‘মজার স্কুল’ কারাগার থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে

2015_10_28_15_23_26_via5HriCJ3vxN8hwWpS56DDBvTCPr0_originalসিটিএন ডেস্ক :

এটা একটা স্বপ্নের ছোট একটা অংশ, স্থায়ী শেল্টার হোমের পথের শিশুরা এমন একটা পরিবেশ বান্ধব ইশকুলে পড়াশোনা করবে। এক সাথে কমপক্ষে ২০০ শিশু এই ইশকুলে পড়তে পারবে এমন পরিকল্পনাই আমাদের ছিল। থাকবে কম্পিউটার ল্যাব, প্রযুক্তির নানা আয়োজন। ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া আমরা পথের শিশুদের মাঝেও ছড়াতে কাজ করছি অবিরাম।

এমন ‘ক্যাপশন’ দিয়ে ‘মজার স্কুলের’ ফেসবুক ফ্যান পেজে একটা ঝকঝকে নকশা পোস্ট করা হয়েছে। দেখলেই মনে হয় এক স্বপ্নপুরী। এই স্বপ্নপুরী স্বপ্নদ্রস্টারা ক’দিন আগেও ‘রাক্ষস’ হিসেবে বন্দি ছিলেন কারাগারে। ভাটা পড়েছিল স্বপ্নের রথ ওড়ানোয়। আবার মুক্ত হয়েছেন তারা।

এবার সরাসরি আমন্ত্রণ মিললো প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেই। উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের আমন্ত্রণে মজার স্কুলের জামিন প্রাপ্ত এই চার তরুণ মঙ্গলবার গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। দেখা করেছেন বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকও করেছেন তারা। সাক্ষাতে মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এই তরুণদের সঙ্গে মজার স্কুল নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত সচিব কবির বিন আনোয়ার। সেখানেই মধ্যাহ্ন ভোজও সেরেছেন তারা।

তবে এতেই তৃপ্ত হননি মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। জানতে চেয়েছেন তাদের পুরো স্বপ্নটাই। তাই আগামী সপ্তাহে একটা ঘরোয়া আড্ডারও আয়োজন করেছে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘গতকাল আমরা উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে আমরা সবকিছু জানাতে পারিনি। তাই আমরা একটা ঘরোয়া আয়োজনে কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। উনারাও আসবেন বলে কথা দিয়েছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ওইদিনই আমাদের পুরো প্রজেক্টটা তাদের সামনে তুলে ধরবো।’

উল্লেখ্য গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকার একটি বাসা থেকে ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি নতুন বেসরকারী সংস্থা অদম্য ফাউন্ডেশনের শেল্টারহোম থেকে ১০টি ছিন্নমূল শিশুকে উদ্ধারের ঘটনায় ৪ কর্মকর্তা আরিফুর রহমান (২৪), হাসিবুল হাসান সবুজ (১৯), জাকিয়া সুলতানা (২২) ও ফিরোজ আলম খান শুভকে (২১) গ্রেপ্তার করে রামপুরা থানার পুলিশ। এরপর তাদের ২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

ওইদিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানিকালে ম্যাজিস্ট্রেট এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের সাথে কথা বলেন। ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চান, কীভাবে তারা শিশুদের সংগ্রহ করতেন? জবাবে আসামি আরিফুর বলেন, ‘ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন- সদরঘাট, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কমপক্ষে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস বিভিন্ন ছিন্নমূল বাচ্চাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে। যদি দেখা যায় একই বাচ্চা দিনের পর দিন একই স্থানে থাকছে এবং অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তখন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদেরকে আমাদের শেল্টারে আসার জন্য বলতো। যারা আগ্রহী হতো তাদেরকে নিয়ে আসা হতো।’

এরপর বিচারক ওইসব আসামিদের আর কোনো বক্তব্য শুনতে চাননি। আদালতের বাইরে এসে ওই চার আসামির আত্মীয়-স্বজন এবং উদ্ধারকৃত ১০ শিশুর মধ্যে ছয় শিশুর অভিভাবকদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবা করতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়া ওই চার তরুণের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও মামলার এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের বড় বোন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বাংলামেইলকে জানান, গত প্রায় তিন বছর ধরে তার একমাত্র ভাই ছিন্নমূল বাচ্চাদের উন্নত জীবনদানের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সে তাদের পরিবারকে কোনো সময় দিত না। আমরাও তার কাছে সময় চাইনি। আমরা চেয়েছি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হউক। কিন্তু আজ এটা কি হচ্ছে? বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

তার সাথে থাকা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করা আরো প্রায় ৭ থেকে ৮ জন তরুণীও কাঁদতে শুরু করেন। এছাড়া পাশে থাকা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অন্তত ২০-২৫ যুবকও তাদের ওই চার কর্মকর্তার নিঃস্বার্থ সমাজসেবার কথা এবং এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা জানান। টিভিতে এই সম্পর্কিত সংবাদ দেখে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ছুটে আসেন অনেক যুবক।

ভৈরব থেকে আসা সুব্রত সাহা নামে এক কলেজ পড়ুয়া যুবক জানান, তারা ফেসবুকের প্রায় শতাধিক বন্ধু নিজেদের সিগারেট খাওয়ার টাকা জমিয়ে প্রতি মাসে দেড়শ টাকা করে এখানে দেন। অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যানও তাদেরকে মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য দিতেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবীদের কয়েকজন। বর্তমানে ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান হজ করার জন্য সৌদি আরবে আছেন।

উদ্ধারকৃত বাচ্চারা হলো- মোবারক হোসেন (১৪), আবদুল্লাহ আল মামুন (১১), বাবুল (১০), আব্বাস (১০), স্বপন (১১), ইব্রাহিম আলী (১০), রাসেল (১০), ফরহাদ হোসেন (৯), আকাশ (৯), ও রফিক (১৪)।

এরপর উদ্ধারকৃত ওই ১০ শিশুর মধ্যে নয়জনের সাথে কথা বললে সবাই একবাক্যে রিমান্ডকৃত কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে। ওইসব বাচ্চাদের মধ্যে স্বপন, বাবলু, আকাশ, রফিক, রাসেলকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমরা সেখানে কেমন আছো? উত্তরে জানায়, সেখানে বেশ ভালো আছে তারা। তোমরা আবারো সেখানে ফিরে যেতে চাও কি না। শিশুরা বলে, হ্যাঁ আমরা ফিরে যেতে চাই।

তখনই পাশে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল বলে, কিসের ফিরবে? ওইখানে কোনো পড়ালেখার ব্যবস্থা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই, কোথায় যাবে এরা?’ সাথে সাথেই ওই পুলিশের মুখের উপর কড়া প্রতিবাদ জানায় ওই শিশুরা। তারা বলে, হেয় তো দেহি কিচ্ছুই জানে না।

এরপর বাংলামেইলের পক্ষ হতে শিশুদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমাদের সেখানে টিভি আছে কি না? জবাবে ওরা বলে, আমাদের টিভি আছে, আমাদের খেলার জন্য ছোট ছোট বল আছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে কম্পিউটার কম্পোজ শিখানো হচ্ছে বলেও জানায় ওইসব শিশুরা।

তবে উদ্ধারকৃত শিশুদের মধ্যে কুমিল্লার মোবারক হোসেনকে অন্যসবার কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। নয় শিশুকে রাখা হয়েছে সিএমএম আদালতের নীচে বিচারপ্রার্থীদের ওয়েটিং রুমে। আর মোবারককে রাখা হয়েছে গারদখানার ভেতর কোনো একটা রুমে। অনেক চেষ্টা করে তার সাথে কথা বলা যায়নি। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ওই শিশুর চাচা মো. মনির হোসেনের মামলার ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ।

এজাহারে বর্ণিত বাদির বক্তব্য মতে, গত ছয়মাস ধরে মোবারককে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে উপস্থিত প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, ওই ছেলেটি কখনোই তার সঠিক কোনো ঠিকানা বলতে পারেনি। সে কখনোই কোথাও যেতেও চায়নি। হঠাৎ করে পুলিশের অভিযান এবং ওই বাচ্চার বক্তব্যে আমরাও বিস্মিত।

উদ্ধারকৃত শিশু রাসেলের বাড়ি ময়মনসিংহে। তার বাবা মো. জামাল উদ্দিন বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি স্যারদের মুক্তি চাই। এরা খুব ভালো মানুষ। আরিফ স্যার ও জাকিয়া ম্যাডাম আমার ছেলেরে নিয়া গত নয় মাসে দুইবার আমার বাড়িতে গেছে। আপনারা দেখেন তাদের লাগি কিছু করতে পারেন কি না।’

উদ্ধারকৃত শিশুদের বক্তব্য এবং রিমান্ডকৃতদের আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের চোখের পানি ও আকূতি দেখে এই কথা বলা যায় যে, নিঃস্বার্থ সমাজ সেবা করতে গিয়ে ওইদিন রিমান্ডে যেতে হয় অদম্য বংলাদেশ ফাউন্ডেশনের অদম্য চার কর্মীকে।

অবশেষে গত ১৯ অক্টোবর অদম্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ৪ কর্মকর্তাকে রামপুরার একটি শেল্টার হোম থেকে ১০ ছিন্নমূল শিশুকে উদ্ধারের মামলায় অবশেষে জামিন দেন ঢাকার সিএমএম আদালত।


শেয়ার করুন