মধ্যবর্তী নির্বাচন বর্তমান সংবিধানেই সম্ভব

শহীদুল্লাহ ফরায়জী, মানবজমিন:

স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় তিন তিনবার মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন মানেই জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই তৃতীয় সংসদ ভেঙে ১৯৮৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই সংসদ ভেঙে দিয়ে ১৯৯১ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সর্বশেষ ষষ্ঠ সংসদের মেয়াদ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংসদ ভেঙে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে প্রথম শপথ নিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমেই ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ দুই কারণে বিলুপ্ত হতে পারে। প্রথমত, ৫ বছর অতিবাহিত হলে আর দ্বিতীয়ত, মেয়াদ অবসানের কারণে ভাংগিয়া দিলে। সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্বে ভাংগিয়া দেয়ার পর যে নির্বাচন হয় তারই নাম মধ্যবর্তী নির্বাচন। দেশের জনগণ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হতে দেখেছে আবার মাত্র ৪ কার্য দিবসের সংসদও দেখেছে।
বর্তমান সংবিধানের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন সম্ভব নয় এমন একটি উদ্ভট-বিভ্রান্তিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বের যত দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ গঠন বা সংসদীয় পদ্ধতি বহাল আছে, সেসব দেশেই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
’৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৭(২) অনুচ্ছেদে ছিল- “সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাংগিয়া দিবার জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাংগিয়া দিবেন।” পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ৪র্থ সংশোধনীতেও তা অক্ষত ছিল ১৯৯১ সালের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৭(২) সংশোধন করে বিদ্যমান অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনীর পরই ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ৬ষ্ঠ সংসদ ৪র্থ কার্য দিবসের পর বিলুপ্ত করে ৯৬ সালেই আবারো ৭ম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ষ্ঠ সংসদ নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নেন ও সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার পর মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমেই আজকের প্রধানমন্ত্রী তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেছিলেন। এর পূর্বে ৩য় সংসদ ভেঙে ১৯৮৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ৪র্থ সংসদ ভেঙেও মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯১ সালে। জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে তিন তিনবার সংসদ ভেঙে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কোন বারই সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না হারিয়েও প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভাংগার পরামর্শ দিয়েছেন সে পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাংগিয়া দিয়েছেন। তিন তিনবারই যথারীতি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং সংবিধানে মধ্যবর্তী নির্বাচন সম্ভব নয় এটা সংসদীয় চেতনার পরিপন্থি।
আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দুটো শর্ত আছে। প্রথমত, ৫৭(১) মোতাবেক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দ্বিতীয়ত, ৫৭(৩) মোতাবেক সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদ নেতা সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের সাথে সংসদের অস্তিত্ব জড়িত হয়ে পড়ে। এটাই আমাদের সাংবিধানিক চর্চা। আর আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অক্ষত থাকিলে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর কোন বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করা যাবে না- এটা নিয়তির মতো সুনির্দিষ্ট।
সংসদ ভাংগিয়া দেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ উপেক্ষা করার কোন এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নাই। সংবিধানের ৫৫(২) মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর সকল নির্বাহী ক্ষমতা তার কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হইবে। আমাদের সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাধীন।
সংসদ অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ এ তিনটি এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কার্য করিতে বাধ্য।
সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। আমাদের সংবিধানে ৭২(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাংগিয়া না দিয়া থাকিলে অর্থাৎ কোন জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বা প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতি বা লিখিত পরামর্শ প্রদানের বাস্তবতা না থাকলে রাষ্ট্রপতি এককভাবে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন- সংবিধানে এ নির্দেশনাও রয়েছে। যেখানেই সংসদ আছে সেখানেই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক বিধান আছে। ভারত, জাপানসহ বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশেই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়- আর বাংলাদেশে হতে পারবে না! বিশ্বের গণতান্ত্রিক চেতনাবহির্ভূত কি বাংলাদেশ?
সংবিধানকে আমরা যেন জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির (সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদ) পরিবর্তে ব্যক্তি বা দলের ইচ্ছাধীন না করে ফেলি। গত ৯ম সংসদে সংরক্ষিত সংসদ সদস্য স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার রাষ্ট্রের এ উচ্চতম পদগুলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের সংসদ সদস্যদের জন্য সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত, যা অন্য কারো দ্বারা প্রতিস্থাপিত যোগ্য নয়। সংবিধান জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের ক্ষমতা ও সংরক্ষিত আসনের ক্ষমতা বিভাজিত করে দিয়েছে। এ বিভাজন অপসারিত করার এখতিয়ার সংসদের নেই। সংরক্ষিত আসনের স্পিকার ‘অসংবিধানিক’ এ বিষয়ে আমি মানবজমিনে অভিমত প্রদান করি। পরবর্তীতে ১০ম সংসদে স্পিকার প্রত্যক্ষ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। যা সরকারের অভিনন্দনযোগ্য কাজ।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কী প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে, কীভাবে নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণকে সংকুচিত করা হয়েছে আর পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কীভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়ছে? বিশ্বায়নের লুণ্ঠন প্রতিযোগিতায় কীভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে, কীভাবে জনগণের ক্ষমতায়ন প্রজাতান্ত্রিকতা দুর্বলতর করা হচ্ছে এসব নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল উদ্বিগ্ন নয়। রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ‘উদ্দেশ্য’ ও ‘আদর্শ’ কী? জনগণের ইচ্ছা বা সংকল্প কী? আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই? ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মার সঙ্গে আমাদের কোন ধরনের চুক্তি হওয়া দরকার তা নিয়ে বিতর্ক একেবারেই কম।
বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছাকে পদদলিত করা হচ্ছে। জনগণের ক্ষমতা অর্থাৎ গণভিত্তির ওপর আস্থা নির্মাণ না করে পরাশক্তির অনুগ্রহের ওপর বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্ভর হয়ে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমাগত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সন্ত্রাস-সহিংসতা, যে কোন মূল্যে দমন বা ক্রসফায়ার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
যেহেতু বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়নি- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় চরিত্র পুনর্গঠিত হয়নি। সুতরাং জনগণের মৌলিক-সাংবিধানিক অধিকার অপসারিত হতেই থাকবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার মুক্তিযুদ্ধের এই তিন আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র ও সংবিধান বিনির্মাণ হয়নি বলেই আমরা ক্রমাগত সঙ্কটে আবর্তিত হচ্ছি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টেটলের মতে, “সংবিধান হলো রাষ্ট্রের এমন এক জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র স্বয়ং নিজের জন্য বেছে নিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় সংবিধান হলো লিখিত বা অলিখিত কতগুলো আইনের সমষ্টি যা রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও সরকারের ধরন নির্দেশ করে, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মাঝে ক্ষমতা নির্ধারণ করে এবং জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নির্দেশনা প্রদান করে।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য জাতীয় রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। ২৮শে জানুয়ারি ২০১৫ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) বিচারপতিদের মর্যাদা বাড়িয়ে উচ্চ আদালতে দেয়া রায় নৈতিকতাবিরোধী। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা বাড়িয়ে রায় দিয়েছেন। এ রায় কোন মতে সমীচীন নয়। এ ধরনের রায় পক্ষপাতমূলক। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কোন বিচ্ছিন্ন দেশ নয়’। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ কিভাবে চলে সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী’র এ সাহসী উচ্চারণ জাতিকে উচ্চতম গণতান্ত্রির মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওই বক্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় কেবল আইনগত দিক নয় নৈতিক দিক থাকাও অপরিহার্য, যা তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধি রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত সকলের এবং রাজনীতিতে জড়িতদের নৈতিক জগৎকে আরও বিস্তৃত, আরও সুগভীর এবং আরও উচ্চতম করবে। এ উচ্চতম নৈতিকতার মাপকাঠিতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বর্তমান সংসদ আইনগত কিন্তু কোন ক্রমেই নৈতিকতাপূর্ণ নয়। বিদ্যমান মীমাংসাহীন অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাবে জাতি সেই আশার অপেক্ষায় আছে।
লেখক ও গীতিকার
[email protected]


শেয়ার করুন