যখন মোবাইল ছিল না

download-115বর্তমান সময়ের কোনো কিশোর-কিশোরীর কাছে জানতে চাওয়া হয় যে যখন মোবাইল ফোন ছিল না, সেই সময়টি সম্পর্কে তাদের ধারণা কী? নিশ্চিত ভাবে তারা অবাক হবে। আর যদি কোনো যুবক-যুবতীর কাছে জিজ্ঞেসা করা হয় যে মোবাইল ফোন ছাড়া তাদের পক্ষে থাকা সম্ভব কিনা। তাদের কাছ থেকে এক কথায় জবাব আসবে না। অথচ দু’দশক আগেও এখনকার মত বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষের হাতে ছিল না কোনো মোবাইল ফোন। তাহলে তখন কেমন ছিল তাদের জীবনযাত্রা। আর এখনকার মানুষদের থেকে তাদের পার্থক্যই বা কী ছিল।
রোকব ভূঁইয়া একজন তরুণ স্থাপতি। বাংলাদেশের এখনকার অনেক তরুণের মতো একটি স্মার্টফোন রয়েছে তার। আর কে না জানে এখনকার সময়ের স্মার্ট মোবাইল ফোন কথা বলা আর বার্তা পাঠানোর যন্ত্র নয়। এর রয়েছে হরেক ব্যবহার। এবং এটিকে টেলিফোন না বলে কম্পিউটার বলাই ভাল।
ভূঁইয়া ফোনটি দিয়ে কী কী কাজ করে জানতে চাওয়া হলে ভূঁইয়া বিবিসিকে বলেন, কথা বলার পাশাপাশি সবার মতো এসএমএস করি এবং ইন্টারনেটে এমন কিছু সফ্টওয়্যার রয়েছে যার মাধ্যমে আমি আমার কাজ সম্পাদন করি।
১৯৯০ এর দশকে কৈশর পার করেছে তারিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতেন তিনি। তখন বাংলাদেশে মোবাইল ফোন আসি আসি করছে। সেই সময়ে বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতেন মি.ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে মি. ইসলাম বিবিসিকে বলেন, তখনকার সময়ে কারো সাথে যোগযোগ করার জন্য চিঠি লিখে পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে তার কাছে পাঠাতাম। এবং কাছাকাছি কারো সাথে দেখা করার জন্য তার কাছে গিয়ে দেখা করতাম। যদি তাকে না পাওয়া যেত তাহলে তার আশেপাশে যারা থাকত তাদের বলা হত সে যেন আমার সাথে দেখা করে। অথবা পরের দিন নির্দিষ্ট একটি সময় বলে আসতাম যে তার সাথে দেখা করার জন্য আবার আসব।
এদিকে ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে যখন মোবাইল ফোন বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের দখল থেকে নি¤œবিত্তদের হাতে পৌঁছাতে শুরু করেছে তখন নিজের একটি মোবাইল হয়েছে স্থাপতি রোকন ভূঁইয়ারও। এর আগে তার শৈবব ও কৈশর কেটেছে এই তারহীন যোগাযোগ ছাড়া। তিনি দুটো সময়েরই প্রতিনিধি। মোবাইল ফোনের বিবর্তনের প্রায় পুরোটাই তিনি একজন ব্যবহারকারী হিসেবে দেখেছেন। এবং এখন উন্নতির শিখরে থাকা স্মার্ট ফোনের সর্বোচ্চ ব্যবহার তিনি করছেন।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে গত মে মাসে দেশটিতে সক্রিয় মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। এখনকার দিনে জনসমাগম হয় এমন যে কোনো জায়গায় গেলে দেখা যায় তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা সারাক্ষণই মোবাইল ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ছবি তুলছে, গেমস খেলছে কিংবা কিছু না কিছু করছে। অথবা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে।
ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মলের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে সেলপি তুলছিলেন দু’জন তরুণ-তরুণী। কথা হয় তাদের সাথে।
তারা বলেন, মোবাইলের মাধ্যমে আমার প্রেম হয়েছে এখন বিয়ে হবে। কিন্তু কোনো এক সময় মানুষকে চিঠি দিয়ে ভালবাসা বিনিময় করতে হত। সেটি এখন আর নেই। তবে মোবাইল ফোন ছাড়া এখন আর ভাবা যায় না।
বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যার অনুপাতে মোবাইল ফোনের ব্যবহার কারীর সংখ্যা শতকরা ৭৮ ভাগেরও বেশি। ১৯৯৩ সালে যা ছিল প্রচ- ব্যয়বহুল সীমিত সংখ্যক উচ্চবিত্তদের হাতে। আজ তা ছড়িয়ে গেঠে বিত্তের সর্বনি¤œ পর্যায়ে। এমন কী গৃহকর্মী রিকসা চালকদের মতো সমাজের সবচেয়ে নিচু শেণির মানুষদের হরহামেশাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়।
গত ১০ বছর ধরে ঢাকায় রিকসা চালান মো. তাওহীদ হোসেন। তার পরিবার থাকে বগুড়ায়।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবারের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা হয় তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এবং আমি ছয় বছর ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। মোবাইল ফোন না থাকলে বাড়িতে কে কেমন আছে তা জানা যায় না সেই সাথে টাকা পাঠাতেও সমস্যা হয় তাই আমি সবার খোঁজ খবর রাখার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করি।
গ্রামেগঞ্জে এখনও হয়ত অনেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। কিন্তু ঢাকায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ কোনো দিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন নি।
তবে তার সাথে কথা হওয়ার পর তিনি বলেন, ১৯৯০ এর দশকে তিন তখন রাষ্ট্রয়াত্ত্ব বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রদান। তখন তাকে সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে মন্ত্রণালয় সেই প্রক্রিয়া বাতিল করে দেয়।
মোস্তফা কামাল বলেন, ওই সময়ে আমার দুঃখ হয়েছিল। কারণ নতুন একটি জিনিস আমি পাব সেই কারণে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমাকে মোবাইল ফোনটি দেওয়া হলো না তখন আমার একটু দুঃখ লাগে। সেই থেকে আমার মোবাইল ফোনের প্রতি অহীনা সৃষ্টি হয়। তবে তখন যদি আমাকে মোবাইল ফোনটি দেওয়া হত তাহলে আমার কাছে মোবাইল ফোন থাকত।
বর্তমান কয়েকজন তরুণ প্রজন্মে কাছে জানতে চাওয়া হয় মোবাইল ফোন ছাড়া তাদের কেমন লাগে? তারা বলেন,মোবাইল ছাড়া একটি মুহূর্ত চলা সম্ভব নয়।
মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাংলাদেশের মানুষের আচরণে কী ধরনের পরিবর্তন এনেছে?
নয়া যোগাযোগের নানা মাধ্যম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন।
গীতিআরা নাসরিন বলেন,মোবাইল ফোন আমাদের স্বস্তিও দিয়েছে এবং অস্বস্তিও দিয়েছে। কারণ যখন আপনি কারো কাছে ফোন করবেন তখন সে যদি ফোনটি রিসিভ না করে তখন আপনার চিন্তা বেড়ে যায়। যে কী কারণ যে ফোনটি রিসিভ করছে না। সুতরাং ফোন আমাদের স্বস্তির চেয়ে অস্বস্থি বেশি দিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা


শেয়ার করুন