সংরক্ষিত বনে বাফুফের ফুটবল প্রশিক্ষণ একাডেমি

ডেইলি স্টারঃ
কক্সবাজারের জঙ্গল খুনিয়াপালং সংরক্ষিত বনে একটি আবাসিক প্রশিক্ষণ একাডেমি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সরকার ইতোমধ্যে সংরক্ষিত বনের ২০ একর জায়গা ডি-রিজার্ভ করে বাফুফেকে বরাদ্দ দিয়েছে।

একাডেমি স্থাপনে কাটা পড়বে কক্সবাজারের রামু উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এই বনের প্রায় ৩০ হাজার ছোট বড় গাছ। এই বন আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট আইইউসিএনর তালিকাভুক্ত মহাবিপদাপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসভূমি। এছাড়া এ বনে হরিণ, বন্যশুকর, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও পাখি রয়েছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সরওয়ার আলম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ডি-রিজার্ভের গেজেট নোটিফিকেশনের পর গত ৪ জুলাই তারা বাফুফেকে বনভূমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি এর বেশি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

দেশে বনভূমির অপ্রতুলতা রয়েছে। এরপরও বনের জায়গায় কেন প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রশ্ন করা হলে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সরকারের কাছে এ জমিটি চেয়েছেন। সরকার তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটা তাদেরকে দিয়েছে। ওই বনে বড় কোনো গাছ নেই। বন যেমনটা আছে ও রকম রাখা হবে। তারা ফিফাকে বনের ভূমির কাগজপত্র পাঠিয়েছেন। ২০২৩ সালের মধ্যে এটার নির্মাণ সম্পন্ন হবে।

দেশে বনভূমির পরিমাণ কমছে, এমন বাস্তবতায় বাফুফেকে সংরক্ষিত বনের জায়গা দেওয়া কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বনভূমি যেভাবে আছে ওভাবে সংরক্ষণের শর্তে তাদের বনের জমি দেওয়া হয়েছে।’

এ একাডেমি করতে ৩০ হাজার গাছ কাটা যাবে, তাহলে সংরক্ষণ কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনের ক্ষতি যাতে ন্যূনতম রাখা হয় সে জন্য তাদের বলা হয়েছে। আর বনের জায়গা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না বলে বনের জায়গা দেওয়া হয়েছে। যদি বিকল্প থাকতো তারা দিতেন না।

এমন সময়ে এ বনভূমি দেওয়া হচ্ছে যখন কক্সবাজারের বনভূমি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়নে ৭ হাজার একর বনভূমি বেহাত হয়ে গেছে। এ ছাড়া, প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে প্রায় ৫০ হাজার একরের মতো বনভূমি। কক্সবাজারের বন বিভাগের ২ ডিভিশন মিলে বনভূমি রয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৫৭ একর।

গত ৪ জুলাই এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বন বিভাগ বাফুফেকে বনাঞ্চলের ডি-রিজার্ভকৃত অংশটি বুঝিয়ে দিয়েছে। আবাসিক প্রশিক্ষণ একাডেমির অংশ হিসেবে এখানে দুটি ফুটবল মাঠ, একটি ৪ তলা ডরমিটরি ও একটি মেডিক্যাল সেন্টার নির্মাণ করা হবে। এটি নির্মাণের পুরো তহবিল দিচ্ছে ফিফা।

সমতলে এ একাডেমি নির্মাণ করার জন্য যথেষ্ট ভূমি থাকলেও বাফুফে এ বনকে নির্বাচন করেছে। জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থে সরকার চাইলে বন আইন-১৯২৭ এর ২৭ ধারায় বনভূমি ডি-রিজার্ভ করতে পারে। তবে সেটা হতে জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থে।

গত ৮ জুলাই সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে বনটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেখানে বন বিভাগের ২০ বছর আগে সৃজন করা বাগান রয়েছে। এছাড়া, প্রচুর ছোট-বড় গাছ দেখা গেছে বনে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ বনে প্রায় ৫০টি মতো হাতির একটা পাল আছে। এই স্থাপনা নির্মাণ করা হলে হাতির পাল বিপদে পড়বে। হাতির লোকালয়ে আক্রমণ করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে।

বনভূমি দেখাশুনা করার জন্য সরকার কর্তৃক গেজেটেড কমিটির সহব্যবস্থাপনা কমিটির একজন স্থানীয় বাসিন্দা আয়াসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এ বনে হাতির বিচরণ আছে। স্থাপনা হলে ওদের অসুবিধা হবে, ভবিষ্যতে এখানে কোনো বন থাকবে না। বন বিভাগের তথ্য মতে, ডি-রিজার্ভ করা; দখল-বেদখল; লিজ দেওয়া; বনউজাড়িকরণ—এসব কারণে হাতির বিচরণক্ষেত্র দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে হাতি-মানুষের সংঘাত বাড়ছে।’

গত বছরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ এ ২০৩০ সালের মধ্যে বনউজাড়িকরণ বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। এছাড়া বনাঞ্চল রক্ষায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র বনাঞ্চল, জীব বৈচিত্র্যসহ সার্বিক পরিবেশ বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এভাবে বনভূমি বাফুফেকে দেওয়াটা উচ্চ আদালতের রায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কক্সবাজারের কোনো বনভূমি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে বরাদ্দ না দিতে।’

‘কিন্তু এখন সরকার ভাবছে আদালতের আদেশ না মানলেও চলবে। তারা কোত্থেকে এ কনফিডেন্স পায়,’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘বন আইনে সরকারের যে ডি-রিজার্ভ করার সুযোগ রাখা হয়েছিল সেটা ১৯২৭ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায়। আজকের বাস্তবতা এ সুযোগ রাখার পক্ষে না, এটা বাতিল করতে হবে।’

সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফরেস্টার্স বাংলাদেশের সভাপতি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সবাই এখন কক্সবাজারের বনভূমি চায়। এভাবে বনভূমি দেওয়াতে বন্যপ্রাণীর চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। যার ফলে হাতির আর মানুষের সংঘাত বাড়ছে। যদি সবাইকে বনের জায়গা দেওয়া হয় তাহলে কক্সবাজারে বনভূমি বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কক্সবাজারের বনের জায়গা নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।’


শেয়ার করুন