সহিংসতার আগাম বার্তা আমলে নেয়নি ইসি

election_commition_75614সিটিএন ডেস্ক:
নির্বাচন কমিশনকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতার আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপরিশও করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সুপারিশই আমলে নেয়নি ইসি। সুপারিশ মতো কার্যকর তেমন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। ফলে গত দু’ধাপের নির্বাচনেই তা-ব চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। গুলি, বোমা, সংঘর্ষ, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোটের ঘটনা ঘটেছে ব্যাপক হারে। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ।
তৃণমূলের এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উৎসবের আবহ তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এটি আতংক ও শোকের অপর নামে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা আলাদাভাবে ইসির কাছে ভোটের নিরাপত্তার দিক তুলে ধরে। এতে তারা ভোটের দিন, এর আগে ও পরে সহিংস ঘটনার বার্তা দেয়। কমিশনে অনুষ্ঠিত আইনশৃংখলা সংক্রান্ত বৈঠকের কার্যবিবরণীতেও বিষয়টি উঠে আসে। কাগজপত্রে সব ঠিক থাকলেও গোয়েন্দা সুপারিশ অনুযায়ী তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এতে প্রথম ধাপের ভোটের দিন ১০ জন। এর আগে-পরে আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন সহিংসতায় মারা যান ১০ জন। এর পরদিন এক এবং ভোটের আগে একজনের মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গুটিকয়েক ব্যক্তির আকস্মিক হিংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে কিছু কিছু এলাকায় সহিংস ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় নির্বাচনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এলাকাগত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনায় কমিশন দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিয়েছে। আগামী নির্বাচনে কিভাবে এসব ঘটনা কমিয়ে আনা যায়, সেই প্রস্তুতি চলছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে সহিংসতা রোধে ইসির প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সহিংসতা এড়িয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের স্বার্থে আইনশৃংখলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য নিয়োজিত করেছে। নির্বাচনী বরাদ্দের দুই তৃতীয়াংশ আইনশৃংখলা রক্ষা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। প্রার্থী ও ভোটারদের সহিঞ্চু আচরণ করতে হবে।
গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- ছোট পরিসরে বেশি ধাপে নির্বাচন করা, পার্বত্য জেলাগুলোতে একসঙ্গে নির্বাচন দেয়া, সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া, নির্বাচন আচরণবিধি লংঘনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, পর্যাপ্ত আইনশৃংখলা বাহিনী মোতায়েন, চিহ্নিত অস্ত্রবাজ-সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় তারা নিজেদের মধ্যে অথবা অন্য দলের প্রার্থীর সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হতে পারে। তৃণমূলের এ নির্বাচনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব পাড়া থেকে দলীয় পর্যায়ে চলে আসতে পারে বলে জানিয়েছিল সংস্থাগুলো।
সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনের আগে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে কমিশন। ওই বৈঠকে সহিংসতার আভাস দিয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি থেকে জানানো হয়েছিল, প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। প্রভাবশালী দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় তারা নিজেদের মধ্যে অথবা অন্য দলের প্রার্থীর সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হতে পারে। প্রার্থীদের মধ্যে গ-গোলের সুযোগ যাতে কেউ না নিতে পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিল, নির্বাচনসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পাড়া হতে দলীয় পর্যায়ে চলে এসেছে, চ্যালেঞ্জ এখানেই। কালো টাকা, আচরণবিধি লংঘন ও পরস্পরবিরোধী অভিযোগ নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিল, যেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন সেখানের অবস্থা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
নির্বাচনসংশ্লিষ্টরা জানান, সহিংসতার আগাম সতর্কবার্তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর কার্যকর উদ্যোগের অভাবে অনিয়ম ও সহিংস ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষা, ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষ, জুনে রমজানসহ নানা কারণ দেখিয়ে ছয় ধাপে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি ধাপে ছয়-সাত শতাধিক ইউপি রয়েছে। ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কমিশন সচিবালয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ব্যাপক হারে আচরণবিধি লংঘন করে সহিংস ঘটনা ঘটে। ওই সব ঘটনায় দু-একটি বাদে বাকিগুলোতে কমিশন দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভোট গ্রহণের ওপর। এছাড়া ধাপে ধাপে পার্বত্য এলাকায় একাধিক নির্বাচন করতে গিয়েও বিপাকে পড়েছে কমিশন। স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনের বাধার মুখে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বড় দলগুলোর প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে কমিশন রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের ৫৩টি ইউপির তফসিল বাতিল করে ষষ্ঠ ধাপে স্থানান্তর করেছে। তারা আরও জানান, নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন সত্ত্বেও উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও পক্ষভুক্ত হয়ে পড়ছেন। আবার কখনও তারা নিজেরাই হামলার শিকার হচ্ছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রচারণার শুরু থেকে সহিংস ঘটনা ঘটে আসছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা প্রাণহানি ৪০ ছুঁই ছুঁই। কমিশন প্রথম থেকেই শক্ত পদক্ষেপ নিলে ভোট গ্রহণে সহিংস ঘটনা কমে আসত। তিনি বলেন, সহিংসতার মূল কারণ হচ্ছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে সহিংসতা বেশি হচ্ছে। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল না হলে, দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলে সহিংসতা বেসামাল পরিস্থিতিতে পৌঁছত। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার বদলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। প্রার্থীরা মনে করছে জনপ্রতিনিধি হলেই বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যায়। এ কারণে জয় পেতে তারা সহিংস আচরণ করছে। অপরদিকে নির্বাচন কমিশন এসব ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়নি। তারাও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। যুগান্তর


শেয়ার করুন