাংশ মানুষই ধর্মভীরু এবং নিজ ধর্ম পালনে উৎসাহী। একই কারণে মাতৃভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাও রুদ্ধ করা সম্ভব নয়।
বাস্তবতার আলোকেই ইংরেজি ভাষাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হয়েছে, মাদ্রাসায়ও এ ভাষা চালু করতে হয়েছে, বিজ্ঞান-গণিত শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছে; তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সব ধর্ম, সব মতাদর্শের জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার কিংবা বিতর্ক সৃষ্টির কোনো মানে নেই। সরকার নয়, সমাজই সমাজকে পাল্টায়।
আমরা বহু বছর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি, বহু বছর ধরে গণতান্ত্রিক শাসনের চর্চাও করেছি। কিন্তু সে কেবল নির্বাচন ও সরকার বদলেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, সমাজের বা সমাজমানসের গণতন্ত্রায়ণের কাজ হয়নি। তাই এত বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। প্রায় দুই শ বছর ধরে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলেও যুক্তি, বিচারবোধ, বিবেকবোধ ইত্যাদিতে উন্নত এমন সমাজ তৈরি করতে পারছি না, যেখানে আত্মবিশ্বাসী, আত্মমর্যাদাশীল আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। বহুমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়ে উঠবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি কেবল নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা লাভের সংক্ষিপ্ত অর্জন নিয়ে মশগুল থাকে এবং এর জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করতে দ্বিধা না করে—যেমন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, ক্ষমতা বিস্তারে অস্ত্র ও অবৈধ অর্থের ব্যবহার—তাহলে সমাজের উত্তরণ ঘটবে না। বাহ্যত আধুনিক নগরায়ণ ও পোশাকি নাগরিকতা তৈরি হবে, কিন্তু তা হবে ময়ূরপুচ্ছ, ভেতরে মধ্যযুগীয় চিন্তা, সামন্ত সংস্কৃতি ঠিকই বহাল থাকবে। তাই আসন্ন মেয়র নির্বাচন নিয়ে যদি শান্তি-স্থিতি কিছুটা আসে, তা-ও হবে সাময়িক। আমাদের অপরিণত সমাজকে পরিণত পরিশুদ্ধ করে তুলতে একযোগে শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। সে কাজ বাদ রেখে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন করে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।


শেয়ার করুন