সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তরণ চায় উভয় পক্ষ!

সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তরণ চায় উভয় পক্ষ!দ্য রিপোর্ট:

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই দুই নগরীর তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সাবেক ক্ষমতাসীন দল বিএনপি। অন্যদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, অন্যথায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও চরম অবনতির দিকে ধাবিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

২৮ এপ্রিল ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। প্রথমে বিএনপি থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সরাসরি ঘোষণা না এলেও বিএনপিপন্থী মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা সংগ্রহ করেছেন মনোনয়নপত্র। নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত হয় ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। এ প্ল্যাটফর্ম থেকেই অরাজনৈতিক এ সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

এদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চললেও চলতি সপ্তাহের বুধবার থেকে সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসে দিয়ে আসা হরতাল থেকে সরে এসেছে জোটটি। ২৫ ও ২৬ মার্চ হরতাল কর্মসূচি ছিল না তাদের। অন্যদিকে জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তা এখন পর্যন্ত কার্যকর করেনি প্রশাসন। ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’ সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য এলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের রয়েছে ভিন্নমত। তাদের মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম অস্থিতিশীল পর্যায়ের আশঙ্কা এড়াতেই সরকার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।

চলতি বছর ৫ ও ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিএনপি জোটের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অবস্থান দেখা গেছে তা বিগত কয়েক দিন অনেক শিথিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় ‘অবরুদ্ধ’ করার বেলায় পুলিশের কর্মকাণ্ড এখন শিথিল রয়েছে। প্রকাশ্যে আসতেও শুরু করেছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। আর নিয়মিতই কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করছেন তারা। সব মিলিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে একটি ‘গোপন সমঝোতা’ ও ‘আলোচনার’ বিষয়টিকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ। তাদের মধ্যে গোপন কিছু হয়ে থাকলে তা গোপনই থাকবে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হোক এটিই সবার কাম্য।

এ বিষয়ে কথা বলা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আসলে যে অবস্থাতে দেশ চলে গেছিল, এভাবেতো চলতে পারে না। অবশ্য পরিবর্তন দরকার ছিল। দেশের প্রধান দুটি দলই তাদের অনড় অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল। তবে উভয়েরই ছাড় দেওয়া বা সমঝোতার মানসিকতা না থাকায় ভিন্নপথে তারা সরতে চাইছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরতে চাইছে। হয়ত এ নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বড় যে সমস্যা তাও হয়তো এর মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। তবে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়।’

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। আমরা হয়তো যা ভাবছি তা হয়তো কিছুই না। তবে সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, কিছু একটা হতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করবে নির্বাচন কেমন হয়। এটা কোনো জাতীয় নির্বাচন না হলেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু জাতীয় পর্যবেক্ষকই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা পর্যবেক্ষণ করবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড কেমন হয়?’

সরকার ও বিএনপির মধ্যে গোপন আলোচনা বা সমঝোতা হতে পারে কীনা-এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘গোপন সবসময় গোপন থাকে। পরিস্থিতি দেখে এমনটা সন্দেহ করা অমূলক নয়। আর গোপনে কিছু হওয়ার মতো গ্রাউন্ডও (অবস্থা) রয়েছে। কারণ কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না। এটা তারা তাদের ইমেজ বলে মনে করছে। তাই গোপনে পরিস্থিতি সমাধানের চেষ্টা হতে পারে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুটি দলই এক্সিট ওয়ে (বেরিয়ে আসার পথ) খুঁজছে বা বেরিয়ে আসতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ এভাবে কতদিন চলবে? উভয়পক্ষ যদি অনড় অবস্থানে থাকে তাহলে তো কোনদিনই সমাধান হবে না। তারপরও সিটি করপোরেশন নির্বাচন যদি এক্সিট ওয়ে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই নির্বাচনটা ফেয়ার হতে হবে। ফেয়ার না হলে পরিস্থিতি আগের মতোই এমনকি আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে।’

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দুই দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ সে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে কখনো দেখিনি। যদি গোপন কিছু হয়ে থাকে তাহলে অনেক আগেই হতো। তারপরও গোপন তো গোপনই, হলে ভালো। গণতন্ত্রের জন্য সমঝোতা সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। এটা তারা বুঝে থাকলে দেশেরও মঙ্গল, তাদের জন্যও মঙ্গল।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বা এক্সিট ওয়ে হওয়ার কথা না। কেননা এটা একটি অরাজনৈতিক নির্বাচন। তারপরও আমাদের দেশের আইনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলা হলেও তা সব সময় রাজনৈতিকভাবেই হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি জানে। এখন কথা হচ্ছে, দেশের যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। দেশের মানুষ একটি একতরফা নির্বাচন দেখেছে। যেখানে জনমতের কোনো প্রতিফলনই ছিল না। বিএনপির প্রধান দাবি ছিল সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার। আর সে জন্য তারা লাগাতার কর্মসূচি দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে তা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। একইসঙ্গে চরম বিতর্কিত একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে সেটাও যৌক্তিক হতে পারে না। অবশ্যই একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করা উচিৎ।’

বদিউল আলম বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে এ নির্বাচনের মাধ্যমে সবাই দুই দলের অবস্থার পরিবর্তনের আশা করলেও, কিছু আশঙ্কা রয়ে গেছে। আসলে এই নির্বাচন ঘোষণার মাধ্যমে সরকার হয়ত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে, অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। আমাদের দেশে যে সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দল দুটি নিচ্ছে তা সম্পূর্ণ আবেগনির্ভর। একক ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি ও রাগ-বিরাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এতে করে কে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেটা মূল্যায়ন করা হয় না।’

সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতার বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা অসম্ভব একটা বিষয়। যদি এমনটি হতো তাহলে গোপনে না, প্রকাশ্যে হতো। তেলে জলে যেমন এক হয় না, বিএনপি-আওয়ামী লীগও এক হবে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকেও যেতে পারে।’

এ বিষয়ে কথা বলা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার কোনো এক্সিট ওয়ে খুঁজছে না। সরকার তাদের স্থানে অনড়। নাশকতা, সহিংসতার কোনো স্থান গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকতে পারে না। আর এসব ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে এ জন্য তাদের অভিনন্দন। আগে থেকেই আমরা বিএনপিকে সহিংসতার পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক পথে আসার আহ্বান জানিয়েছি। এখন তারা সহিংস কর্মসূচি প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে চায়। সিটি নির্বাচন বিএনপির জন্য এক্সিট ওয়ে হতে পারে, আওয়ামী লীগের জন্য না।’

আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বের হতে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাচ্ছে কীনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমদ আজম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন মোটেই ব্যর্থ নয়। আমরা আন্দোলনে শতভাগ সফল হয়েছি। কারণ বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলের যে আন্দালন তা শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা সরকারের পতন ঘটানোর জন্য নয়। এ আন্দোলন দেশের মানুষের ন্যায্য গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকারসহ জনগণের সকল অধিকার পুনরুদ্ধার এবং রক্ষার আন্দোলন।’

তিনি বলেন, ‘এ কারণেই আমাদের দীর্ঘ আড়াই মাসের আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের সাময়িক ক্ষতি হলেও তারা তা সহ্য করেছে এবং হাসিমুখে তা গ্রহণ করেছে। আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি- এটাই তার প্রমাণ। জনগণ আমাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করে আন্দোলনের ন্যায্যতা প্রমাণ করবে।’

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সরকরের সঙ্গে গোপন কোনো আঁতাত হয়েছে কীনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এ্যাডভোকেট আহমদ আজম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো চুক্তি বা আলোচনা হয়নি। বিএনপি শুধু আন্দোলনেরই দল নয়, নির্বাচন করারও দল। পাঁচবার নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। কাজেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি সরকারের সঙ্গে কোনো আঁতাত নয়। এটি মাননীয় চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।’

তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার যদি কারচুপির মাধ্যমে আমাদের হারিয়ে দেয়, তাহলে জনগণ তা দেখবে, বিশ্ববাসীও তা দেখবে। আমাদের আন্দোলনের ন্যায্যতাও প্রমাণ পাবে।’


শেয়ার করুন