লেখাপড়ার সদর অন্দর

সা য যা দ কা দি র

বইয়ের পাঠক নেই, এমনকি যাঁরা লেখক তাঁরাও পাঠক নন- এমন সব দুঃখ হতাশা

সমালোচনা শুনি সারা বছর, তারপর ফেব্রুয়ারি আসতেই রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
থেকে শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত গোটা রমনা এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে সাহিত্য-সংস্কৃতির
নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনে। এবার হরতাল, অবরোধ ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে
সমাগম তেমন জমজমাট না থাকলেও কবিতা উৎসব, নাট্য অনুষ্ঠান, শিল্প প্রদর্শনী,
সঙ্গীতের আসর, গ্রন্থমেলাসহ বহু বিচিত্র বর্ণাঢ্য প্রাণচাঞ্চল্য যথারীতি দেখা গেছে এই
ঐতিহ্যিক বলয়ে। এমন আয়োজন অবশ্য হয়ে থাকে সারা দেশেই। শহরে, পাড়ায়, গ্রামে।
তবুও ওই সংস্কৃতি বলয়ের আয়োজন যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে। এখানে দেশের এ-প্রান্ত
ও-প্রান্ত থেকে আসেন শিল্পী-সাহিত্যিক সবাই। প্রবাসী লেখকেরাও আসেন এ সময়। নানা
দেশ থেকে গুণীজনেরা আসেন বিভিন্ন আয়োজন-অনুষ্ঠানে। নবীন-প্রবীণ সবার এক
মিলনমেলা হয়ে ওঠে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস। আর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাংলা
একাডেমির ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এ মেলাতেই আসে বছরের সব নতুন বই, আর
বলতে গেলে সারা বছরের বই বিক্রিও এই সময়ই। কাজেই লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের
এ মেলায় নতুনত্বই প্রধান। এখানে আত্মপ্রকাশ করেন নতুন লেখক, চমক জাগান নতুন
প্রকাশক। নতুন সৃষ্টি হয়েছে পড়ার নেশা- ভিড় করেন সেই পাঠকেরাও।

বই পড়া নিয়ে বিভিন্ন আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ পাড়ি দিয়ে
এসেছে দীর্ঘ পথ। এ পথে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, সংযোজন-বিযোজন হয়েছে’ কিন্তু এর
আকর্ষণ আছে তেমনই। এবারো উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল নতুন কিছুর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
এলাকায় গত বছরের চেয়ে সম্প্রসারিত হয়েছিল মেলা। চেষ্টা হয়েছে মেলাকে প্রকৃত
প্রকাশকদের মেলায় পরিণত করার। নানা কিসিমের সংগঠন, সমিতি, সংস্থাকে আগের
মতো স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি এবার।

তবে বইয়ের দাম দিনে-দিনে বেড়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বলতে গেলে সাধারণ
ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এখন। প্রকাশকেরা বলেন, মুদ্রণ সামগ্রী-সরঞ্জামে সরকার
যদি কর হ্রাস না করে তবে দাম এমন চড়তেই থাকবে। এ ছাড়া অডিও-ভিজুয়াল মিডিয়ার
ক্রমবিস্তৃতি বইয়ের জগৎকে ফেলেছে চাহিদার সঙ্কটে। আগের মতো আর পাঠক-ক্রেতা নেই
বইয়ের। এ অবস্থায় প্রকাশনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে উঠেছে
অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখা দরকার, বই মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ সঙ্গী আমাদের
জীবনের বিকাশে রাখে অন্যতম প্রধান উৎস-ভূমিকা।

বইয়ের পাঠক নেই- এমন হতাশার পাশাপাশি কাগজে ছাপা বই আর চলবে না- এমন
হুমকি জোরেশেরে শুনছি কয়েক দশক ধরে। এর প্রমাণও পাচ্ছি ইদানীং। দেখতে-দেখতে
উধাও হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বইয়ের দোকান, পাততাড়ি গোটাচ্ছে একের পর এক
নামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। পল্টনের স্টেডিয়ামে, গুলিস্তান ভবনে, বাহাদুর শাহ পার্কের দক্ষিণ
থেকে পশ্চিমের ভবনগুলোতে, বিজয়নগরে, এমনকি তেজগাঁও রেলস্টেশনেও ছিল কত
লোভনীয় বইয়ের দোকান- এখন আর সে কথা বিশ্বাস করবেন না কেউই। কিছু দিন পরে
নিউ মার্কেট, আজিজ সুপার মারকেট সম্পর্কেও হয়তো বলতে হবে একই কথা। এ ছাড়া
যেসব দোকান বিশেষভাবে পাঠ্য বই-ই শুধু বিক্রি করত, অল্প কিছু ‘অপাঠ্য’ বইও রাখত
সেলফের এক পাশে, সেগুলোরও বেশির ভাগ নেই হয়ে গেছে রাতারাতি। না হয়ে
উপায়ইবা কী? প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলের সব বই সরকার সরবরাহ করে
বিনামূল্যে, আর নোট সাজেশন গাইড ইত্যাদি যাবতীয় সহায়ক বই নিষিদ্ধ- তারপর আর
বইয়ের ব্যবসা থাকে নাকি! আর বইয়ের দামও বেড়ে গেছে হু-হু করে, চলে গেছে বেশির
ভাগ বইপাগলের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ জন্য প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব
সামগ্রী-সরঞ্জামের ওপর করের বোঝা কমাতে দাবিদাওয়া পেশ ও দেনদরবার করা হয়েছে
বহুবার, কিন্তু একের পর এক অনেক সরকার গেলেও কোনো সরকারই কানে তোলেনি
পাঠক-প্রকাশকদের এ সব কথা। এর মধ্যেই এসে পড়ে ভাষাশহীদদের স্মৃতিবাহী
ফেব্রুয়ারি মাস, আর শুরু হয় স্থায়িত্বের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা বাংলা
একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ফেব্রুয়ারি এলেই প্রকাশক পাঠক লেখক
সবাই ভিড় জমান এ মেলা চত্বরে। প্রথম দিন থেকেই প্রতিদিন আসে নতুন-নতুন বই।
সেসবের খোঁজ করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা হয় পাঠক-ক্রেতাদের। আর বই নেড়েচেড়ে
দেখে কেনার অভ্যাস যাঁদের, মেলায় বই কিনতে গিয়ে বেশ মুশকিলেই পড়েন তাঁরা। কারণ
ভিড়ের মধ্যে বই দেখতে দাঁড়ানোটাও কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়। এর কারণ আর অন্য
কিছু নয়, অল্প জায়গায় অধিক স্টল ধরানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। তাতে এমনি ঘিঞ্জি হয়ে
ওঠে মেলা। তবে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারিত হওয়ায় পাল্টে গেছে সে
পরিস্থিতি।

শুরু থেকেই এ ছিল অন্যরকম মেলা। তখন একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কবিতা পাঠের আসর
বসাত বাংলা একাডেমি। কবিতা পড়তেন ১০০ কবি, তারপর ১৫০, ২০০, ৩০০-৩৫০
কবিও পড়েছেন। নগ্নপদ প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে কবি-সাহিত্যিকেরা
আসতেন ওই আসরে যোগ দিতে। কবিতা শুনতে, কবিদের দেখতেও আসতেন অনেক
উৎসাহী। তখন একুশে সঙ্কলনের যুগ। পথে-পথে যাঁরা ফেরি করে সঙ্কলন বিলাতেন বা
বিক্রি করতেন তাঁরাও আসতেন ওই অনুষ্ঠানে। বাংলা একাডেমি চত্বরের এক পাশে
অবিক্রীত সঙ্কলন নিয়ে বসতেন তাঁরা, বিক্রি করতেন সেগুলো। এভাবে যায় কয়েক বছর।
তারপর সঙ্কলনগুলোর সঙ্গে আসতে থাকে পাঁচ-দশটি নতুন কবিতার বই। পরে রাজনৈতিক
বিষয়াদির বই। শেষে একদিন ওই সময়ের সাড়া জাগানো প্রকাশক ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জন
সাহা যোগ দেন বইপত্র নিয়ে। শুরু হয় মেলার চিন্তা, তারপর আয়োজন। এক দিন থেকে
এক সপ্তাহ, তারপর এক পক্ষ, এখন পুরো এক মাস। এক সময় ছিল বইয়ের স্টলের প্রায়
সমানসংখ্যক ফুচকা, চটপটি ও অন্যান্য খাবারের দোকান; আর প্রকাশকদের চেয়ে সংগঠন
সমিতি সংস্থা প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি জায়গা বরাদ্দ। একসময় ক্যাসেটের দোকানগুলোর
মাইক কান ঝালাপালা করে দিত সবার। অপ্রকাশকদের মতো অলেখকেরাও দাপট
দেখিয়েছেন মেলায়। নিজেদের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে কুড়িয়েছেন বাহবা। সময়ের
সঙ্গে-সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছু, কিন্তু অনিয়ম কি গেছে একেবারে? এখনো অভিযোগ
শোনা যায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে, দলীয় রাজনীতির সিনাজুরি সম্পর্কে।

মেলা বদলে দিয়েছে গোটা বইয়ের ব্যবসা। পাল্টে দিয়েছে রুচি ও অভ্যাসও। বইয়ের
বেচাকেনা প্রকাশ-প্রচার সব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এই এক ফেব্রুয়ারি মাসে। বই লেখা,
প্রকাশ, কেনাকাটা ও অন্যান্য কার্যক্রম চলে এই একটি মাসকে সামনে রেখে। এর মধ্যে
ঢুকে পড়েছে শৌখিন লেখক ও শিকারি প্রকাশক। সংখ্যায় এরা কম নয়। বলা হয়, মেলায়
আসা বইয়ের বেশির ভাগই শৌখিনদের। তারা বই ছাপে নিজের টাকায়, শিকারিরা তা
ছেপে হাজির করে মেলায়। তারপর সেসব বইয়ের আর কোনো খোঁজ থাকে না কোথাও।
শিকারিরা বই ছাপে ফরমা অনুযায়ী বিভিন্ন রেটে। সে রেট পাঁচ হাজার টাকা থেকে
পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত। যে শৌখিন লেখকের টাকার জোর যত বেশি তার বইয়ের
জেল্লাই তত বেশি। এই শৌখিন ও শিকারিদের ব্যাপারে খুব বেশি দিন হেলাফেলা করা
যাবে না হয়তো। কারণ এসব লেনদেন নিয়ে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় মেলায়। অপ্রীতিকর
ঘটনাও ঘটে। কর্তৃপক্ষকে তাই প্রকৃত লেখক ও প্রকাশকের ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট
নীতি-নিয়ম করতেই হবে ভবিষ্যতে।

মেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে কিছু না কিছু। স্টল ভাঙাভাঙি ঘটে কোনো না
কোনো ঘটনার সূত্রে। আশির দশকে ঘটেছে বেশি। তখন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে চলেছে
ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এর পুরো আছর পড়েছিল মেলায়। কর্তৃপক্ষ ও সরকারের বিভিন্ন
এজেন্সি নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, কিন্তু দমিয়ে রাখা যায়নি গণবিক্ষোভ। কার্টুন,
কুশপুত্তলিকা, ক্যাসেট, বই- সবখানে ছিল প্রতিবাদ। এরশাদ সরকারের কৃষিমন্ত্রী কবি আবু
জাফর ওবায়দুল্লাহকে কবিতাপাঠের আসরের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ তরুণেরা।
এরশাদের কবিতা ছাপার দায়ে ভর্ৎসিত হয়েছেন দৈনিক বাংলা-বিচিত্রার সম্পাদক কবি
শামসুর রাহমান। এরশাদ-অনুরাগী কবিদের কেউই সাহস করতেন না মেলায় যাওয়ার।
তাঁদের একজন প্রহৃত হয়েছিলেন তরুণদের হাতে। এ ঘটনার সূত্রে গ্রেফতার হয়ে জেল
খেটেছেন এক কবি। নব্বইয়ের দশকেও ঘটেছে অনেক বিব্রতকর ঘটনা। রাজকুমারী হাসিনা
নামের একটি বই লেখার জন্য আক্রান্ত হয়েছিলেন কবি-চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার, ভেঙে
দেয়া হয়েছিল তাঁর পরিচালিত ‘উবিনিগ’ নামক প্রতিষ্ঠানের স্টল। তসলিমা নাসরিন লাঞ্ছিত
হয়েছিলেন লজ্জা ও শোধ নামের দু’টি বই লেখার দায়ে। কড়া পাহারার মধ্যে বিক্রি হয়েছে
মতিয়ুর রহমান রেন্টুর আমার ফাঁসি চাই বইটি। প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছেন হুমায়ুন
আজাদ, অভিজিৎ রায়। অঘটন ঘটেছে নানারকম আজব প্রচার-প্রচারণার সূত্রেও।

মেলায় বইয়ের প্রচারে লেখক-প্রকাশকেরা কেবল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেন না, নিজেরাও
দেন বিচিত্র সব উদ্ভাবনার পরিচয়। ফেনীর এক রাজনীতিক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন প্রেম
নিবেদন করে। সেই দুঃখ-বেদনা ভোলেননি তিনি। বই লিখে প্রকাশ করেছেন মনের সব
কথা। মেলায় সে বইয়ের প্রচার করেছেন নানাভাবে, তবে বিশাল বেলুনে প্রচার ছিল
নিঃসন্দেহে অভিনব। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন দু’জন
সুপরিচিত মডেলকে বর-কনে সাজিয়ে মেলায় ঘুরিয়ে। তাঁর উপন্যাসের কোনো এক
চরিত্রের বিয়েটা মেলায় ঘটানোর এক অদ্ভুত নাটক ছিল সেটি। দুলাল হাসান আরো
তোলপাড় তুলেছিলেন ছ’জন সুন্দরী মডেল এনে। তাঁর উপন্যাস রমণীবিলাস-এর নামের
ছ’টি বর্ণ হয়ে স্টলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ওই মডেলরা।

কলকাতার জনপ্রিয় লেখকদের বইগুলো কোনো অনুমতি ছাড়াই ছেপে থাকেন একশ্রেণীর
প্রকাশক। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, নিমাই ভট্টাচার্য
প্রমুখের পর এখন চলছে বাছাই করা বইয়ের পাইরেসি। এ পাইরেসি এমন যে, অনেক
সময় বোঝা যায় না বইটি আসল না নকল প্রকাশকের। মেলায় পাইরেটদের ঠেকাতে বাংলা
একাডেমি গত বছর নীতিমালা ও নিয়মাবলিতে উল্লেখ করেছে- ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলায়
অংশগ্রহণকারী প্রকাশকেরা কেবল বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বাংলাদেশের লেখকদের
মৌলিক, অনূদিত, সম্পাদিত, সঙ্কলিত বই বিক্রি করতে পারবেন।’ তবে তা সর্বত্র মান্য
হয়েছে কি?

এবার শোনা যাক অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্পর্কে কিছু মতামত। বিশেষ করে সায়েন্স
ফিকশন প্রকাশনার জন্য খ্যাতিমান ‘মুক্তচিন্তা’র শিহাব বাহাদুর বলেন, বাংলা একাডেমি
বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বইমেলা আহ্বান করে। ওই বিজ্ঞাপনে বাংলা একাডেমি
একটি বাক্য ব্যবহার করে, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত’। কিন্তু অমর একুশের গ্রন্থমেলা কি
শুধু বাংলা একাডেমি আয়োজন করে, না প্রকাশকেরাও এতে জড়িত? সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানের বিস্তৃততর এলাকায় মেলা সম্প্রসারিত হলেও এখনো তা দ্বিখণ্ডিত। এটি কেন করা
হয়েছে তা আমি অন্তত বুঝতে পারিনি। শিশুদের বই যেসব প্রকাশনা প্রকাশ করে, তারা কি
প্রকাশনা শিল্পের বাইরে? শিশুরা কি মেলায় আসে তাদের অভিভাবক ছাড়াই? বিভিন্ন
সংগঠন বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পায়। এবারো তাঁরা মূল আঙিনায় স্টল বরাদ্দ পেলেন।
সংগঠনের স্টল এই সুবাদে তাঁরা বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই, স্টল থেকে বিক্রির
সুবিধা ভোগ করেন। এটা লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু তাঁরাও বিভিন্ন
জায়গা থেকে বই নিয়ে বিক্রি করেছেন। সাধারণ মানুষদের অনেকে এবারো মেলায় উপস্থিত
হয়ে বুঝে উঠতে পারেননি মূল মেলা কোথায়। একাডেমি প্রাঙ্গণ বরাবরের মতো সাজিয়ে
রাখা হয়।

মানুষ একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢোকেন, বই কেনেন, আমরা যাঁরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আছি সে
খবরটা তাঁরা পান না। কারণ সামনের কোথাও সামান্যতম সাইন বোর্ড নেই যে, মেলা
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও হচ্ছে। বরং উল্টো সিকিউরিটির নামে বাঁশের বেড়া দিয়ে বাধা সৃষ্টি
করা হয়। রমনার কালী মন্দিরের গেট একমাত্র গেট যেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের
মেলায় আসা যায়। তাই মূল মেলা প্রাঙ্গণ কোথায় এটা বুঝতে পাঠকদের বেশ কিছু দিন
সময় চলে যায়।

তিনি আরো বলেন, মেলা চলে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এ কারণে প্রকাশকদের বিক্রি কমে
আসে। বর্তমানে রাত সাড়ে ৮টা কোনো রাত নয়। মূলত বেশির ভাগ মানুষ এ সময়
বেচাকেনায় ব্যস্ত থাকেন । ঠিক ব্যস্ততম বিক্রির সময় মেলার সময়সীমা হঠাৎ করেই শেষ
হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বই না কিনে বাসায় ফিরে যান খালি হাতে।

নবীন লেখকদের বই প্রকাশের জন্য খ্যাতিমান ‘সাহস পাবলিকেশনস্’-এর নাজমুল হুদা
রতন বলেন, প্রকাশকদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কর্তৃপক্ষ গ্রন্থমেলার পরিসর অনেক
বাড়িয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যদিও এক বছর আগে থেকেই সবাই জানে কখন মেলা
শুরু হবে, তবুও প্রতি বছরই শেষ মুহূর্তে এসে মেলার কাজ শুরু হয় এবং দায়সারাভাবে
স্টল তৈরি করে প্রকাশকদের ওপর বাড়তি চাপ চাপিয়ে দিয়ে বাংলা একাডেমি তার দায়িত্ব
শেষ করবে- এটা যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরিসর বেড়েছে কিন্তু আয়োজন
দেখে মনে হয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তে মেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে টেনে নেয়া
হয়েছে। মেলায় ঢোকার জন্য করা হয়েছে একটা মাত্র পথ। তা ছাড়া যদিও সৃজনশীল সব
প্রকাশকই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত কিন্তু তথ্যকেন্দ্র আর মোড়ক উন্মোচনের নির্ধারিত
জায়গা রয়ে গেল একাডেমি চত্বরে। ফলে প্রকাশকদের নতুন বই জমা দেয়া অথবা নতুন
বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য প্রায় ১ কিলোমিটার হাঁটতে হয়।

তিনি বলেন, এ দেশে কম্পিউটার বিক্রির জন্য আগারগাঁওয়ে আইডিবি ভবন এবং
এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার রয়েছে। জামা, কাপড়, জুতার জন্যও রয়েছে
বিশেষায়িত একাধিক মার্কেট। এমনকি ‘লাণ্ডি’ কিংবা স্টক লট বস্ত্রের জন্য আছে
‘বঙ্গবাজার’। মাছ-তরকারির জন্য তো বিশেষ সিটি করপোরেশন মার্কেট আছেই। কিন্তু
রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ত্রে সাহিত্যের মতো সুকুমার ও সৃজনশীল একটি শিল্পপণ্য
বাজারজাতকরণের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা মার্কেট। সেই প্রাচীনকালে
‘বাংলাবাজার’কে ঘিরে গড়ে ওঠা সাহিত্য মার্কেট আজকের বাস্তবতায় খুবই অস্বস্তিকর।

অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে যাঁরা কেবল যাতায়াতের অসুবিধার কারণে
বাংলাবাজার এড়িয়ে চলছেন। একজন সাধারণ ক্রেতার কথাই চিন্তা করা যাক। তিনি জানেন
কম্পিউটার কিংবা অন্য পণ্য কেনার জন্য কোন মার্কেটে যেতে হবে। কিন্তু একই ক্রেতা
যখন কোনো একজন লেখকের লেখা নির্দিষ্ট একটি বই কিনতে চান, তিনি তখন থাকেন
পুরোপুরি অন্ধকারে। তিনি জানেন না কোথায় খুঁজলে নির্দিষ্ট বইটি পাবেন। সব প্রকাশনা
প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট একটি মার্কেটে থাকলে পাঠকেরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বইটি সহজেই
খুঁজে নিতে পারতেন, যেমনটা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। এতে বইয়ের ক্রেতা-পাঠক
যেমন বাড়ত, প্রকাশকেরাও খেয়েপরে বাঁচতে পারতেন। এ চাওয়াটা খুব কি বেশি?

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সর্বসাকল্যে ৩৫০-৩৬০ জন প্রকাশক আছেন যাঁরা
নিয়মিতভাবে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশ করে থাকেন। এই প্রকাশকেরা সারা বছর যাতে
তাঁদের প্রকাশিত সৃজনশীল গ্রন্থ পাঠকের কাছে উপস্থাপন ও বিক্রি করতে পারেন এবং
ক্রেতা-পাঠকও যাতে সহজে কাক্সিক্ষত বইটি কিনতে পারেন সেজন্য এখনই ব্যবস্থা নেয়া
জরুরি। এর মাধ্যমে সারা বছর বই প্রকাশের সুযোগ তৈরি হবে। নতুন-নতুন লেখক তৈরি
হবে। প্রকাশকেরা যখন দেখবেন তাঁদের লগ্নি করা টাকা নিয়মিতভাবে ফিরে আসছে, তখন
তাঁরা আরো বড় কাজ করার আগ্রহ দেখাবেন। শুধু চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় নয়, বারো
মাসজুড়েই বাংলা ভাষায় লিখিত গ্রন্থের প্রকাশনা ও বেচাকেনা চলবে তেমন একটা উদ্যোগ
কর্তৃপ শিগগির নেবে- এটাই আমার চাওয়া।

বই জগতের তথা লেখা ও পড়ার সদর অন্দর নিয়ে শিহাব বাহাদুর বা নাজমুল হুদা রতনের
মতো আরো অনেক প্রকাশকের কাছে গেলে শুনব আরো অনেক কথা। আপাতত থাকলাম
সেসব শোনার অপেক্ষায়।


শেয়ার করুন