কক্সবাজার

সদর-রামুতে টপসয়েল লুটছে ওরা ১৮ জন

ডেস্ক নিউজঃ

অভিযোগ দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছেনা ফসলি জমির মাটি বিক্রি। মাসিক আইনশৃংখলা মিটিং এ দেয়া চেয়ারম্যানদের তালিকা পড়ে আছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। হরদম অর্ধশত ডাম্পার লাগিয়ে ফসলি জমির মাটি উত্তোলন করে ইট ভাটাসহ নতুন ভিটে ভরাটে বিক্রি করা হচ্ছে। মানছেনা জরিমানা, আইন। প্রশাসনের নজরদারিতে ও থামানো যাচ্ছেনা মাটি বিক্রি। সকাল থেকে রাত কিংবা দিন সব সময় সড়কের উপর ৩০ টির মত মিনি ট্রাক মাটি ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। অনেকে মাটি কিনে ভরাট করছে বসতিভিটে। অনেকে আবার প্লট করে জায়গা বিক্রির জন্য ভরাট করে রাখছে।
সদরের পিএমখালী, ঝিলংজা, রামুর চাকমারকুলের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি বিরাণভূমিতে পরিনত হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার হেক্টর ফসলি জমির উপরিভাগ কেটে মাটি নিয়ে যাচ্ছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা করার পরও পুণরায় মাটি উত্তোলণ করছে উক্ত সিন্ডিকেট। পরিবেশ অধিদপ্তরের এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাড়ি চালকদের সাথে মাটি খেকোদের মাসোহারার মাধ্যমে চুক্তি থাকায় অভিযানের আগেই সকল তথ্য জেনে যাওয়ায় অভিযান ফলপ্রসু হচ্ছেনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। ফলে টপ সয়েল উত্তোলন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পিএমখালী ও ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাদা তালিকা প্রস্তুত করে ডাম্পার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ জানানোর পর কয়েক দফায় অভিযান চালালেও কৌশল পাল্টিয়ে রাতে মাটি উত্তোলন করায় বন্ধ হয়নি মাটি উত্তোলন। রামুর এসিল্যান্ডের অভিযান জরিমানা সত্ত্বেও চাকমারকুলের চিহ্নিত জিয়াবুল সওদাগরকে দশ বছরেও নিবারণ করতে পারেনি টপ সয়েল বিক্রি থেকে।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং ক্ষতিগ্রস্থ অন্তত ১০/১২ জন পিএমখালীর পাতলীর বাসিন্দা জানান, খরুলিয়ার চর এলাকা, উক্তরপাতলী, দক্ষিণ পাতলী, মুহসিনিয়াপাড়া, মাইজপাড়া, গোলারপাড়া, নয়াপাড়া,ডিকপাড়ার প্রায় ১ হাজার হেক্টর ফসলি জমি থেকে মাটিকেটে ৩০টির মত ডাম্পার করে মাটি বিক্রি করছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারা প্রশাসনের অভিযানের তোয়াক্ষা ও করেনা। উক্ত সিন্ডিকেট মাটি কাটার জন্য ডাম্পারের পাশাপাশি ব্যবহার করছে স্কেভেটর। বড় স্কেভেটর দিয়ে ফসলি জমির উপরিভাগ যেখানে ধানচাষের জন্য উপযোগি মাটি থাকে সেটি ধংস করে মাটি টানছে। এ সব মাটি ডাম্পার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রামু ও সদরের বেশ কয়েকটি ইটভাটায়।
পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবদুল্লাহ গত ২২ জানুয়ারি পরিষদের প্যাডে জুমছড়ি, পাতলী, মুহসিনিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ডাম্পার দিয়ে মাটি উত্তোলনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যৃবস্থা নিতে সদর ইউএনও বরাবর লিখিত আবেদন করেন। তালিকায় দক্ষিন নয়াপাড়ার আবদুল হাকিমের পুত্র নুরুল ইসলাম প্রকাশ ধলু,উত্তর পাতলীর আবুল হোসেনের পুত্র আবদুল খালেক,জাফর আলমের পুত্র আবদুর রহিম এবং মধ্যম নয়াপাড়ার মৃত আবু বক্কর এর নুরুল হুদা ও শামসুল আলমের নাম রয়েছে।
পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল্লাহ জানান আমার ইউনিয়নে দীর্ঘদিন যাবৎ টপসয়েল উত্তোলন করে আসছে একটি শক্তিশালীচক্র। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে নুরুল হুদা এবং শামসুল আলম দুই ভাই। এছাড়াও পাতলী, নয়াপাড়া, ডিকপাড়ায় কয়েকটি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। নুরুল হুদা এবং শামসুল আলমকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার মাটি উত্তোলনের বিষয়ে বারণ করা হলেও তারা কর্ণপাত করে না অজ্ঞাত শক্তির প্রভাবে। তারা মানুষকে মানুষ মনে করে না। তাদের বিষয়ে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়কে অবহিত করেছি। আশা করি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পিএমখালীকে বাঁচাতে মাটি রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
অপরদিকে ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান গত ৩০ জানুয়ারি সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বরাবরে একটি তালিকা প্রেরণ করেন ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য। তালিকায় পশ্চিম চাকমারকুলের মৃত নুর আহমদের পুত্র নুরুল আলম এবং খরুলিয়া সিকদারপাড়ার সিরাজুল হকের পুত্র ফরিদুজ্জামান জুয়েলের নাম রয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোন অভিযান পরিচালনা হয়নি।
পিএমখালীর পাতলী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন ও খরুলিয়ার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গত বছর তৎকালিন সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমির নেতৃত্বে মাটি উত্তোলনকারি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। সে সময় কিছু দিন মাটি উত্তোলন বন্ধ ছিল। এবছর পুণরায় রাত ৮ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত ফসলী জমি থেকে মাটি টানছে উক্ত সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের অন্যতম হল খরুলিয়ার বাদশা মিয়ার পুত্র ছোটন , পিএমখালীর ডিকপাড়ার আবদুল হাকিমের পুত্র নুরুল ইসলাম প্রকাশ ধলু, নয়াপাড়ার মোঃ হোসেনের পুত্র আবদুল্লাহ, নয়াপাড়ার শামসুল হুদা,চাকমারকুলের কবির আহমদের পুত্র আলমগীর, পাতলী রশিদ মেম্বারের পুত্র ওবাইদুল হক,উত্তর পাতলীর জাফর আলমের পুত্র আবদুর রহিমের, খরুলিয়ার জাহাঙ্গীর আলম, ঝিলংজার মুক্তারকুলের মোহাম্মদ আমিন,খরুলিয়ার মাস্টার পাড়ার সরওয়ার আলমের পুত্র মিসবাহ ,মাষ্টার পাড়ার মোঃ ফারুক, পাতলী মিয়াজীপাড়ার সিরাজুল্লাহর পুত্র তাজউদিদনসহ অন্তত ডজন মাটি খেকোর কয়েকজন পাতি নেতা সরকার দলের নাম বিক্রি করে মাটি টানছে। দৈনিক ৩০ টির মত ডাম্পার কৌশলে রাত ১১টার পর থেকে মাটি টানা শুরু করে। সারা রাত চলে মাটি বিক্রি। দৈনিক ১০ লাখ টাকার মত মাটি বিক্রি করে বলে স্থানীয়দের ধারনা। দেড় হাজার হেক্টর জমিতে কোন ফসল না থাকায় ইচ্ছেমত মাটি কাটছে উক্ত সিন্ডিকেট। ফলে পরিবেশ বির্পযয়ের পাশাপাশি পুরো জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটি উত্তোলন বন্ধ না হলে আগামি মওসুমে কাংখিত ফলন হবেনা বলে জানান কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা।
ফসলি জমি থেকে মাটি উত্তোলন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ধংসকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীসা বলেন- আমরা চিহ্নিতদের বিষয়ে শীগ্রই ব্যবস্থা নিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।গত সপ্তাহেও সদরের পিএমখালীতে অভিযান চালিয়ে স্কেভেটরের ২টি ব্যাটারি খুলে নিয়ে এসেছেন সদরের এসিল্যান্ড। এখানে জমির মালিকদের ও দোষ রয়েছে। তারা লিখিত কোন অভিযোগ দেয়না ফলে আমাদের অভিযান চালাতে কষ্ট হয়ে যায়। ১ মাসের ব্যবধানে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে বলেও তিনি জানান। এবার তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে অভিযান জোরদারের পরিকল্পনা করেছেন বলে জানান।
এদিকে গতকাল জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে স্থানীয় সরকার দিবসের আলোচনা সভায় জনপ্রতিনিধিরা জমি থেকে মাটি উত্তোলনের বিষয়টি অবহিত করেন। এলাকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানান। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগন তাদের দুর্ভোগের কথা উপস্থাপন করেন এবং টপ সয়েল উত্তোলনে জড়িতরা প্রভাবশালী এবং আইনকে তোয়াক্কা করে না বলে মতামত ব্যক্ত করেন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন।
নির্বিচারে জমি থেকে মাটি উত্তোলন এবং ইটভাটাইয় বিক্রির বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা জানতে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি উত্তরে বলেন- আমাদের অনেকগুলো রামু এবং সদর উপজেলায় এনফোর্সমেন্ট হয়েছে । জড়িতদের কিছু জরিমানাও আমরা করেছি। তবে রাতারাতি তো বন্ধ করা যাবে না। আমাদের আইনি কিছু জটিলতা বাধ্যবাধকতা রয়েছে যার কারণে অভিযানে যেতে অনুমোদন নিতে হয়। আমরা চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতকে জানিয়ে চিহ্নিত মাটি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে জানিয়েছি। চট্টগ্রাম থেকে অনুমতি পেলে অভিযানে নামবো।
জমির টপ সয়েল উত্তোলন করায় প্রতি বছরই কমছে ধানের উৎপাদন। র্উবরাশক্তি কমে যাওয়ায় এবং পরিবেশ বির্পযয়ের কারনে প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রায় ধংসের পথে। পাশাপাশি চিহ্নিত ১৮ জনের সিন্ডিকেটকে সামান্য জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়ার কারনে লগু শাস্তি হওয়ায় জমির মাটি কাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ বির্পযয়রোধে এবং ফসলি জমিকে রক্ষায় ১৮ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সুদৃষ্টি কামনা করছেন ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন।


শেয়ার করুন