মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৫৭‍=১৯

৫৭ ধারা যে একটি নিপীড়নমূলক বিধান এবং ক্ষমতা অপপ্রয়োগের হাতিয়ার, সে প্রশ্নে একধরনের জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। না হলে সরকারের মন্ত্রীরাই বা বারবার কেন আশ্বস্ত করতে চাইবেন যে ওই বিধানটি থাকবে না। তাঁরা অবশ্য এ কথাটিও বলেছেন যে ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য তাঁরা নতুন আইন আনছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তথ্যপ্রযুক্তি-সম্পর্কিত সবকিছুর বিধান রাখা হবে।

৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে এমন একজন ভুক্তভোগী সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ শুক্রবার রাতে আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আইনটি বিলোপের বিষয়ে রোববার সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক হওয়ার কথা আমি জানি কি না। তাঁর মামলায় আদালতে হাজিরার দিন ছিল সোমবার। বিষয়টি আমার জানা ছিল না এবং তখন অনেক রাত বলে খোঁজ নেওয়ারও সুযোগ ছিল না। আমি তাঁকে বললাম, রোববার যদি আইনটি বাতিলও হয় সেই সিদ্ধান্তে আপনি কোনো সুবিধা পাবেন না বলেই আমার ধারণা। সুতরাং আপনার উচিত হবে সোমবার যথাসময়ে আদালতে হাজির হওয়া। নয়তো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে আপনাকে এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে ডায়াবেটিস
নিয়েই কারাগারে যেতে হবে। আমি বলেছিলাম, সাধারণ বিবেচনায় সরকার আইনটি বাতিল করলেও সেই খবর এক দিনের মধ্যে আদালতে পৌঁছাবে না। আর তার চেয়েও যেটি বেশি আশঙ্কার তা হলো পুরোনো মামলাগুলো সচল থাকবে—নতুন আইনে সে রকমই বিধান রাখা হবে।

রোববার আইন মন্ত্রণালয়ে সত্যিই এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে এবং তার আলোচ্য বিষয়ও ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ওই বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, ৫৭ ধারা বিলোপের কাজটি নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত হচ্ছে না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত ৫৭ ধারা আছে ততক্ষণ ওই ধারায় মামলা হতেই পারে। তিনি আরও বলেছেন, ৫৭ ধারায় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময়ে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় বলা আছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার পাশাপাশি ৫৪, ৫৫ ও ৫৬ ধারা রহিত হবে এবং এই চার ধারার অধীন গৃহীত পদক্ষেপ এই আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) অধীন গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে। অতএব ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ পরিস্থিতি থেকে আমাদের নিস্তার নেই।

ইত্যবসরে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকেরা ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন করেছেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কয়েকজন ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। ওই বিভাগ থেকে সদ্য পাস করে বের হওয়া এক সাংবাদিকের ফেসবুকের এক ছবি ও মন্তব্যের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদেই ছাত্রদের ওই কর্মসূচি। ছাত্রছাত্রীদের চাপে নাকি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানি না, কিন্তু কর্মসূচিতে সরকারের ঘনিষ্ঠ (সরকার-সমর্থক নীল দলের নেতা) শিক্ষকনেতাও কড়া বক্তৃতা করেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে ও দলীয় কারণে যেসব কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজকাল সাধারণত শোনা যায় না, সে রকম এক ভাষায় ওই শিক্ষকনেতা বলেছেন, ‘৫৭ ধারায় মামলা হলে জামিন পাবেন না, এটা একটা ভয়ংকর দিক। এই ধারায় যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই হয়রানি করার জন্য করা হচ্ছে।’ বছর তিনেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় বসে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ সমালোচনা করায় যখন রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, তখন অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বগোত্রীয়দের কাউকে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।

প্রায় একই সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষককেও ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্যের জন্য জেলের ভাত খেতে হয়েছে। ২০১৪ সালে ওই শিক্ষকেরা যখন দণ্ডিত হন, সে সময়েই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে আমাদের ৫৭ ধারার অনুরূপ আইন, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (ক) ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। ‘ভারতের আদালত যেখানে পথ দেখাল’ শিরোনামে তখন প্রথম আলোতেই আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, ভারতবাসীর মতো কপাল কি আমাদের হবে? আমাদের আদালতে ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলা হলেও সেগুলোর শুনানি এখনো শেষ হয়নি। বিপরীতে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। মাস দুয়েকেরও বেশি আগে ২ মে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ৫৭ ধারা থাকবে না (সমকাল, ৩ মে, ২০১৭)। কিন্তু তারপর থেকে এ পর্যন্ত না হলেও ২০ জনের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে।

গত তিন বছরেও আমাদের কথিত অগ্রসরনাগরিক গোষ্ঠীগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি যে কালো আইন, তা বাতিলের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারেনি। অবশ্য পারেনি শব্দটা বোধ হয় যথাযথ নয়। আসলে তারা চাপ তৈরি করতে চায়নি। কেননা, রাজনৈতিকভাবে তখন মুক্তচিন্তার পক্ষে দাঁড়ালে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি কিছুটা সুবিধা পেয়ে যেতে পারে, সেই আশঙ্কাই তাদের কাছে ছিল প্রধান। আমাদের একটা বড় অংশের কাছেই তখন আওয়ামী লীগ ভালো হলেও ভালো, মন্দ হলেও ভালো—তার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং সরকার দুর্বল হতে পারে এমন কোনো দাবি থেকে দূরে থাকাই তখন এরা শ্রেয়জ্ঞান করেছে। আর, বিরোধী দল বিএনপি যে এই কালো আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তেমন ভাবনার কোনো অবকাশ আছে কি? এই মূল আইনটি তো তাদেরই সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগ যে তা আরও কঠোরতর করেছে, তাতে বরং তারা স্বপ্ন দেখবে যে ক্ষমতায় যেতে পারলে সেটি না জানি তাদের জন্য কত বড় একটা হাতিয়ার হবে।

শুরুতেই বলেছি, ৫৭ ধারাকে কালো আইন গণ্য করার প্রশ্নে তেমন একটা মতভিন্নতা নেই। তাহলে কেন সরকার অবিলম্বে এই আইন প্রয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিচ্ছে না? ত্রুটিপূর্ণ আইন রহিত করা কি এতই কঠিন? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, পুলিশ যেকোনোভাবেই হোক এই আইনটি বহাল রাখতে চায়। সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় (১৯ ধারা)তাই দেখা যাচ্ছে, হুবহু ওই বিধানটিতেই (৫৭ ধারা) নতুন মোড়ক লাগানো হয়েছে। মোড়কটি হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারা। এখানেও সেই কথিত মানহানি, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার চেষ্টার সংজ্ঞায়ন হয়েছে। হেরফের হয়েছে শুধু সাজার মাত্রায়—এখন আছে দশ বছরের জেল এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা, নতুন খসড়ায় দুই বছরের জেল এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা। আরও একটা পার্থক্য আছে—নতুন আইনে জামিনের সুযোগ থাকছে, যা এখন নেই। তবে এখনো আদালত অজামিনযোগ্য আইন থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে জামিন দিয়েছেন, এমন নজির আছে।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর অবশ্য বাড়তি আরেকটি নিরোধকের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই খসড়ার ১৫ ধারার ৫ উপধারায় বলা হচ্ছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাহাতে মদদ প্রদান করে তা ডিজিটাল নাগরিক সন্ত্রাসী কর্মসংঘটনের অপরাধ করিয়াছে বলে গণ্য হইবে।’ এর আগে যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ আইনের কথা শোনা গিয়েছিল, তারই কিছু অংশ এই ডিজিটাল অপরাধ আইনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণায় সরকার অনুমোদিত ভাষ্যের সঙ্গে মেলে না এমন কিছু প্রকাশ, প্রচার বা আলোচনা তখন ইন্টারনেটে অসম্ভব হয়ে পড়বে। ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য তখন সরকারি ভাষ্যের পাখির পাঠ ছাড়া আর নতুন কিছু জানা অথবা ভাবার সুযোগ রহিত হয়ে পড়বে—এমন আশঙ্কাই প্রবল।

ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত, ব্যক্তির স্বাধীনতা, তথ্য পাওয়ার অধিকার, গোপনীয়তা রক্ষা এবং নানা ধরনের অপরাধ থেকে সুরক্ষার বিষয়গুলো ডিজিটাল নিরাপত্তার অংশ। ইন্টারনেট ব্যবহার করে নতুন নতুন উপায়ে প্রতারণা, অন্যকে হয়রানি এবং হুমকি দেওয়ার মতো অপরাধ অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসবাদের উপদ্রব—উগ্রবাদী ভাবাদর্শের প্রচার, প্রসার, প্রশিক্ষণের নির্দেশিকা বিতরণ এবং গোপন যোগাযোগের বিষয়গুলো নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সাইবার অপরাধ এবং উগ্রবাদ মোকাবিলার সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়গুলোকে গুলিয়ে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা সবাই জানি সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেসব দেশ ইসলামের নামে উগ্রবাদী সহিংসতার শিকার হয়েছে, তার মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম। তো এই উগ্রবাদী হুমকি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে প্রয়োজনে মানবাধিকার আইন উল্টে ফেলার কথা বলেছেন। গত ২৬ জুন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যেইদ রাদ আল হুসেইন ব্রিটেনের ল সোসাইটিতে এক বক্তৃতায় এর জবাবে বলেছেন, ব্রিটেনের সাধারণ আইনেও একজন অপরাধীর কিছু অধিকার স্বীকৃত। তিনি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করার বিপদ সম্পর্কে বলেন, এর ফলে শুধু স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরাই উজ্জীবিত হবেন।

২০১৫ সালের ২৪ মার্চ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৬৬ (ক) ধারা বাতিলের যে রায়টি দিয়েছিলেন, সেই রায়ের কথাই আবার স্মরণ করতে চাই। কেননা, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রায় সবখানেই আইনগুলোয় মিল রয়েছে এবং ভারতের উচ্চ আদালতের রায় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ২০০ পৃষ্ঠার ওই রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (ক) ধারা অসাংবিধানিক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে একটি বাধা। আদালত আরও বলেছেন, জনগণের জানার (তথ্য পাওয়ার) অধিকার এই ধারায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রায়ে অনলাইনে সেন্সরশিপ সম্পর্কেও কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারতে সুপ্রিম কোর্টের আগে পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্টেও এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রায় হয়েছে, যাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশের দায়ে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেলে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল।

ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবক, ব্রিটেনের স্যার টিম বার্নার্স লি ইন্টারনেটে অবাধ স্বাধীনতার অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর মতে, ওই স্বাধীনতা নেট ব্যবহারকারীর মৌলিক মানবাধিকার এবং এই অধিকার বা স্বাধীনতায় সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ৫৭ ধারার কালো থাবার ভয়াবহতা যাঁরা দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন, তাঁদের তাই উচিত হবে নতুন মোড়কে তা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া।

কামাল আহমেদ:

সাংবাদিক

—প্রথম আলো


শেয়ার করুন