‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’

0f89268d90e6d7343e28e9995e6201bd-57a568ef8dd49‘চুকিয়ে দেবো বেচাকেনা মিটিয়ে দেবো গো/ মিটিয়ে দেবো লেনাদেনা বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে/ তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে/ তারার পানে চেয়ে চেয়ে, নাইবা আমায় ডাকলে/ যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। এভাবেই কুষ্টিয়ার শিলাইদহের পুকুড়পাড়ে বসে নিজের না থাকার বেদনার ছন্দ উচ্চারণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ ২২ শ্রাবণ কবিগুরুর চির প্রস্থানের দিন।
১৯৪১ সালের ৬ আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ সনের বাইশে শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শ্রাবণের বাদল ঝরা দিনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন কবিগুরু। রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্যের বিশাল একটি অংশে যে পরমার্থের সন্ধান করেছিলেন সেই পরমার্থের সঙ্গে তিনি লীন হয়েছিলেন এদিন।

কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আর পুকুরপাড়ে বসে বিশ্বকবি তার নোবেলজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র অধিকাংশ কবিতা লিখেছিলেন। ফলে রবীর হৃদ-মাঝারের বিশেষ এই স্থানটি তাকে মনে রাখবে কি না, সে ভাবনায় হারিয়েছিলেন তিনি। তবে জগতের লেনাদেনা চুকিয়ে দেওয়ার পরও এখনও এখানকার মানুষের কাছে তিনি অমলিন।

শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে প্রতিনিয়তই ভিড় জমে রবীন্দ্রপ্রেমীদের। বাংলাদেশে যেসব জায়গা কবিগুরুর পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়েছে, তার প্রধানতম স্থান হলো কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। জমিদারির দায়িত্ব নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ স্থায়ীভাবে শিলাইদহে থেকেছেন। এখান থেকেই তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলা এবং বর্তমানের বাংলাদেশে তার জমিদারি পরিচালনা করতেন, যা কুষ্টিয়া, পাবনা এবং রাজশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত্ব ছিল। এখান থেকেই তিনি যেমন তার সাহিত্য ও সঙ্গীতের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন, তেমনি এ অঞ্চলে তিনি পল্লী উন্নয়নের কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। শিলাইদহ ছাড়াও পূর্ববঙ্গের সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরে কবিগুরু বাস করলেও, শিলাইদহেই তিনি অধিক সময় ছিলেন।

কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। প্রাচীন শহর কুমারখালী উপজেলার পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে শিলাইদহে অবস্থিত এ কবিতীর্থ। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে প্রথম আসেন তখন শিলাইদহের জমিদারি দেখাশোনার ভার ছিল জ্যোতিন্দ্রনাথের ওপর। সে সময় পর্যন্ত বর্তমান কুঠিবাড়ী নির্মিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ এবং পরিবারের অন্যরা তখন নীলকর সাহেবদের কুঠিবাড়ীতে বসবাস করতেন।

রবীন্দ্রনাথ তার ‘ছেলেবেলা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিলাইদহে নীলকর সাহেবদের কুঠি সম্বন্ধে বলেন, ‘পুরনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নিচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড় বড় ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল।’

রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-ভবন নির্মিত হয় ১৮৯২ সালের শেষদিকে। নীলকর সাহেবদের ভগ্নকুটিরের মাল-মশলা নিয়ে বর্তমান ‘রবীন্দ্রকুঠি’ নির্মিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ নিজে কিন্তু শিলাইদহের কুঠিবাড়ি নির্মাণ করেননি। সে সময় শিলাইদহের জমিদারির দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে নিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিলে এই কুঠিবাড়ি নির্মাণ করেন, তবে কুঠিবাড়ির নির্মাণে দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়।

বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ ও ১৮৯৯ সালে জমিদারি পরিদর্শনে এলেও ১৮৯১ সালে শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট একটি আমমোক্তারনামায় স্বাক্ষর করে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দেন।

রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী কুঠিবাড়ি সবসময় প্রাণবন্ত রাখতেন। মৃণালিনী দেবী কুঠিবাড়ির ভেতর ও বাইরে ফুল-ফলের বাগান তৈরি করেছিলেন। এ সময় আম কাঁঠাল গাছে ভরা ছিল রবীন্দ্র কুঠির চৌহদ্দি। কুঠিবাড়ির নিচতলার হলঘরে কর্মচারী ও প্রজাদের দরবার বসতো। পূর্ব দিকের ঘরে রবীন্দ্রনাথের অফিস এবং পশ্চিমের ঘরে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কবিগুরু তিন তলার চিলেকোঠায় দীর্ঘক্ষণ থাকতেন। এ ঘরে বসে পদ্মা ও গড়াই; দু’টি নদীই দেখা যেতো। এখন গড়াই অনেক দূরে সরে গেছে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কাল রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কাটিয়েছেন। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল, টানা ১০ বছর শিলাইদহে বসবাস করে জমিদারি দেখাশোনা করেছেন। এখান থেকে নৌকায় চেপে শাহজাদপুর ও পতিসর কাছারিবাড়িও দেখাশোনা করতেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শ্রেষ্ঠ রচনার অনেকগুলো এখানেই রচনা করেন। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ- সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, ক্ষণিকা, কল্পনা, কনিকা, কাহিনী, খেয়া, নৈবেদ্য, বলাকা ও গীতাঞ্জলী, সঙ্গীত-গীতিমালা ও গীতবিতান এখানেই রচিত। উপন্যাস- চোখের বালি, গোরা, চতুরঙ্গ ও ঘরে বাইরে। নাটক- চিরকুমার সভা, গোড়ায়গলদ, চিত্রাঙ্গদা ও অচলায়তন। প্র্রবন্ধ- পঞ্চভূত, পত্রাবলি, বিচিত্র প্রবন্ধ, ইউরোপের ডাইরি, ভানু ঠাকুরের পত্রাবলী ও পোস্টমাস্টার গল্পটিও এই শিলাইদহে লেখা।

কুঠিবাড়ি এখন যেমন

কবি না থাকলেও তাঁর স্মৃতি হিসেবে এখনও সমাদৃত শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। ৩৩ বিঘা জমি নিয়ে কুঠিবাড়ির তিন তলাবিশিষ্ট এ বাড়িতে রয়েছে ১৭টি কক্ষ। কক্ষ ও বারান্দাজুড়ে প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে কবির ব্যবহৃত একটি পালঙ্ক, লেখার টেবিল, ইজিচেয়ার, নদীতে চলাচলের দু’টি বোট চঞ্চল ও চপলা, পালকি, ঘাসকাটা যন্ত্র, ব্যবহৃত তলোয়ার, পানিশোধন যন্ত্র, বিভিন্ন সময়ে কবিকে ঘিরে তোলা আলোকচিত্র, কবিগুরুর নিজ হাতে আঁকা ছবি ইত্যাদি। তবে দ্বিতীয় তলার ২০১ নম্বর কক্ষ থেকে আলমারিতে রাখা পাঁচটি তরবারির মধ্যে দুটি তরবারী চুরি হয়ে গেছে। গত ৩০ মার্চ চুরির ওই ঘটনা ঘটেছে।

শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আগের সেই নৈসর্গিক পরিবেশও আর নেই। নেই পুকুরপাড়ের সেই বকুল গাছ। যেখানে কবিগুরু নিয়মিত বিশ্রাম নিতেন। যেখানে বসে তিনি অজস্র কবিতা ও গান লিখেছেন। রবীঠাকুরের ব্যবহৃত দু’টি পালঙ্কের একটি চুরি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময় থেকেই কবিগুরুর শিলাইদহের কুঠিবাড়িটি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরোয়ার মোর্শেদ রতন বলেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যারা চর্চা করছেন তারাই সারা বছর এসব বিষয়ে চর্চা করে থাকে। কিন্তু জাতীয়ভাবে এই চর্চা করা হয় না। বর্তমান প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চর্চা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করা দরকার।


শেয়ার করুন