রিও অলিম্পিকে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন সিরীয় শরণার্থী তরুণী

FILE - This is a Monday, Nov. 9, 2015 file photo of Yusra Mardini from Syria poses during a training session in Berlin, Germany. They’ve fled war and violence in the Middle East and Africa. They’ve crossed treacherous seas in small dinghies and lived in dusty refugee camps.They include a teenage swimmer Yusra Mardini from Syria, long-distance runners from South Sudan and judo and taekwondo competitors from Congo, Iran and Iraq. They are striving to achieve a common goal: To compete in the Olympics in Rio de Janeiro. Not for their home countries, but as part of the first ever team of refugee athletes.(AP Photo/Michael Sohn, File)

রিও অলিম্পিক সুইমিংয়ের কিংবদন্তী তারকা হচ্ছেন মাইকেল ফেলপ্‌স। এখনো পর্যন্ত ২২টি স্বর্ণ পদক নিজ ঝুঁলিতে নিয়ে সবার সেরায় পরিণত হয়েছেন ফেলপ্‌স।

কিন্তু সুইমিং পুল ডেকের প্রকৃত তারকা হচ্ছেন ইয়াসরা মারদিনি (১৮) নামের এক সিরীয় শরণার্থী তরুণী। তিনি ‘রেফিউজি অলিম্পিক টিমের’ হয়ে সুইমিং পুলে নেমেই হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। ইউরোপের পথে এক দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রা শেষে বুধবার বিকেলে সুইমিং পুলে নামেন তিনি। মেয়েদের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল হিটে জিতেছেন ইয়াসরা।

সাঁতার শেষে মারদিনি বলেন, ‘পানিতে এটি ছিল একটি বিস্ময়কর অনুভূতি। আমি সত্যিই গর্বিত এবং আনন্দিত।’

কিন্তু মাত্র ১ মিনিট ৪ সেকেন্ডের সাঁতার মারদিনির জন্য খুবই সহজ একটি কাজ। কেননা সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসার সময় তাদের ডিঙ্গি নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে টানা তিন ঘণ্টারও বেশি সময় তাকে সাঁতার কাটতে হয়েছে।

‘রেফিউজি অলিম্পিক টিম’ হচ্ছে দুর্নীতি ও ডোপিংয়ের একটি প্রতিষেধক এবং অলিম্পিকের বাড়তি একটি দল। এটা সত্যিকার অর্থেই একটা মহৎ কাজ যা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) সাম্প্রতিক সময়ে সম্পন্ন করেছে। যদিও সংশয়বাদীরা বলবে, ধান্দাবাজ আইওসি কেবল সমালোচনা ঠেকাতেই এ দলটিকে সৃষ্টি করেছে। যাই হোক, অনুপ্রেরণাই হচ্ছে খেলার একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন।

সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর দশজন উদ্বাস্তুকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে এ দলটি। এরা সবাই তাদের নিজ নিজ দেশে থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। তারা এ প্রতিযোগিতায় আইওসি’র ব্যানারে অংশ নিচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাই সবার দৃষ্টিও ছিল এ দলটির প্রতি। উপস্থিত দর্শকরা তাদের উল্লাস ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায়। হোস্ট ব্রাজিল টিমের চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করেছে দলটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাসী যে ভয়াবহ শরণার্থী সংকট প্রত্যক্ষ করেছে সেখানে মাত্র ১০ জন ক্রীড়াবিদের প্রতিনিধিত্ব যদিও খুব ছোট উপস্থাপনা। তবুও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তারা হচ্ছে শরণার্থীদের একটি শক্তিশালী প্রতীক।

মারদিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বকে দেখাতে চাই যে, শরণার্থী শব্দটি মোটেও কোনো খারাপ শব্দ নয়। আমাদের এই দলটি সত্যিই বিস্ময়কার ও অসাধারণ। তারা সকল জাতির, সকল দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।’

বর্তমানে শরণার্থীদের নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন চলছে চরম অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। উদ্বাস্তুদের ভয়ে দেশে দেশে যখন দাবি ওঠছে তাদের নিষিদ্ধ করার। তখন দেয়ালে দেয়ালে লিফলেট টাঙিয়ে প্রস্তাব করা হচ্ছে, ছোট এই গ্রুপটিই হচ্ছে মানুষের স্মারকচিহ্ন; যারা সাহসী আর অদম্য। কেবলই চেষ্টা করছে সাদামাটাভাবে একটু বেঁচে থাকতে।

মারদিনি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বড় হয়েছে। ৩ বছর বয়স থেকেই সে সাঁতার অনুশীলন করে আসছে এবং একসময় সিরিয়ার জাতীয় দলেও সুযোগ হয় তার। দেশটিতে ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পরার সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। ২০১২ সালে তাদের বাড়ি হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। মারদিনির সঙ্গী অন্য সাঁতারুদেরকে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় তিনি ও তার বোন সারাহ এবং তার দুই চাচাতো বোনকে নিয়ে গত আগস্টে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।

তারা দামেস্ক থেকে পালিয়ে প্রথমে বৈরুতে আসেন। এরপর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আসার পর তারা পাচারকারীদের খপ্পরে পরেন। পাচারকারীরা তাদের নৌকাযোগে গ্রিসের উপকূলে নিয়ে যায়। ৬ বছর বয়সী এক শিশুসহ তাদের ছোট একটি ডিঙি নৌকায় তোলা হয়। ছোট ওই নৌকায় তাদের সঙ্গে আরো ১৭ জনকে নিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রওয়ানা দেয়া হয় গ্রিস অভিমুখে।

২০ মিনিট পর নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে নৌকাটি সাগরের পানিতে ভাসতে থাকে। ওই নৌকায় মারদিনি ও তার বোন সারাহ এবং আরো দুই যুবকই কেবল সাঁতার জানত। তারা চারজন ভূমধ্যসাগরের ঠাণ্ডা পানিতে লাফিয়ে পরে সাঁতার কাটতে কাটতে নৌকাটিকে টেনে তীরে নিতে সক্ষম হয়।

সেদিনের সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা স্মরণ করে মারদিনি বলেন, ‘আমি একজন সাঁতারু। তবুও ওই ঠাণ্ডা পানিতে আমি প্রায়ই মারাই যাচ্ছিলাম।’

তারা শেষপর্যন্ত গ্রীসের লেসবস দ্বীপের একটি তীরে পৌছাতে সক্ষম হন। এরপরে শুরু হয় তাদের আরো একটি কষ্টের জীবন। সেখান থেকে তারা পায়ে হেঁটে, আবার কখনো পাচারকারীদের বাসযোগে গ্রীস, মেনিডোনিয়া, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি হয়ে অবশেষে বার্লিনে পৌঁছায়। পরে বার্লিনের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে তাদের ঠাঁয় হয়। সেখানে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দিন অতিবাহিত করতে থাকে।

ওই শরণার্থী ক্যাম্পের একজন দোভাষীর সাহায্যে মারদিনি স্থানীয় একটি ক্রীড়া ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাঁতার প্রশিক্ষণ নেন। অলিম্পিক কমিটির তত্ত্বাবধানে ‘রেফিউজি অলিম্পিক টিম’ গঠন করা হচ্ছে- এ খবর শোনে আবেদন করেন রেফিউজি অলিম্পিক টিমে এবং সুযোগ মেলে দলটিতে প্রতিনিধিত্ব করার।

রিও অলিম্পিকে সুযোগ পেয়ে মারদিনি এখন অভিভূত। যে মেয়েটি কেবলই একটু আশ্রয় আর নিরাপত্তার খুঁজে নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান ইউরোপের পথে। সেই মেয়েটিই কিনা আজ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের স্পটলাইটে পরিণত হয়েছে।

বুধবার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা শেষে এক সাক্ষাৎকারে মারদিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে অন্যদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবো এমনটি কখনো আশা করিনি। আমি জানি না, এর পরে কি ঘটতে যাচ্ছে কারণ আমি এই মুহূর্তে কিছু কল্পনাও করতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমি শুধু জানি, আমাকে সাঁতারের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে এবং আমি চাই উদ্বাস্তুদের প্রতি আমার সমর্থন অব্যাহত রাখতে।’

অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার স্বপ্ন মারদিনির পূর্ণ হয়েছে কিন্তু তার আরো একটা স্বপ্ন এখনো পূর্ণ হয়নি। কেননা এখনো পর্যন্ত যে মাইকেল ফেলপসে্‌র সঙ্গে দেখাই হয়নি তার।

মারদিনি বলেন, ‘না এখনো মাইকেল ফেলপসে্‌র সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। তার মতো বিশ্ববিখ্যাত সেলিব্রটির দেখা পাওয়া অত সহজ নয় এবং আমি এজন্য তাকে বিরক্তও করতে চাই না।’

তবে মারদিনির ভক্তরা মনে করছেন বরং ফেলপসেরই উচিত হবে রিও সুইমিং পুলের এই বাস্তব তারকার দেখা দেখা করা।

সাঁতারু না হলে কি করতেন জানতে চাইলে মারদিনি বলেন, ‘সাঁতার ছাড়া জীবিত মারদিনিকে কল্পনাই করতে পারি না।’

হিউস্টন ক্রনিকল অবলম্বনে মো. রাহল আমীন

 


শেয়ার করুন