মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রবন্ধ: রোহিঙ্গারাও যেহেতু মানুষ

মুহম্মদ নূরুল হুদা |
রোহিঙ্গা সমস্যার মূল সমাধান নিহিত রয়েছে রোসাঙ্গ রাজ্যের মাটিতে। এ রাজ্যের মাটিতে যাঁদের জন্ম, বংশপরম্পরায় এখানে যাঁদের বসবাস, যাঁরা এই রাজ্যের ভূমিপুত্র বা ভূমিকন্যা, তাঁদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে বাধা কোথায়? তাদের জানমালের নিরাপত্তা কেন দেবে না বা দিতে পারবে না মিয়ানমার সরকার বা তথাকথিত শান্তিনারী অং-সাং-সুচি বা তাঁর অনুগত সাঙ্গপাঙ্গরা? তাদেরকে বাধ্য করার দায়িত্ব অবশ্যই জাতিসঙ্ঘ ও বৃহৎশক্তিরূপী বিশ্বমোড়লদের।

নিরাপত্তা বলয় তো করা যেতেই পারে, কিন্তু সেটা সাময়িক সমাধান। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে স্বায়ত্তশাসিত পৃথক রোসাঙ্গ রাজ্যগঠন ছাড়া স্থায়ী সমাধান হবে না কখনো। গত কয়েকশ বছরের নৃশংসতা অন্তত সেই কথাই বলে। আমাদের প্রস্তাবিত স্বায়ত্তশাসিত রোসাঙ্গ রাজ্যের শাসন ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও দিতে হবে রোহিঙ্গাদেরকেই। তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গা-শান্তি। অন্য কোনোভাবে এই শান্তি আসার পথ সহজে চোখে পড়ে না।

আপাতত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানাদেশে প্রকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসন তথা নিরাপদ বসতি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ তো করছেই যথাসাধ্য। শরণার্থী শিবির ছাড়াও কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের এমন কোনো চর, পাড়া, ঘোনা, মুড়া বা টিলা নেই যেখানে অশনাক্ত রোহিঙ্গা বসতি নেই। এভাবে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে, বলা যতে পারে, নিজেদের সাধ্যাতীত করছে এদেশের জনগণ ও সরকার। কিন্তু কি করছে চীন, ভারত বা আশেপাশের অন্য বড় দেশগুলো? কেবল কতিপয় ইসলামি দেশের কিছু মিটিং-মিছিল দিয়ে সমাধান আসবে না। তাতে বরং রোহিঙ্গাদেরকেই ঘায়েল করার কুযুক্তি পাবে ঘাতকেরা। বিশ্বের অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ও স্বল্পবসতিপূর্ণ বড় বড় কিছু দেশে তাদের সাময়িক বা স্থায়ী পুনর্বাসন করতে বাধা কোথায়?

গুণ-কবি সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে লড়াই করতে হুংকার দিয়েছেন। ভালো কথা, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অবশ্যই লড়বে – কিন্তু কেন একা লড়বে? কেন তার সঙ্গে অস্ত্রশক্তি বা কূটনৈতিক বল-প্রচারণা নিয়ে যুক্ত হবে না সার্কসহ বিশ্বের ছোট-বড় সব কল্যাণকামী রাষ্ট্র? সোজা কথা সোজাসুজি না বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছেন অনেক বিশ্ব নেতা। অর্থাৎ তাঁরা সহজ সমাধান চান না। যেমন চাননি প্যালেস্টাইনে বা অন্যত্র। কেননা মুসলমানদেরকে জঙ্গি বানানো ও জঙ্গিবাদ শেখানোই তাদের উদ্দেশ্য। এতে তাদের এজেন্ডা টিকে যায়।

ধর্ম, বর্ণ বা অন্য কিছুর আগে রোহিঙ্গাদের মূল পরিচয় তারা মানুষ। মিয়ানমারেরা শাসক ও অস্ত্রধারীরাও যদি মানুষ হয়, তাহলে তারা বিনা-বিচারে বা নির্বিচারে মানুষ মারছে কেন? যারা এভাবে মানুষ মারছে তারা খুনী। তারা অপরাধী। খুনী জান্তার বিচার হোক বিশ্ব-আদালতে। এ নিয়ে সোচ্চার হোক যুক্তরাষ্ট্রসহ ভেটো-শক্তিধর বৃহৎ শক্তিবর্গও। কিন্ত তা কি হবে? অতীতে কি তার দৃষ্টান্ত আছে? অতএব বরাবরের মতো বাংলাদেশকে যা করার আসলে তা একাই করতে হবে।

বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ সীমিত সাধ্যে যা করছে তার কোনো তুলনা নেই। আমরা ইতিমধ্যে সাত লাখেরও বেশি শরণার্থী প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করেছি। গ্রহণ করবো আরো যারা আসবে তাদেরকেও। বাঙালি নিত্যমানবিক, অতিথিপরায়ণ ও সমবেদনাশীল জাতি। আমরা নাফ নদীতে কোনো শরণার্থী নৌকা ডুবিয়ে দেবো না। আমরা কাউকে ফিরিয়েও দেবো না। কেননা তারা অনুপ্রবেশকারী নয়, শরণার্থী। বরাবরের মতো আমরা আমাদের ডালভাত তাদের সঙ্গে ভাগ করে খাবো। বিশ্ববিবেক অবশ্যই আমাদের পাশে দাঁড়াবে। যেমন দাঁড়াচ্ছে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও জনগণ। রোহিঙ্গা আমার ভাই, রোহিঙ্গা আমার বোন, রোহিঙ্গা আমার পরমাত্মীয়। রোহিঙ্গারা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। তাদের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছি গত কয়েকশ বছর। দাঁড়াবো আরো হাজার বছর। যতদিন তারা ফিরে পাবে না নিজেদের নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটির কুড়েঘর। কেননা আতি সাধারণ মানুষ এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি। তারা খেটে-খাওয়া মানুষ। তারা প্রাসাদ চায় না, তারা ফিরে পেতে চায় তাদেরই নিজ নিজ ভিটেঘর।

প্রকৃতপ্রস্তাবে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শরণার্থী-গ্রহণকারী এক নম্বর দেশ। সারাদেশে দৃশ্য-অদৃশ্য বা স্বীকৃত-অস্বীকৃত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন বিশ লাখেরও বেশি। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে ভিসা নিয়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ আরো কিছু মুসলিম দেশে চলে গেছেন। বাংলাদেশ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এর মূল প্রণোদনা মানবিকতা ও বিশ্বশান্তি। এই বিবেচনায় নোবেল পুরস্কার এখন শুধু সুচির কাছ থেকে কেড়ে নিলেই চলবে না, বরং তা প্রদান করতে হবে বাংলাদেশকেই। তাহলেই নোবেল শান্তিকমিটি সুবিচার করবে। সেক্ষেত্রে যোগ্য প্রাপক হবে বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেটাই হবে সুচি ও খুনী মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেকের দাঁতভাঙা পাল্টা জবাব।

লড়াই আমরা করবো অবশ্যই। তবে সে লড়াই হবে শান্তির লড়াই। বুদ্ধের অহিংসার লড়াই। কনফুসিয়াসের সদাচারের লড়াই। উপনিষদের অভেদসুন্দরের লড়াই। ইসলামের স্রষ্টা ও সৃষ্টির ঐক্যবোধ তথা তৌহিদের লড়াই। মানুষকে সব ভেদবুদ্ধির উপরে রেখে প্রকৃত মানুষ করার লড়াই। সেই লড়াইয়ে অবশ্যই বিজয়ী হবে মানুষ। বিজয়ী হবে রোহিঙ্গাও। কারণ তারাও মানুষ।


শেয়ার করুন