আবু মকসুদ

মহা-পরিচালকের নির্দেশ মানছেন না সমবায় কর্মকর্তা

3f684ed3-5476-4335-9224-da7770c938acএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন ॥

সমবায় অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক গত বছর এপ্রিল মাসে ঘোষণা করেছিলেন “ নতুন করে কোন সমিতির রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘ সমিতির রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে তারা এলএলএম ব্যবসা করে’। নতুন সমিতি রেজিষ্ট্রেশনের জন্য মহা-পরিচালক ঢাকা ও যুগ্ম নিবন্ধক চট্টগ্রামের পূর্বানুমতি নেওয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে কক্সবাজার সদর উপজেলা সমবায় অফিসার আবু মকসুদ গত ৬মাসে ৪টি নতুন সমিতির নিবন্ধন দিয়েছেন। এছাড়া আরো ৫টি নতুন সমিতি নিবন্ধন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। তৃতীয় দফায় তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলায় যোগদানের ৬ মাসের মাথায় এধরনের কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবু মকসুদ কক্সবাজার সদর উপজেলা সমবায় অফিসার হিসেবে প্রথম ২০০৮ সালের ৬ জুলাই যোগদান করেন। একটানা ২০১০ সালের ১৪ জুন পর্যন্ত সদর উপজেলা ছাড়াও রামু, চকরিয়ায় ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন অনিয়ম করায় তাকে ২০১০ সালে অন্যত্র শাস্তিমুলক বদলি করা হয়।

কিন্তু বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে পুরনায় ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর উপজেলায় ফিরে আসেন তিনি। একই বছর ২২ নভেম্বর তাকে এখান থেকে অন্য উপজেলায় স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। কিন্তু কর্মস্থল ছাড়লেও এই সদর উপজেলা সমবায় অফিসের মধু ছাড়তে পারেনি তিনি। শেষতক অনেক চেষ্টা তদবিরের মাধ্যমে চলতি বছর গত ২৫ মে তিনি তৃতীয় বারের মতো সদর উপজেলায় যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে তিনি উপজেলা সমবায় অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধকের নির্দেশনা অমান্য করে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে নতুন নতুন সমিতির নিবন্ধন দিচ্ছেন। ৩য় দফা এই সমবায় অফিসে যোগদানের ৬ মাসের মধ্যে তিনি নতুন ৪টি সমিতি নিবন্ধন দিয়েছেন এবং আরো ৫টি সমিতি নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।

ইতোমধ্যে মোটা অংকের টাকা নিয়ে কক্সবাজার বৈদ্যুতিক দোকান মালিক সমবায় সমিতি (রেঝিঃ নং-২১২৭/১৫, তাং-১৫/০৯/২০১৫) , পশ্চিম নতুন বাহারছড়া গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিঃ ( রেজিঃ নং-২১৩১/১৫), পশ্চিম বাহারছড়া ভুমিহীন সমবায় সমিতিসহ ৪টি সমিতি নিয়মবর্হিভুত ভাবে রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, সমিতির রেজিষ্ট্রেন করতে বিভিন্ন কিস্তিতে ৮২ হাজার টাকা আদায় করেছে আবু মকসুদ।

তারা আরো জানান, নিবন্ধক বা মহা-পরিচালকের জন্য ২০ হাজার টাকা, যুগ্মনিবন্ধক চট্টগ্রামের জন্য ২০ হাজার টাকা, জেলা সমবায় কর্মকর্তা ও উপজেলা নিবন্ধকের জন্য সর্বসাকুল্যে ৪২ হাজার টাকা নেন।

সুত্রটি জানান, একটি সমিতি নিবন্ধন করতে সরকার পায় মাত্র ৩৪৫ টাকা। অন্যান্য খরচসহ ব্যয় হওয়ার কথা সর্বসাকুল্যে ১ হাজার টাকা। কিন্তু এখানে আদায় করা হয় ক্যাটাগরি অনুযায়ি সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা।

একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, নতুন রেজিষ্ট্রেশন পাওয়ার জন্য আরো ৫টি সমিতি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তৎমধ্যে ঈদগাঁও টমটম মালিক ও চালক সমবায় সমিতি অন্যতম। এই সমিতি রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে পুরো ঈদগাঁও এলাকায় চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সংঘাত ও সংঘর্ষের আশংকাও করেছে এলাকাবাসি।
কেনো এতো সংঘাত, এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ঈদগাঁওতে বর্তমানে রেজিষ্ট্রেশন হওয়া আলাদা দু’টি সমিতি যথাক্রমে ‘ঈদগাঁও টমটম চালক সমবায় সমিতি ও ঈদগাঁও টমটম মালিক সমবায় সমিতি রয়েছে। এই দুটির পরেও ঈদগাঁও টমটম মালিক ও চালক সমবায় সমিতি নামে আরো একটি সমিতি রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার ষড়যন্ত্র নিয়ে এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

ঘোর অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন ক্যাটাগরির সমিতি হতে নানান অজুহাতে টাকা উত্তোলণের ধারা। চলতি বছর ৭ নভেম্বর ৪৪তম জাতীয় সমবায় দিবস পুরো দেশে উদযাপন করা হয়। দেশের অন্যান্য উপজেলার মতো দিবসটি পালনের জন্য সরকারী ভাবে বরাদ্দও আসে এ উপজেলায়। কিন্তু সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা দিবসটি উদযাপনের নামে বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাঁদা তুলেছেন। এছাড়া উধর্বতন কর্তৃপক্ষ কক্সবাজারে সমিতি পরির্দশন কিংবা ব্যক্তিগত সফরে আসলেও বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে টাকা উত্তোলণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন সমিতির অডিট, পরির্দশন, নার্সিং, তদারকি ও তদন্তের নামে অনৈতিক সুবিধা আদায় অব্যাহত রেখেছেন। প্রত্যেক সমিতির এডক কমিটি ও নির্বাচন কমিটি অনুমোদন দেয়ার নামে আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া কোন কোন সমিতিতে তিনি নিজেই সভাপতি হন অথবা নিজের পছন্দসই লোকজনকে সভাপতির পদে বসিয়ে দেন।

সংশ্লিষ্ট অফিস সুত্রে জানা গেছে, সমবায় অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক ও যুগ্ম নিবন্ধক চট্টগ্রামের নাম ভাঙ্গিয়ে অডিটের নামে যতসব অনিয়ম করছেন তিনি। সদর উপজেলার সমবায় সমিতি সমুহের ২০১৪-২০১৫ইং সনের অডিট বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সমবায় সমিতি সমুহকে ‘এ’বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ প্রদান সহ বকেয়া অডিট বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে সমবায় অধিদপ্তর ঢাকার পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে। সমবায় অধিদপ্তর ঢাকার পূর্বানুমতি ব্যতিত বকেয়া অডিট বরাদ্দ ও সম্পন্ন করা যাবে না। নিবন্ধক ঢাকা ও জেলা সমবায় অফিসারের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও তিনি গোমাতলি সমবায় কৃষি ও মোহাজের উপনিবেশ সমিতি বকেয়া অডিট সম্পাদন করেন। উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আবু মকসুদ গোমাতলি সমবায় কৃষি ও মোহাজের উপনিবেশ সমিতির একটি সুত্র জানান, সমবায় অধিদপ্তরের স্মারক নং-৬৮/৮৬, চট্টগ্রাম বিভাগীয় দপ্তরের স্মারক নং-৮৭৫/১১, জেলা সমবায় অফিস কক্সবাজার স্মারক নং-৬৩০/৮ এর আদেশ সমুহ পরিপন্থি ভাবে সম্পাদন করায় সমিতির আভ্যন্তরিন কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এছাড়া গত ২০ সেপ্টেম্বর গোমাতলি সমবায় কৃষি ও মোহাজের উপনিবেশ সমিতির অডিট সম্পাদন করলেও ২১ সেপ্টেম্বর তিনি ব্যক্তিগত রির্টান দাখিল করেন জেলা সমবায় অফিসে। ৭দিনের মধ্যে রিটার্ন দাখিল পরবর্তী ১দিনেই নিরিক্ষা ( অডিট প্রতিবেদন) দাখিলের বাধ্যতামুলক হলেও অদ্যাবদি নিরিক্ষা অডিট জেলা সমবায় অফিসে দাখিল করেননি।
সুত্রটি জানান, গোমাতলি সমবায় কৃষি ও মোহাজের উপনিবেশ সমিতির বিগত ২০০৭-২০০৮ থেকে ২০১৪-২০১৫ পর্যন্ত তাহার সম্পাদিত তার অডিট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বর্তমান সভাপতি নুরুল আমিন এর অবৈধ কর্মকান্ড কিভাবে বৈধতা দিয়েছে তার চিত্র।
চট্টগ্রাম লবণ উৎপাদনকারি সমবায় সমিতি লিঃ এর সদস্য ও কক্সবাজার উপকুলীয় চিংড়ি ও লবণ উৎপাদনকারি বহুমুখি সমবায় সমিতি লিঃ এর প্রতিনিধি এম.ওবাইদুল্লাহ খান জানান, সমিতির একটি কাজ সম্পন্ন করে দেয়ার জন্য আবু মকসুদ তার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। কিন্তু পরবর্তীতে কাজ করতে না পারায় ঘুষের টাকা ফেরৎ চাওয়া হয়। বিষয়টি অন্যান্য উপজেলা কর্মকর্তা জাহাংগীর আলম, মান্নান ও সাবেক জেলা সমবায় কর্মকর্তা নুরুন্নবী অবগত রয়েছেন।

কক্সবাজার জেলা সমবায় কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত) মোঃ বখতেয়ার কামাল এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আবু মকসুদ অনিয়ন্ত্রিত। তিনি তার খেয়াল খুশি মতো সব কিছুই করছেন। এ মুহুর্তে আবু মকসুদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবেন বলেও মন্তব্য করেছেন জেলা সমবায় কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ বখতেয়ার কামাল।
এব্যাপারে বুধবার রাত ১০টার সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আবু মকসুদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার রিং করার পরও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।


শেয়ার করুন