ইউপি নির্বাচন পর্যালোচনা

বিশাল জয়েও তৃপ্তি কম আ’লীগে, তবুও লাভবান বিএনপি

ballot_loot-550x309ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে একচেটিয়া ও বিশাল জয়েও তৃপ্তি কম আওয়ামী লীগে। বিশেষ করে নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতার পাশাপাশি নানা অনিয়ম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে সরকারি দলকে। অন্যদিকে বিএনপি ইউপি নির্বাচনে লাভ-ক্ষতি হিসাব করছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ক্ষতি হয়নি; বরং সাংগঠনিকভাবে লাভবান হয়েছে। সার্বিকভাবে গণতন্ত্র বিকশিত না হলেও সাংগঠনিকভাবে বিএনপির অর্জন শতভাগ। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নির্বাচনে ক্ষতির চেয়ে লাভের কথাই বলেছেন তারা।
আওয়ামী লীগের দলীয় নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে নির্বাচনকে প্রকাশ্যে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ দাবি করা হলেও প্রভাবশালী দলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ব্যাপক ভোট কাটাকাটি, কারচুপিসহ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তাদের। দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যও তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের সহিংসতা ‘সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রভাব’, যার দায় দল নেবে না।
গত ২২ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচন শেষ হয়েছে গত শনিবার। এ সময় চার হাজার ৮৮টি ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণকালে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। প্রভাবশালী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা অনেকটা প্রকাশ্যেই ব্যাপক হারে জালভোট, ভোট কাটাকাটি ও কারচুপির ঘটনা ঘটিয়েছে। সহিংসতায় সারাদেশে কমপক্ষে ১০৮ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় এ নির্বাচন বিবেচিত হচ্ছে ‘দেশের সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন’ হিসেবে।
‘স্বস্তি’র বিষয় নিরঙ্কুশ জয় : আওয়ামী লীগের জন্য ‘স্বস্তি’র বিষয় হলো, প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ হিসাবে চার হাজার ৮৮টি ইউপির মধ্যে তিন হাজার ৯৬৫টির ফল ঘোষিত হয়েছে। বাকি ১২৩টির ফল স্থগিত আছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৬৪৭টি ইউপির (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ২০৪ জনসহ) চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জিতেছেন। এ ছাড়া যে ৮৭৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন, তাদের বেশিরভাগও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
এমন ‘স্বস্তির’ ওপর ভর করে দলের নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় নেতারা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, ‘এই জয়ের ফলে তৃণমূলে দলীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি গণতন্ত্র বিকাশের পথ আরও সুগম হয়েছে।
সহিংসতা কমানোর উদ্যোগ কাজে লাগেনি : ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক সন্ত্রাস-সহিংসতাকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কখনও ‘সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ’, কখনও প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের ‘নির্বাচনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রের অংশ’ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে।
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও গত শুক্রবার দলীয় ফোরামের এক অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ইউপি নির্বাচনের সহিংসতা আসলে ‘সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রভাব। নানা সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে এসব সহিংসতা হয়েছে। এর দায় কেন আমরা নেব? আর নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার কাজ নির্বাচন কমিশনের। আমরা নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে পারি।’
দলের সভাপতিম-লীর অন্য সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি একই ভাষায় বলেছেন, ‘ইউপি নির্বাচনে এপাড়া-ওপাড়া, খালের এপার-ওপার- এসব নিয়ে সামাজিক অনেক দ্বন্দ্ব থাকে। যার প্রভাব নির্বাচনে পড়ে। এজন্য সহিংসতা হয়।’
দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা আরও বলেছেন, প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক হারে অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনার পর পরবর্তী ধাপে সেটি কমিয়ে আনার নানা পদক্ষেপও ছিল দলের মধ্যে। নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়- এমন নির্দেশনাও ছিল প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর এ বার্তা নির্বাচন কমিশনেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। এর ফলে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু চতুর্থ ধাপের নির্বাচন থেকে আবারও অবস্থা আগের পর্যায়ে চলে যায়। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক দলগুলোও প্রকাশ্যেই এর সমালোচনা করেছে।
মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ : সদ্যসমাপ্ত এ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়েও নানা অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও বিএনপি-জামায়াত থেকে খোলস বদলে আসা নেতারা দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে জঙ্গি ও জেএমবি সংশ্লিষ্টতার ও রাজাকারের সন্তান হওয়ার এবং নানা অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও তুলেছেন। এ ধরনের প্রার্থী নির্বাচনের পেছনে বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও স্থানীয় নেতাদের অর্থলিপ্সা তথা মনোনয়ন বাণিজ্যকেই মূলত দায়ী করা হচ্ছে।
দলের দাবি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন : এদিকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ইউপি নির্বাচনকে সার্বিকভাবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোটের গত তিন বছরের নৈরাজ্যমূলক সহিংস কর্মকা-ের ধারাবাহিকতায় এ নির্বাচনেও কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি ইউপি নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করলে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কমে যেত। কিন্তু তারা শুরু থেকেই এই নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পথ বেছে নিয়েছে।’ তারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতাকে নির্বাচনী সহিংসতা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে সরকার ও নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইছে বলে জানান তিনি।
তবুও লাভবান বিএনপি
ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (্ইউপি) নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ইউপি নির্বাচনে লাভ-ক্ষতি হিসাব করছে দলটি। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ক্ষতি হয়নি; বরং সাংগঠনিকভাবে লাভবান হয়েছে। সার্বিকভাবে গণতন্ত্র বিকশিত না হলেও সাংগঠনিকভাবে বিএনপির অর্জন শতভাগ। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নির্বাচনে ক্ষতির চেয়ে লাভের কথাই বলেন তারা।
চার মাসব্যাপী ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ছয়টি ধাপের নির্বাচনে বিএনপির ৩৬৭ জন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা জানতাম, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। এর পরও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মীদের কর্মকা- নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকে বিএনপির ক্ষতি হয়নি; বরং লাভটাই বেশি হয়েছে। গণতন্ত্র বিকশিত না হলেও বিএনপির অর্জন হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় মামলা নিয়েই নেতাকর্মীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচনে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি। এর পরও বিএনপির শত শত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, এটাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি কী কারণে, তা এবারের ইউপি নির্বাচনে সারাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ভুল করেনি, তা আবারও প্রমাণ হলো। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও তাদের সঙ্গে আইন-শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে যে তা-ব করেছে তাতে আর বুঝতে বাকি নেই যে, এই সরকারের অধীনে কখনও সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল সদ্য শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপির ‘মহড়া’ দিয়েছে। এই নির্বাচনে সরকার নিজেকে লাভবান মনে করলেও তাদের ক্ষতি হয়েছে। কারণ, মানুষ বুঝতে পারছে, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে কী হতে পারে। আগামীতে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকেরা কীভাবে ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারতে হবে, সেই মহড়া দিয়েছে ইউপি নির্বাচনে।
একাধিক নেতা জানান, ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি ছিল। নির্বাচনে অংশ নিলে দলের শত শত নেতাকর্মী, যাদের নামে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে, তারা নির্বাচন উপলক্ষে এলাকায় আসতে পারবেন। এলাকায় নেতাকর্মীদের পদচারণা থাকলে দলের সাংগঠনিক অবস্থাও শক্ত হবে। বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতিও নেওয়া যাবে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে থাকার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।-সমকাল।


শেয়ার করুন