সাখাওয়াতের ফাঁসি, সাতজনের আমৃত্যু দণ্ড

shakhawat___123330_123340যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সাংসদ ও বর্তমানে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এছাড়া সাত আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। বুধবার বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সংখ্যাগরিষ্ট মতের ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করেন।

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. বিল্লাল হোসেন (৭৫), মো. ইব্রাহিম হোসেন (৬০), শেখ মোহাম্মদ মুজিবর রহমান (৬১), মো. আ. আজিজ সরদার (৬৫), আ. আজিজ সরদার (৬৬), কাজী ওহিদুল ইসলাম (৬১) এবং আব্দুল খালেক মোড়ল (৬৮)। মামলাটিতে নয়জন আসামি থাকলেও লুৎফর মোড়ল মৃত্যুবরণ করায় তাকে মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন গ্রেপ্তার রয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় দুজনই ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।

বেলা ১০টা ৫০মিনিটে ৭৬৮ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি শাহিনুল ইসলাম। এরপর রায়ের সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক। বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী আদালতে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থতার কারণে তিনি রায় পড়েননি।

রায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচ অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। দুই ও চার নম্বর অভিযোগে মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায়ে সাখাওয়াতকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। দুই নম্বর অভিযোগে বাকি সাত আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও চার নম্বর অভিযোগে চার আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।

কোন অভিযোগে কি সাজা: এক নম্বর অভিযোগে যশোরের কেশবপুর উপজেলার বোগা গ্রামে এক নারীকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগে সাখাওয়াত হোসেন, মো. ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার এবং আব্দুল আজিজ সরদারকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগে কেশবপুর উপজেলার চিংড়া গ্রামের চাঁদতুল্য গাজী ও তার ছেলে আতিয়ারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ অভিযোগে বাকি সাত আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরা হলেন- মো. বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস, মো. ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার,কাজী ওহিদুল ইসলাম এবং মো. আব্দুল খালেক।

তৃতীয় অভিযোগে কেশবপুরের চিংড়া গ্রামের মো. নুরুদ্দিন মোড়লকে অপহরণ, আটক, নির্যাতনের অভিযোগে সাখাওয়াত হোসেন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, মো. ইব্রাহিম হোসাইন এবং মো. আব্দুল খালেক মোড়লকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

চতুর্থ অভিযোগে কেশবপুরের হিজলডাঙার আ. মালেক সরদারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও খুনের অভিযোগে সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এ অভিযোগে মো. ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার এবং মো. আব্দুল খালেক মোড়লকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন।

পঞ্চম অভিযোগে কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের মিরন শেখকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে সাখাওয়াত হোসেন, মো. ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার এবং মো. আব্দুল খালেক মোড়লকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করেন।

কে এই সাখাওয়াত হোসেন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মানবতাবিরোধী মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা সবাই একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যশোরের কেশবপুর এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য সাখাওয়াতের নেতৃত্বে ওই এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেন।

মামলার অভিযোগপত্রে সাখাওয়াতের বিষয়ে বলা হয়, ১৯৫৪ সালে যশোরের হিজলডাঙ্গা গ্রামে জন্ম হয় সাখাওয়াত হোসেনের। ১২ বছর বয়সেই যোগ দেন জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘে। ১৯৬৯ সালে ফাজিল পাস করেন। খুলনার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৭১ সালে কামিল পরীক্ষা দিলেও সে বছরের পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়ায় পরের বছর আবারও পরীক্ষা দেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ থেকে এম এ পাস করেন সাখাওয়াত। স্বাধীনতার পরপরই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে ১৯৮১ সালে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল (এজি) অফিসে চাকরি নেন সাখাওয়াত।

জামায়াতে ইসলামীর রোকন সাখাওয়াত হোসেন ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে যশোর-৬ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। জামায়াতের সঙ্গে বনিবনা না হলে তিনি জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। বিএনপির টিকিট নিয়ে ১৯৯৬ সালে আবারও সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে সাখাওয়াত যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও যশোর-৬ আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

মামলা প্রক্রিয়া: ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাখাওয়াতসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৫ সালের ১৮ জুন প্রসিকিউশন এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। গতবছর ৮ সেপ্টেম্বর আদালত নয়জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়। অভিযোগের উপাদান না পাওয়ায় তিনজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছর ২৩ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে নয় জনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্য ও জেরার কার্যক্রম। প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় মোট ১৭ জন সাক্ষ্য দেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলেন না।

দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ১৪ জুলাই আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে। প্রসিকিউশনের পক্ষে মামলার শুনানি করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। তার সঙ্গে ছিলেন রেজিয়া সুলতানা চমন। গ্রেপ্তার সাখাওয়াত ও বিল্লাল হোসেন বিশ্বাসের পক্ষে আব্দুস সাত্তার পালোয়ান এবং পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও কুতুব উদ্দিন আহমেদ মামলাটিতে লড়েন।

মিলন শেখকে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি দেয়ার নির্দেশ

রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌশলী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল মালেক সরদর, মিলন শেখ এবং আশুরা খাতুন যে আত্মত্যাগ করেছেন সেজন্য তাদের স্বীকৃতি দেয়া দরকার বলে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন।

আব্দুল মালেক সরদারের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, একজন ১০-১২ বছরের শিশুকে নির্মমভাব হত্যা করা হয়েছে।

মিলন শেখকে বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এই মিলন শেখ যিনি যুদ্ধে অনেক অবদান রেখেছেন তাকে যদি ভিক্ষা করতে হয় সেক্ষেত্রে সরকার এবং জাতি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। সেজন্য ট্রাইব্যুনাল মিলন শেখের ব্যাপারে কিছু করতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, রায়ে বলা হয়েছে, এই মামলার আসামিরা মানবতার শত্রু। শুধু তারা নয় যারা এ ধরনের অপরাধ করেছে তারা সবাই মানবতার শত্রু।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমরা এই রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করছি। রায়ে কেশবপুরসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে, বিচারপ্রার্থীরাও শান্তি পাবে।

রাজনৈতিক কারণে সাখাওয়াতকে মামলায় জড়ানো হয়েছে

রায়ের পর সাখাওয়াতের আইনজীবী আব্দুস সত্তার পাহলান বলেন, মাননীয় ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনকে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে রায় দিয়েছেন। কিন্তু প্রসিকিউশন কোনো দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি যে, তিনি গ্রাম, থানা কিংবা জেলার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। একমাত্র রাজনৈতিক কারণেই মাওলানা সাখাওয়াতকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/ ১০


শেয়ার করুন