সন্তানকে সময় দিতেই হবে

uiyyyঐশীর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। কী জীবন ছিল তার। আর এখন কী হয়ে গেল! কখনো কি সে ভেবেছিল লোহার গারদে কাটবে তার জীবন। অথচ এটাই এখন নির্মম বাস্তবতা। হ্যাঁ, সেই ঐশীর কথাই বলছি, বাবা-মাকে হত্যার দায়ে যার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশীর বয়স ছিল ১৯ বছর। কষ্ট হচ্ছে কুমিল্লার সেই কিশোরটির জন্যও, কুমিল্লার ব্রিটেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহজাদা ইসলাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যার জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন তাকে থাকতে হবে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে।

অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এই দুজনের জীবন আর দশটা স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতো হওয়াই উচিত ছিল। ঐশী বা ওই কিশোরের এই পরিণতির জন্য আসলে দায়ী কে? তারা নিজে, না তাদের বাবা-মা, নাকি এই ঘুণে ধরা সমাজ, নাকি রাষ্ট্র?

পত্রপত্রিকা পড়ে যেটুকু ধারণা পাই, বিলাসব্যসনেই কাটছিল পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের বড় সন্তান ঐশী রহমানের জীবন। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ত। কখন যে সে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ল, মাদকে আসক্ত হলো আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করা শুরু করল, তা বাবা-মা প্রথমে টেরই পাননি। ইয়াবা সেবন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘোরাফেরা, গভীর রাতে বাড়ি ফেরা—এই ছিল ঐশীর জীবন। যখন টের পেলেন বাবা-মা, তখন তাঁরা মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতে চাইলেন। আর এটাই বোধ হয় কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জন্য।

‘বাবা ছিল ব্যাকডেটেড। আমার সঙ্গে তার ম্যাচ করত না। আর মা আমার সব কথাই বাবাকে বলে দিত। কোনো ফ্রিডম ছিল না। আমি বোর হয়ে গেছিলাম।’ বাবা-মাকে হত্যার পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী রহমান এভাবেই তার অনুভূতি প্রকাশ করে। কী ভয়ংকর কথা! বাবা-মা সেকেলে ছিলেন বলে, তাঁরা শাসন করতেন বলে একবারে মেরেই ফেলল!

৩০ মে প্রথম আলোর খবর, কুমিল্লার ব্রিটেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহজাদা ইসলাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই কিশোরের বাড়ি লাকসাম পৌরসভায়। সে ওই এলাকার এক প্রবাসীর ছেলে। মাকে নিয়ে সে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়লেও তার বয়স অন্তত ১৬ বছর। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে কুমিল্লার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে বের করে দেয়। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। এই বয়সেই নিজ নামে সে গড়ে তুলেছে একটি বাহিনী! পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কিশোরটির বাবা প্রবাসে থাকেন। তাহলে কি বাবার অনুপস্থিতি আর শাসনের অভাবে সে এতটা দুর্বিনীত হয়ে উঠেছিল?

তাহলে বাবা-মায়েরা কী করবেন? সন্তানদের শাসন করবেন, না তাদের ছেড়ে দেবেন? সন্তানকে শাসন না করলে সে বখে যাবে, আর শাসন করতে গেলে তো ঐশীর মতো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে! ঐশীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকেরাই প্রাথমিক শিক্ষক। এ কারণে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং তাদের উপযুক্ত সময় দেওয়া।

এর আগে গত ২৮ মে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হাইকোর্ট শিশুদের প্রতি যত্নশীল হতে উচ্চবিত্ত পরিবারের মা-বাবাদের প্রতি ‘অবাঞ্ছিত জীবনযাপন’ পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। হাইকোর্ট আরও বলেছেন, সব অভিভাবকের উচিত তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন বই পড়তে উৎসাহ জোগানো, যাতে সেই পড়া তাদের ভুল পথে পা বাড়ানো রোধ করতে পারে। শিশুদের ভুল পথ থেকে প্রতিহত করতে চাই তাদের ভালো পরিবেশে সম্পৃক্ত করা। বিশেষ করে পারিবারিক পরিবেশও শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আদালতের এমন আহ্বানের পেছনে কারণ হচ্ছে, আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে দেখেছেন ব্লগার রাজীব হায়দারকে যারা হত্যা করেছে, তারা সবাই মেধাবী ছাত্র। যারা তাদের মেধা দেশের উন্নয়নে প্রয়োগ করতে পারত, তারা কিনা খুনের মতো একটি জঘন্য কাণ্ডে নিজেদের জড়িয়েছে। সত্যিই আফসোস হয় এসব মেধাবীর জন্য।

আদালতের এই আহ্বানকে দেশের প্রত্যেক বাবা-মা ও অভিভাবকের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। একটি ছেলে বা মেয়েকে যদি ছোটবেলা থেকেই সঠিক আদর্শ আর শিক্ষা দিয়ে বড় করা যায়, তাহলে তার বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম থাকে। এটা ঠিক যে এখনকার ব্যস্ত নাগরিক জীবনে বাবা-মায়ের পক্ষে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। যে পরিবারে বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী, তাঁদের পক্ষে কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। চাকরি ছাড়া আরও নানা কাজে জড়িয়ে পড়তে হয় অনেককে। এমন বাস্তবতায় সন্তানকে দেওয়ার মতো সময় বের করতে পারেন না অনেকে।

কিন্তু পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে সন্তানকে সময় দেওয়ার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শুধু সময় নয়, গুণগত সময় দিতে হবে। এখানে হেলাফেলার আর কোনো সুযোগ নেই। অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সন্তানের দিকে নজর দিতে না পারলে যদি সন্তান বখে যায়, মাদকে আসক্ত বা সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এই অর্থ উপার্জনের তো কোনো মানে হয় না।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা সন্তানদের বিপথে যাওয়ার জন্য অনেক কারণকে দায়ী করেছেন। আসলে নষ্ট হওয়ার নানা উপকরণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এসবের কুপ্রভাব সন্তানের ওপর যাতে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার কাজটি বাবা–মাকেই করতে হবে। সন্তান কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তা দেখতে হবে।

আমরা অনেকেই এখন অল্প বয়সী সন্তানদের হাতে নানা প্রয়োজনে মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ তুলে দিচ্ছি। কিন্তু তারা সেসব নিয়ে কী করছে, তার কোনো খোঁজ রাখি না। এসব ব্যাপারে মা–বাবাকে তাদের চোখ–কান খোলা রাখতে হবে। শুধু তা–ই নয়, সন্তানদের বন্ধু হতে হবে। এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে সে আপনার কাছে কোনো কিছু না লুকায়। অতএব, আর দেরি নয়, আজই কাজে নেমে পড়ুন।

রোকেয়া রহমান

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।


শেয়ার করুন