ভিসি, ছাত্রলীগ ও জাফর ইকবাল প্রসঙ্গ

Golam-Mortoza6-400x400গোলাম মোর্তোজা

 শিক্ষকের কাছে একজন ছাত্র সন্তানতুল্য। ছাত্রছাত্রী ভুল, অন্যায় বা অপরাধ যাই করুক না কেন, অভিভাবক হিসেবে একজন শিক্ষক ক্ষমা করবেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেই বিবেচনায় ড. জাফর ইকবাল ক্ষমা করতেই পারেন, ড. ইয়াসমিন হকসহ শিক্ষকদের যারা লাঞ্ছিত করেছে সেই সব ছাত্রদের।
ড. জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘এই ছাত্রলীগের ছেলেদের শাস্তি দেয়াটা এক ধরনের অন্যায়। যারা তাদের পাঠিয়েছে, তাদেরকে শাস্তি দেন।’
প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগের ছেলেরা অপরাধ করেছে, না করেনি? যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে ‘শাস্তি দেয়া অন্যায়’ কেন? ড. জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমিন হক নিজে মুখেই তো বলেছেন, শিক্ষকদের গায়ে হাত দিয়েছে এই ছাত্ররা।
ড. জাফর ইকবাল বলতে পারেন, ঠিক আছে তারা ভুল করেছিল। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করতে পারেন শাস্তি না দিতে। কিন্তু শিক্ষকদের পেটানোর অপরাধে শাস্তি দিলে সেটা অন্যায় কোন বিবেচনায়?
‘ছাত্রলীগের ছেলেদের শাস্তি দেয়া অন্যায়’- স্যারের এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা যে কেউ এভাবে করতেই পারেন, ছাত্রলীগের ছেলেদের শাস্তি দেয়া অন্যায়, অন্য দলের হলে শাস্তি দেয়া যাবে? আশা করছি স্যারের কাছ থেকে এই বক্তব্যের নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা পাব।
‘যারা পাঠিয়েছেন, তাদের শাস্তি দিন’- এই বক্তব্যে ড. জাফর ইকবাল ভিসিকে বুঝিয়েছেন। বোঝাতেই পারেন। কারণ ভিসি ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন। অবশ্যই তদন্তের ভিত্তিতে ভিসির শাস্তি হওয়া উচিত। ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়েছেন। কিন্তু যারা সরাসরি শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করল, সেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ‘বাচ্চা ছেলে’ বলে দায়মুক্তি দেয়া যায়? ছাত্রলীগের এই ছেলেদের বিরুদ্ধেই তো জাফর ইকবাল আগের দিন অভিযোগ করেছেন, ‘ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি করে। পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছে।’
বাচ্চা ছেলেরা ‘শিক্ষক পেটাবে’ অন্যের বুদ্ধিতে, চাঁদাবাজি করবে, তাদের শাস্তি দেয়া যাবে না, শাস্তি দিলে ‘অন্যায়’ হবে?
২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে গেলেন। তিনি আপনাদের ছাত্রদের ‘মিসগাইডেড’ করে আপনাদেরকে লাঞ্ছিত করালেন!
ড. জাফর ইকবাল আপনি এখন বলছেন, ‘আগাছাকে আমরা ফুলগাছে পরিণত করব। সম্ভব। আমাদের ছাত্র, আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। আমরা ওদেরকে ঠিক করে দেব।’
আপনারা এতদিন তাহলে কি পড়ালেন, কি শেখালেন আপনাদের ছাত্রদের? একজন তাদের ‘মিসগাইডেড’ করল আর আপনাদের ছাত্ররা আপনাদের লাঞ্ছিত করল? এতদিন এদের ফুলগাছে পরিণত করেননি কেন? আপনি প্রধানমন্ত্রীকে বলছেন, ‘এরা আমাদের ছাত্র, আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন’। প্রধানমন্ত্রী কি করে ‘ছাত্রদের’ আপনাদের কাছে পাঠাবেন? এরা কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকে? এরা তো আপনাদের কাছে থাকে। প্রধানমন্ত্রীকে পাঠাতে বলছেন, কোন হিসেবে, কোন বিবেচনায়?
আপনার কাছে এসে যখন ৫ লাখ টাকা চাঁদার কথা বলল, তখন ‘মাথায় হাত বুলিয়ে’, কথা বলে, ঠিক জায়গায় নিয়ে আসেননি কেন?
ড. জাফর ইকবাল আপনি আমাদের এত প্রিয়, এত শ্রদ্ধার মানুষ, কিন্তু আপনার এক কথার সঙ্গে আরেক কথা মেলাতে পারছি না।
আপনি আপনার ছাত্রদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে ‘যন্ত্রণা’য় ভুগছেন। আমরা আপনার কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে না পেরে যন্ত্রণায় ভুগছি। কি করে আপনি, আপনার মতো একজন মানুষ এমন এলোমেলো কথা বলতে পারেন, তা কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না।
৩.
ড. জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমিন হক আজ আপনারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, তার অর্থ এই নয় যে, ছাত্রলীগ এই কাজ এই প্রথম করল। এটা শুধু আপনাদের সমস্যা নয়, সারা দেশের সমস্যা। মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দেই-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে শিক্ষকদের পিটিয়েছে ছাত্রলীগ।
বুয়েটের একজন শিক্ষককে আটকে রেখে পেটানো হয়েছে। বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শ্রেণিকক্ষে আটকে শিক্ষক পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ শিক্ষক পিটিয়েছে বরিশাল বিএম কলেজে।
সারা দেশে ছাত্রলীগের হাতে গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৬৫-৭০ জন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন, পিটুনি খেয়েছেন। এই হিসেবে কিন্তু আপনাদের লাঞ্ছিত হওয়ার বাইরে।
সারা দেশে যারা শিক্ষক পিটিয়েছেন তাদেরকে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলছেন?
নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই যদি ‘ফুলগাছে’ পরিণত করতে না পারেন, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ঠিক করে দেবেন, এই বিশ্বাস কি রাখা যায়?
ড. জাফর ইকবাল আপনি লাঞ্ছিত হওয়ার পর একটি মহল প্রচারণা চালাচ্ছিল, নিজে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে এখন কথা বলছেন। অন্য শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হয়েছেন, কিন্তু এতদিন আপনি কথা বলেননি। এই প্রচারণা বিশ্বাস করিনি, বিশ্বাস করতে চাইনি। এর বিরুদ্ধে বলেছি, লিখেছি। কিন্তু আপনার এখনকার অবস্থান দেখে ‘প্রচারণা চালানো মহলটির বিরুদ্ধে’ জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছি না।
সত্যি যন্ত্রণায় ভুগছি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে গ্রাম থেকে আসা। তাদের একটা বড় অংশ সাধারণ কৃষকের সন্তান। রক্ত ঘাম করা কষ্টে উৎপাদিত ধান বিক্রির অর্থে তারা পড়াশোনা করেন। তাদের কারও পরিচিতি ছাত্রলীগ, কারও পরিচিতি ছাত্রদলৃ। নষ্ট রাজনীতি তাদের বিবেকে পচন ধরায়। কেউ কেউ হয়ে ওঠে চাঁদাবাজ-মাস্তান-সন্ত্রাসী। একজন হত্যা করে আরেকজনকে। সামগ্রিকভাবে পচে যাওয়া সমাজেরই চিত্র এটা।
যখন এদের কেউ গুরুতর আহত হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়, বৃদ্ধ কৃষক বাবার যে কষ্ট, পুরো পরিবারের যে যন্ত্রণা, তা অবর্ণনীয়। ড. জাফর ইকবাল আপনি হয়ত সেই বিবেচনার থেকেই কথা বলছেন।
কিন্তু অন্যায় অপরাধের যদি শাস্তি দেয়া না হয়, তবে কি পরিবেশের উন্নতি না আরও অবনতি হবে?
আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যত অঘটন ঘটিয়েছে, তার প্রায় অনেকগুলোর পেছনেই রাজনৈতিক নেতা বা শিক্ষক নেতা-ভিসিদের কোনো না কোনোভাবে ইন্ধন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের স্মৃতি তো এখন জ্বলজ্বল করছে। ভিসি আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী তখন ছাত্রদলকে ব্যবহার করে কি অপকর্মই না করিয়েছিল!
আপনার কথা অনুযায়ী সেই ঘটনার জন্যেও তো ছাত্রদলকে দায়ী করা যাবে না। শিবির যে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের হত্যা করে, রগ কেটে দেয়, তার পেছনেও তো কোনো কোনো শিক্ষক বা জামায়াত নেতাদের ইন্ধন থাকে। তাহলে শিবিরকে দায়ী করবেন কিভাবে, শাস্তি দেবেন কিভাবে?
ড. জাফর ইকবাল আপনার কথায়, আপনার অবস্থান বড় বেশি রকমের স্ববিরোধী মনে হচ্ছে। জানি না আপনি ব্যাখ্যা দিয়ে আপনার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারবেন কিনা, নাকি আরও এলোমেলো করে ফেলবেন, জানি না!
৪.
ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি বক্তব্য বা একটি কাজ, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে। প্রশ্ন হলো ড. জাফর ইকবাল সারা জীবন কি করেছেন?
তিনি যা করেছেন, তা দিয়ে কারা উপকৃত হয়েছেন?
কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন?
তিনি যা করতেন, তা যদি না করেনÑ তাহলে কি হবে?
তাতে ক্ষতি কাদের, লাভ কাদের?
জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। তাদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীরা তাকে অনুকরণ-অনুসরণ করেন, করতে চান। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন শিক্ষকের বড় বেশি রকমের আকাল। তবে আমার বিবেচনায় ড. জাফর ইকবাল তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীদের মানস গঠনে। তিনি যা লেখেন যা বলেন, বলার এবং লেখার ভাষা থাকে অতি সাধারণ-সরল। তথ্য ভারাক্রান্ত বা ভাষার মারপ্যাঁচ থাকে না তার লেখায়, বলায়। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার কথা শুনলে, লেখা পড়লে মনে হয় তিনি সত্য বলছেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
শিশু-কিশোররা গত পনের বিশ বছর ধরে তার লেখা পড়ছে। শিশু-কিশোরদের বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্টুমির গল্প লেখেন তিনি। পাঠক শিশু-কিশোর গল্পের চরিত্রের স্থানে নিজেকে কল্পনা করে নিতে পারে। তাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। তার লেখা সায়েন্সফিকশন শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ তৈরি করে।
আর একটি কাজ করেন জাফর ইকবাল। লেখার বিষয়বস্তু করেন মুক্তিযুদ্ধ।
জাতীয় বীরদের তিনি তার লেখার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের সংগ্রাম, ত্যাগ, সাহস, বিচক্ষণতা, দেশের প্রতি ভালোবাসার বিষয়গুলোকে এমনভাবে তার লেখায় তুলে ধরেন, এক একজন মুক্তিযোদ্ধা শিশু-কিশোরদের মননে সত্যিকারের হিরোর মর্যাদা পান। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি স্থায়ী শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তৈরি হয় শিশু-কিশোরদের মনে। কত কষ্ট-দুঃখ, কত প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা তিনি তুলে ধরেন তার লেখায়।
এই বাংলাদেশের জন্ম যারা চায়নি, সেই সময় শিশু-কিশোরদের যারা হত্যা করেছে, মা-বোনদের লাঞ্ছিত করেছে, তরুণ-যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, তাদেরকে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ড. জাফর ইকবাল। তিনি শিশু-কিশোরদের মুক্তচিন্তা করতে শেখান।
যেহেতু জাফর ইকবাল যা বলেন, শিশু-কিশোররা তা পুরোপুরি বিশ্বাস করে, ফলে অসত্য তথ্য দিয়ে তাদের আর বিভ্রান্ত করা যায় না। আজকের কিশোর তরুণদের সবচেয়ে বড় অংশটি যে হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণ করে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে সোচ্চার থাকেÑ তার পেছনে বিশাল অবদান ড. জাফর ইকবালের।
৫.
সরল ভাষায় লেখা ড. জাফর ইকবালের রাজনৈতিক লেখাগুলোও সব বয়সী পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সব পাঠক তার লেখা বিশ্বাস করেন।
তিনি যেহেতু রাজনীতির মানুষ নন, শিক্ষক রাজনীতির মারপ্যাঁচ কূটকৌশল থেকে দূরে থাকেন, রাজনীতিকে দেখতে চান, দেখেন সরলভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বলতাটা তৈরি হয়ে যায় এখানে। নিজে সত্য বলেন, অন্যরাও সত্য বলবেন, এই বিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি দেখতে চান। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এমন কিছু বিষয়ের পক্ষে লিখে ফেলেন বা অবস্থান নিয়ে নেন, যা অনৈতিক, যা অসত্য। যা তার চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। তিনি বুঝে, সুবিধা নেয়ার মানসিকতায় এমন কিছু করেন, তা একেবারেই সত্যি নয়।
ছাত্রলীগ শিক্ষক পেটায়, তা নিয়ে লিখলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, হয়ত তিনি এমন মানসিকতা ধারণ করেন। তাই হয়ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন ভিসিকে সমর্থন করতে গিয়ে অনৈতিকতার পক্ষে, শিক্ষকদের বড় একটি অংশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেলেন। অথচ সেই শিক্ষকরাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষেরই মানুষ। সেই সময় তিনি যা লিখেছিলেন আর এখনকার তার যে আন্দোলনÑ পরস্পরবিরোধী।
ছাত্রলীগকে দিয়ে ভিসি আমিনুল হক ভূঁইয়া ড. ইয়াসমিন হকসহ অন্য শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করিয়েছেন। ছাত্রলীগ হত্যাকা- ঘটায়, ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি করে, ছাত্রলীগ ভাড়াটে মাস্তানের ভূমিকা পালন করে, সন্ত্রাস করে, শিক্ষক পেটায়Ñ এসবের কোনো কিছুই জাফর ইকবালের অজানা নয়। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি, ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সবার আগে জাফর ইকবালের কাছ থেকেই আসা উচিত, মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু যখন জাফর ইকবাল বলেন ‘ছাত্রলীগের ছেলেরা বাচ্চা, তারা কিছু বোঝে না, তাদের শাস্তি দেয়া অন্যায়’Ñ তা মানুষকে বিস্মিত করে, ক্ষিপ্ত করে। তাকে যারা পছন্দ করেন, অনুসরণ করেন, বিশ্বাস করেন তারাও ভাবতে বাধ্য হন, তাদের মনেও প্রশ্ন তৈরি হয়, জাফর ইকবালও কি সুবিধা নেয়ার জন্যে এমন বলছেন?
আর এই সুযোগটিই নিচ্ছে জাফর ইকবাল বিরোধী পক্ষ।
আমার ‘ড. জাফর ইকবাল আমরাও যন্ত্রণায় ভুগছি’ শিরোনামের লেখাটির ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গেছে। অনেকেই মন্তব্যে যৌক্তিক সমালোচনা করেছেন, যারা জাফর ইকবালকে পছন্দ করেন। জাফর ইকবালকে যারা অপছন্দ করে, সেই বিরোধী পক্ষকে বিষোদ্গারে মেতে উঠতে দেখা গেছে।
কারা জাফর ইকবাল বিরোধী পক্ষ?
এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কারণ জাফর ইকবালের লেখায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয়েছে এরাই। জাফর ইকবাল যদি বিতর্কিত হয়ে যান, জাফর ইকবালের ইমেজ যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, তার কথা যদি মানুষ আর বিশ্বাস না করেনÑ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারা?
যারা মুক্ত চিন্তা করেন, ধর্ম নিরপেক্ষ, উদার মানসিকতার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি। আওয়ামী লীগের চরিত্র পুরোপুরি এমন নয়। কিছু দোষ-ত্রুটি, স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগই যার প্রতিনিধিত্ব করে। আর কোনো বিকল্প নেই বলে জাফর ইকবালদের চাইতে হয়, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকুক। জাফর ইকবালের লেখায় সবচেয়ে বড়ভাবে উপকৃত হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের পক্ষে লেখা বুদ্ধিজীবীদের কথা দেশের মানুষ তো নয়ই, আওয়ামী লীগ যারা করেনÑ তারাও বিশ্বাস করেন না। জাফর ইকবাল যা লেখেন, আওয়ামী লীগ যারা করেন না তারাও বিশ্বাস করেন। এর ফল ভোগ করে আওয়ামী লীগ।
৬.
সেই আওয়ামী লীগও জাফর ইকবালকে বিতর্কিত করার মহান দায়িত্ব অসততার অভিযোগে অভিযুক্ত ভিসির মাধ্যমে ছাত্রলীগের হাতে তুলে দিয়েছে। জাফর ইকবাল আবার সেই ছাত্রলীগকেও রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ড. জাফর ইকবাল বড় ভুলটি করে ফেলেছেন এখানেই।
আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকতে না চায়, ছাত্রলীগকে যদি শিক্ষক পেটানোর-সন্ত্রাসের লাইসেন্স দিয়ে দেয়, সেই আওয়ামী লীগকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেন জাফর ইকবালকে নিতে হবে? কেন নিজেকে বিতর্কিত করে শিশু-কিশোর, তরুণসহ দেশের মানুষের মনে আঘাত দেবেন জাফর ইকবাল? তিনি এই কাজ করতে পারেন না। দেশের মানুষ জাফর ইকবালের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশা করেন না।
ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকল কি থাকল না, তা দেখার দায়িত্ব জাফর ইকবালের নয়। যে কাজ তিনি করছেন, সেই কাজ তিনি করে যাবেনÑ দেশের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করেন। তার কাজের সুফল আওয়ামী লীগ ভোগ করুক, দেশ উপকৃত হোক, মানুষের তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি প্রকাশ হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগের অন্যায়-অপরাধ-অনৈতিকতার পক্ষে জাফর ইকবালের অবস্থান চলে গেছে, তাতে মানুষের প্রচ- আপত্তি আছে।
জাফর ইকবালের মতো একজন মানুষ বিতর্কিত হয়ে যাক, তার কথা শিশু-কিশোর .. দেশের মানুষ বিশ্বাস না করুক, তেমন অবস্থা তৈরি হওয়া কোনো ভাবেই প্রত্যাশিত নয়। যা ‘গাছেরও খাওয়া তলারও কুড়ানো ‘আওয়ামী লীগ বুঝবে না। আওয়ামী লীগই যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই আওয়ামী লীগ তাও বুঝবে না।’
সুতরাং বুঝতে হবে ড. জাফর ইকবালের নিজেরই। শুধু তার নিজের জন্যে নয়, দেশের জন্যেÑ দেশের মানুষের জন্যে, তার ভক্ত শিশু-কিশোরদের জন্যে তাকে বুঝতে হবে। না হলে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সাপ্তাহিক


শেয়ার করুন