ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কায় ২ লাখ রোহিঙ্গা

সিটিএনঃ
ভারি বর্ষণ হলেই কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঝুপড়ি ঘরে বসবাসকারী প্রায় ১২ লাখ মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। গভীর ঘুমের মধ্যেও আঁতকে উঠে রোহিঙ্গাদের মন। তাদের শঙ্কা এই বুঝি পাহাড় ধসে মাটি চাপায় অকালে ঝরবে প্রাণ!

বর্ষা শুরুতেই শনিবার (৫ জুন) পাহাড় ধ্বস ও মাটি চাপায় মারা গেছেন নারীসহ দুইজন রোহিঙ্গা। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ একর বনও।

এ ছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

উখিয়া বালুখালী ও টেকনাফের চাকমারকুলে পাহাড়ের পাদদেশে চরম ঝুঁকির মাঝে বসবাসকারী প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে দিনদিন। বাড়ছে পাহাড় ধসের মৃত্যুর শঙ্কা। প্রতি বছরই পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল বাড়ে। সেই মিছিলে স্বজনহারাদের কান্নার আওয়াজে ভারি হয় সবুজ পাহাড়ের আকাশ-বাতাস। লাশের সারি আর পাহাড়ে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের গগণবিদারী আওয়াজে শোকে স্তব্ধ হয়।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ঘর। যার ফলে পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।উখিয়া বালুখালী ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী অনেকেই জানান, এখানে বসবাস করছি কোথাও জায়গা না পেয়ে। বাধ্য হয়ে এখন পাহাড়ের ঢালুতে কোনরকম আছি কিন্তু বর্ষাকাল আসছে এখন থেকে বুক কাঁপছে। এখন থেকে মৃত্যুর ভয় কাজ করছে।

শনিবার (৫ জুন) সকালে ও দুপুরে প্রবল বর্ষণের সময় এই পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ১২ নাম্বার ক্যাম্পের রফিক উল্লাহ (৩২) এবং টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়নের চাকমারকুল ২১ নাম্বার ক্যাম্পের নুর হাসিনা (২০) পাহাড় ধ্বসে মারা যান ।

নিহত রফিক উল্লাহ (৩২) ৭ নাম্বার জে ব্লকের অছিউর রহমানের ছেলে ও অপরজন টেকনাফ চাকমারকুল ২১ নাম্বার ক্যাম্পের ব্লক এ-এর ১৮ নাম্বার বাড়ির শাকের আহমদের স্ত্রী।অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

করোনা সংকটের মাঝেই এসেছে বর্ষা৷ কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা৷ ইউএনএইচসিআর বলছে, করোনার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় সেখানে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া যায়নি আর তাই ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে৷
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশিদ বলেন-অতিঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা এলাকায় তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবকও প্রস্তুত রয়েছে।বর্ষার মৌসুম আমাদের মাথায় আছে ৷ সব মিলিয়েই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি৷

এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ছাড়াও ইউএনএইচসিআর, আইওএম, ব্র্যাক এবং তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বড় আকারে কাজ করে৷ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০২০ সালের বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় কয়েক হাজার পরিবার সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যূত হন৷ ক্ষতিগ্রস্ত হন হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ৷

ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, শরণার্থীদের জীবন রক্ষার কৌশলগুলো শেখানো হচ্ছে৷ তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবককে দ্রুত সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে৷ তারপরও বর্ষা মৌসুমে ভূমিধস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা করা হচ্ছে৷ ভূমিধস ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ চলমান রয়েছে ৷

সরেজমিনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের অনেক এলাকায় পাহাড় একদম ন্যাড়া হয়ে গেছে। সেখানে কোন গাছপালা নেই। আছে শুধু ঘর-বাড়ি। যার ফলে পাহাড় আর গাছপালা কেটে বসবাস করায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এইসব রোহিঙ্গাদের কারণে বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক বিপর্যয় ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি এর (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন,কক্সবাজারে পাহাড় ধসের মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু পাহাড় খেকো আর পাহাড়ে বন উজার করে গাছ কাটায় জড়িতদের দৌরাত্ম্য কমে না। প্রশাসন বর্ষা মৌসুম আসলে লোক দেখানো অভিযানে যায় নামেমাত্র। কিন্তু পুরো বছর আর খবর থাকেনা। আমরা এটা দেখতে চাইনা। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করাও দরকার।

তিনি আরো বলেন-স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশঘেরা যে সুন্দর পাহাড় রয়েছে তাও রোহিঙ্গাদের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে সমস্ত গাছগাছালি। ফলে বর্ষা মৌসুমে ভুমি ধ্বসে প্রাণহানির শঙ্কা বরাবরই বাড়ছে।


শেয়ার করুন