ব্লগার হত্যা?

taslima_72284-400x271তসলিমা নাসরিন

আমি একে ‘ব্লগার হত্যা’ বলবো না। প্রচুর ধর্মান্ধ-মৌলবাদী-সন্ত্রাসীও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ব্লগ লেখে। তাদের কিন্তু খুন হতে হয় না। তারা তাদের মত প্রকাশ করে বলে কেউ তাদের কুপিয়ে মেরে ফেলে না। কিন্তু যারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে, যারা শিক্ষিত, সচেতন, চিন্তক, যারা সমাজকে বাসযোগ্য করতে চায়; অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চায়; বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চায়; তারাই আজ নৃশংসতার শিকার। আলোকিত মানুষগুলোকে আজ অন্ধকারের বোবা-কালা-বধিরেরা বীভৎসভাবে হত্যা করছে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। অন্ধকারে আচ্ছন্নরা জগৎটাকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলতে চায়। এই অন্ধকারে আলোকিত মানুষদের কোনও ঠাঁই নেই। অন্ধকারের বোবা-কালা-বধিরগুলো আলোকিত সাহসীদের বড় ভয় পায়। পৃথিবীর আর কাউকে ভয় পায় না ওরা। আর যারা আছে, এমনকী বড় বড় নেতা-শাসকরাও- তারা ভীতু, ভীরু, আপোসকামী, পদলেহনকারী- তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই অন্ধকারের লোকদের।
আলোকিত মানুষরা নিরস্ত্র। কারণ তারা অস্ত্রে আর খুনোখুনিতে বিশ্বাসী নয়। অন্ধকারের লোকদের হাতে চাপাতি, হাতে রক্ত, মগজে মূর্খতা। যারা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ, তাদের এখন যে কোনও একটি পথ বেছে নিতে হবে, নিজেকে তারা জিজ্ঞেস করুক, তারা অন্ধকারের পথে যেতে চায় নাকি আলোর পথে। অন্ধকারের পথ মিথ আর মিথ্যের পথ, খুন-খারাবির পথ, বৈষম্য, নারী-বিদ্বেষ, ঘৃণা আর সংকীর্ণতার পথ। পাথর-ছুড়ে-মানুষ-হত্যা আর কথায় কথায় মু-ু কেটে ফেলার জগতে শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তা নিয়ে বেঁচে থাকতে যারা চায়, তারা অন্ধকারের হাত ধরে হেঁটে যাক, হেঁটে যাক রূপকথার স্বর্গবাসের লোভে। আর যারা ও পথে চায় না যেতে, যারা মানবাধিকার, মনুষ্যত্ব, সমতা আর শান্তিতে বিশ্বাস করে, তারা রুখে দাঁড়াক। আজ যদি তারা রুখে না দাঁড়ায়, তবে আর কবে? রাজপথ ভাসছে তাজা তরুণের রক্তে।
‘দেশে মৌলবাদ বাড়ছে, মানুষ সতর্ক হও, রুখে দাঁড়াও’- বলেছিলাম পঁচিশ বছর আগে। তখন আমাকে দোষ দিয়েছিল সমাজের তাবড় তাবড় ‘বুদ্ধিজীবীরা’। বলেছিল, কোনও মৌলবাদীর অস্তিত্বই নেই দেশে, আর যদি থাকেই তবে আমার কারণে নাকি মৌলবাদীর উৎপত্তি হয়েছে, আমিই যত নষ্টের মূল। আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। গত কুড়ি বছর তো আমার চিহ্নমাত্র কেউ দেখতে পায়নি, আমার লেখাপত্রও কেউ ছাপায়নি, তাহলে মৌলবাদীরা এত ভয়ঙ্কর একটি চেহারা কী করে পেলো! কে তাদের ননীটা ছানাটা খাইয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছে? কেন আজ দেশ ছেয়ে গেছে ধর্মান্ধতায়, মৌলবাদে আর সন্ত্রাস্তে দেখেও দেখবো না, শুনেও শুনবো না করলে এ-ই হয়। সুবিধেবাদী বুদ্ধিজীবী আর দূরদৃষ্টিহীন মূর্খ রাজনীতিকদের দেশে মৌলবাদ বাড়বে না তো মানববাদ বাড়বে?
যে বীজ রোপণ করা হয়েছে, তার ফসল আজ ভোগ করছে বাংলাদেশ। ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দেওয়ার জন্য অগুনতি প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। আখেরে এগুলো ক্ষতিকর জেনেও বানানো হয়েছে। মাদ্রাসা থেকে পাস করে আজ অবধি কেউ বিজ্ঞানী বা দার্শনিক বা মহামানব কিছু হয়নি। কিন্তু দেশটার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় যে-ই এ-যাবৎ এসেছে, দু’দিনের গদির লোভে দেশটার ধ্বংস ডেকে এনেছে, জেনে বুঝে মৌলবাদীদের মাথায় তুলে নেচেছে, ওদের সঙ্গে আপোসের ষড়যন্ত্র করেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মৌলবাদী তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার করার। রাজনৈতিক-ইসলামের নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই, আর দূরদৃষ্টিহীন সরকার জেনে বুঝেই সায় দিচ্ছে এসবে। কোনও এক নারীবিরোধী বিজ্ঞানবিদ্বেষী এক মোল্লাকে শুনেছি হাসিনা সরকার কত হাজার একর জমি দান করেছেন। ওই জমিতে তিনি যেন একটা বিশাল কারখানা বানিয়ে ফেলতে পারেন, যে কারখানায় ছেলেপিলেদের মাথা-মগজের সর্বনাশ হবে এবং ভয়ঙ্কর সব সন্ত্রাসী তৈরিও হবে। শুধু অর্ডার দিলেই হয়, ছাত্ররা তাদের হুজুরের অর্ডার মাথা পেতে মেনে নেবে। বোবা-কালা-বধিরদের বোধশক্তি নেই কাজটা অন্যায় কিনা, কাজটা করা উচিত হচ্ছে কিনা, কাজটা করলে ফলটা কী হবে তা চিন্তা করার। একটি রূপকথার ফলের লোভ তাদের দেখিয়ে দিয়েছে তাদের হুজুররা। খুন করলে তারা বেহেশত পাবে। বেহেশতের লোভে আজ এরা বর্বর খুনি হতে দ্বিধা করছে না। এ জীবনে আমোদ প্রমোদের সুযোগ হলো না, পরকালে যথেচ্ছ ভোগের ব্যবস্থা পাকা করার জন্যই এই খুন। সরকার জঙ্গি তৈরিতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে ইহকালের গদি রক্ষার জন্য, জঙ্গিরা সমালোচকদের খুন করে পরকালের গদি রক্ষার জন্য। সরকার আর জঙ্গির চরিত্রে খুব একটা ফারাক নেই।
ফারাবীকে ধরা হয়েছে অভিজিৎকে হত্যার জন্য। আসল খুনিদের টিকিটি চাইলেও ছুঁতে পারবে না পুলিশ, এ আমি বিশ্বাস করি না। ছুঁতে চাইলে কি ছুঁতে পারতো না? আরিফুর আর জিকিরুল্লাহকে ধরা হয়েছে ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করার কারণে। কিন্তু ওদের হুজুরটিকে এখনো ধরা হচ্ছে না, যে হুজুর তাদের বলেছে ওয়াশিকুরকে খুন করলে বেহেশত মিলবে ওদের। ছোট-হুজুরের বাপ বড়-হুজুরকে ধরা হচ্ছে না, ধরা হচ্ছে না নাটের গুরুকে, যে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে ব্লগারদের মেরে ফেলা মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব। জানি না আমি বেঁচে থাকতে দেখতে পাবো কি না, তবে খুব শিগগির সন্ত্রাসীরা আমার মু-ু না কেটে ফেললে হয়তো দেখে যেতে পারবো বাংলাদেশে শরিয়া আইন চালু হয়েছে, সৌদি আরবে যেমন রাস্তার ওপর মানুষকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তলোয়ার দিয়ে মু-ুটা ঝপাং করে কেটে ফেলা হয়, বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। ধর্ষিতা মেয়েরা সাক্ষীর অভাবে ব্যভিচারী বলে সাব্যস্ত হচ্ছে, দোররার মার খাচ্ছে। কোনও মেয়েই বোরখা ছাড়া বাইরে বেরোতে পারছে না, গাড়ি ঘোড়া সাইকেল রিকশা কিছুই চালাতে পারছে না। অধিকার বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই মেয়েদের। আৎদীয় নয় এমন কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও ভয়ঙ্কর পথে চলছে। বাংলাদেশে মৌলবাদের অবাধ চাষ হয়। ফলনও বাম্পার। পাকিস্তানে মৌলবাদ নানাভাবে দমন করা হয়। পাকিস্তানে মৌলবাদী খুনিরা ধরা পড়ে এবং জেলে যায়। বাংলাদেশে মৌলবাদী খুনিদের ইচ্ছে করেই ধরা হয় না। তাদের কোনও শাস্তিও দেওয়া হয় না। পাকিস্তানে বাংলাদেশের মতো মুক্তচিন্তক আর যুক্তিবাদীদের এক এক করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে না।
একসময় বাংলাদেশে আর কোনও মুক্তচিন্তক হয়তো থাকবে না। কিন্তু পাকিস্তানে থাকবে। পাকিস্তানের মুক্তচিন্তকরা একসময় তাদের দেশটা যেন বাংলাদেশ হয়ে না যায়, তার চেষ্টা করবে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের গৌরব করার মতো বেশি কিছু নেই। বাকি যা ঘটেছে বাংলাদেশে, সবই মৌলবাদীদের পক্ষের ইতিহাস, সেক্যুলার সংবিধানের ইসলামিকরণ, সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসানো, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আনা, দেশজুড়ে অগুনতি ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে তোলা, একশ’ পঞ্চাশ বছরের পুরনো বাকস্বাধীনতাবিরোধী আইনকে (বাংলাদেশ ফৌজদারি আইনের ২৯৫-ক/খ ধারা) মুক্তচিন্তকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, ইন্টারনেটেও যেন কেউ ধর্ম নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে না পারে সে জন্য আইসিটি অ্যাক্ট ৫৭-ধারা বানানো এবং ওই ধারায় আলোকিতদের ফাঁসানো, রেডিও-টেলিভিশনে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় ধর্মের গীত গেয়ে যাওয়া, এমনকী সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়েও লখিন্দরের বাসরঘরের মতো মৌলবাদী সাপের ঢুকে যাওয়া, তসলিমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেও মৌলবাদীদের পার পেয়ে যাওয়া, আজাদ, হায়দার এবং আরও অনেককে কুপিয়ে হত্যা করেও শাস্তি না পাওয়া। মৌলবাদীদের ঝুড়িতে অসংখ্য বিজয়ের মুকুট। এই বিজয়ী দল ধর্মের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে মানুষের শিরশ্ছেদ করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভিত্তিটা তো এতকাল ধরে তৈরিই করা হয়েছে ওদের যা খুশি তাই করার জন্য। অভিজিৎ রায় আমার অনেককালের বন্ধু ও আমার ফেসবুক বন্ধুও ছিল। ওয়াশিকুর বাবুও আমার ফেসবুক বন্ধু ছিল। আমার প্রতিভাবান তরুণ বন্ধুরা এক এক করে চলে যাচ্ছে, যারা আর কোনওদিন ফেরত আসবে না। পড়ে থাকছে লাখো খুনি, তাদের আকাশে উড়ছে হাজারো শকুন। অভিজিতের মৃতদেহ দেখে আমি চিৎকার করেছি রাগে, ক্রোধে। আজও মানতে পারিনি ওর চলে যাওয়া।
আজও খাঁ খাঁ করছে আমাদের মুক্তচিন্তার জগৎ। ওয়াশিকুর বাবুর মৃতদেহ দেখে আমি নিঃশব্দে কাঁদছি। আমার ভালো লাগছে না দেখতে আমার চোখের জল। আমি রাগে-ক্রোধে আগের মতো চিৎকার করতে চাই, চিৎকার করার আরও শক্তি চাই। একুশ বছর আগে আমাকে ওরা ওভাবেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি বেঁচে আছি। ওরা মেরে ফেলছে তাজা তাজা প্রতিভাবান তরুণকে। এত ক্ষতি আর সইতে পারি না। বাংলাদেশ প্রতিদিন
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা


শেয়ার করুন