রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কূটনৈকিত ব্যর্থতা (শেষ পর্ব)

মোজাম্মেল হকঃ

কূটনীতির ইংরেজী প্রতিশব্দ Diplomacy র উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ Diploma থেকে। Diploma শব্দটি গ্রীক ক্রিয়া শব্দ Diplon থেকে উৎপত্তি। Diplon মানে হচ্ছে-ভাজ করা। ফ্রান্সে ১৭ শতক থেকে বিদেশে অবস্থানকারী বাণিজ্যিক ও সরকারি প্রতিনিধি দলকে Diplomat বা কূটনৈতিক দল বলা হতো। বাংলা কূটনৈতিক শব্দটি সংস্কৃত শব্দ কূটানীতি থেকে উৎপত্তি। প্রথম মৌর্য্য সম্রাট চন্দ্র গুপ্তের উপদেশষ্টা চানক্য কৌটিল্যের নাম থেকে কূটানীতি বা কূটনীতি শব্দটির উদ্ভব। সাধারণ অর্থে কূটনীতি হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রম।
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। আরকান রাজ্যের মুসলিম সংস্কৃতিক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানের নৃতাত্বিক অস্থিত্বকে অস্বীকার করে আরকান অঞ্চল থেকে মুসলিম সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে ফেলার চেষ্ঠা করছে। অথচ আরকান রাজ্যে মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে বসবাস করে আসছে। ধারণা করা হয়- রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরকানের রাজধানী ম্রোহং থেকে। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরকানের নাম রোসাং নামে উল্লেখ রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইন প্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসাবে মিয়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। পূর্বে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করলে ও কালক্রমে এবং বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাব বদলে যায়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের মন্তব্য হলো তারা জাতীয় জনগোষ্ঠী নয় বরং তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। মিয়ানমার সরকার তাদেরকে রোহিঙ্গা বলতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাদেরকে বাঙ্গালি বলে সম্মোধন করতে থাকে । রোহিঙ্গাদের অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন তাদেরকে মিয়ানমারের মধ্যে জাতিসত্ত্বার পরিচয় দেওয়ার দাবী জানাতে থাকে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ শে আগষ্ট আরকান রাজ্যের (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) কয়েকটি সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কতৃক হামলার পর মিয়ানমারের সেনা বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর পরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা চালায়। হত্যাকান্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবড়িতে অগ্রিসংযোগসহ বর্বর নির্যাতন চালায় তারা। ওই সময় জীবন বাঁচাতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ই নভেম্বর আইসিজে তে (আন্তর্জাতিক বিচারক আদালত) মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলিম দেশ গাম্বিয়া। নেদারল্যান্ডসের দ্যা হেগের পিস প্যালেসে ১০ থেকে ১২ই ডিসেম্বর মামলার শুনানী চলে । শুনানীতে গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবু বক্কর তাম্বাদু। মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্ঠা অংসান সুচি। বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষার এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন উক্ত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
গত ২৩ জানুয়ারী ২০২০ তারিখের ঐ রায়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সহিংসতা ও বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ১৭জন বিচারক সর্বসম্মত ভাবে চার দফা অন্তÍর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
১। মিয়ানমারকে তার সীমানার মধ্যে হত্যা বা জখম করা, পুরো জনগোষ্ঠী বা তার অংশ বিশেষকে নিশ্চিহ্ন
করা এবং তাদের জন্ম দানের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
২। মিয়ামারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে যাতে সেনাবাহিনী বা অন্যকোন অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট
গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, গণহত্যার উস্কানি দেওয়া বা গণহত্যার সহযোগী হতে না পারে,
সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
৩। গণহত্যা সনদের বিধি-২ এর আলোকে গণহত্যার অভিযোগের সাথে সম্পর্কীত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং
তা ধবংস সাধনের চেষ্ঠা প্রতিরোধ করতে হবে।
৪। এই আদেশ জারির দিন থেকে চার মাসের মধ্যে আদালতের আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যে সব ব্যবস্থা
নিয়েছে তা আদালতকে অবহিত করতে হবে। আদালতের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে। আইসিজের এ রায় মিয়ানমারের জন্য নি:সন্দেহে একটি আঘাত এবং রোহিঙ্গাদের জন্য এটি অত্যন্ত আশব্যজ্জক একটি রায়।
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য এই রায়ে অনেক গুলো উপকরণ কয়েছে। বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য এই রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি সহ সকল বিশ্ব সম্প্রদায়কে আস্থায় এনে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারলে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন দ্রুত সম্ভব বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

মোজাম্মেল হক
প্রভাষক
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
টেকনাফ সরকারি কলেজ।


শেয়ার করুন