একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা

বিদেশে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে মরছে স্বজনরা

Manobসিটিএন প্রতিবেদক:

ভিটেমাটি বিক্রি করে, ধার-দেনা আর ব্যাংক থেকে চড়া সুদের টাকায় বিদেশে পাড়ি জমানো অনেক দিনের নিয়মিত ঘটনা। প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশিরা।

বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছেন অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছেন সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। বেশিরভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। আবার কোনো কোনো বাংলাদেশি জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। প্রবাসের মাটিতে চুরি, মাদক পাচার থেকে শুরু করে রোমহর্ষক খুন পর্যন্ত করছেন বাংলাদেশিরা। অবশেষে ঠাঁই হচ্ছে বিদেশের কারাগারে। এ মুহূর্তে ঠিক কতজন বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারগুলোয় বন্দী বা আটক আছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ, আটকদের পক্ষ থেকেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করলেই কেবল তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়। অনেক দেশে নেই মিশনও। তাই তালিকার বাইরেও থেকে যান অনেক বন্দী। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসীদের নিয়ে গবেষণা করা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন সময়ের পরিসংখ্যানে খুঁজে পাওয়া গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৪২টি দেশে কমপক্ষে ১০ হাজার বাংলাদেশি বন্দী হয়ে আছেন। তবে এ সংখ্যার পরিবর্তনও হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অনেকে প্রতারিত হয়ে বা পরিস্থিতি না বুঝে মানব পাচারের শিকার হয়েছেন, এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছেন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।

সম্প্রতি নৌপথে অবৈধভাবে যাওয়ার হার বেড়ে যাওয়ায় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের কারাগারে আটক বাংলাদেশির সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দীশিবির ও কারাগারে আছেন ৩ হাজার ২৩০ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে কারাগারে আছেন ১ হাজার ৬৩৭ জন এবং বিভিন্ন বন্দীশিবিরে আছেন ১ হাজার ৫৯৩ জন।

এছাড়া সৌদি আরবে ১ হাজার ৪৬, আমিরাতে ৩০৮, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৬০, কুয়েতে ২২০, মিয়ানমারে ২৯৯, যুক্তরাজ্যে ২৪৪, যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭, গ্রিসে ৩১১, ওমানে ১৮৮, লিবিয়ায় ৬৭ ও পাকিস্তানে ১৩ জন আটক রয়েছেন। তবে এ তালিকা তখনো ছিল অসম্পূর্ণ। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর আমিরাত সফরের সময়। তখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে উত্থাপিত তথ্যে দেখা গেল, আমিরাতের কারাগারে বন্দীর সংখ্যা বেশ আগেই হাজার ছাড়িয়েছে। যেখানে ১১ জনের মৃত্যুদ-দের কথা জানা ছিল সেখানে মৃত্যুদ-প্রাপ্তই আছেন ১৯ জন। সবচেয়ে বড় বিষয় ভারতের কারাগারে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে, শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারেই আছেন প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি। অন্যদিকে, দুর্গম পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোয় বন্দী হওয়া অনেকের তথ্যই পাওয়া যায় না। সেখানকার অনেক দেশেই নিয়মতান্ত্রিক কারাগারের কাঠামোই নেই। সেখানে হয়তো কোনো ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয় গ্রেফতার হওয়া ভাগ্যান্বেষীদের।
বিদেশের জেলে কাটছে তাদের দুঃখময় দিন। আর দেশে তাদের স্বজনদের দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক যন্ত্রণার শেষ নেই। বিদেশের কারাগার থেকে কীভাবে, কোন উপায়ে সন্তানকে, ভাইকে, স্বজনকে, আত্মীয়কে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়- তার পথ খুঁজে ফিরছে তারা। হাঁড়ে হাঁড়ে অনুভব করছে নিজেদের অক্ষমতাকে। একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
বিদেশে বন্দিদের ফিরিয়ে আনতে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা, উদ্যোগেই তা সম্ভব। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মকর্তারা বলেছে, দ্রুতই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বন্দিদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়া হবে।
আমাদের কথা এই ‘দ্রুত’ যেন সত্যি সত্যি দ্রুত হয়। বন্দিদের দুর্ভোগ দীর্ঘতর না হয়, দেশে স্বজনদের মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত না হয়। যে যেভাবেই হোক, বিদেশ গিয়ে আটক হওয়া বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। যারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমান তাদেরও তত্ত্ব-তালাশ নিয়েই পা বাড়ানো উচিত- বৈধ, না অবৈধভাবে যাচ্ছে, দালাল-প্রতারকের খপ্পরে পড়লো কিনা। গাঁটের পয়সা দিয়ে, জমি-জিরাত বিক্রির টাকা খরচ করে, ঋণ-হাওলাত করে বিদেশে পাড়ি দিয়ে যদি দুর্বিপাকে পড়ে জেলের ঘানি টানতে হয় তাহলে তার মতো কষ্ট-দুর্ভোগ-ক্ষতির আর কী আছে? তাই সবারই সচেতন হওয়া উচিত।
পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রবাসের কারাগারে আটক বাংলাদেশীদের ফেরত আনার জন্য সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতারক আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।

মূলত, এতে একদিকে যেমন বিদেশে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষু্ণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে সর্বস্বান্ত হচ্ছে এদেশের অনেক পরিবার। বর্তমান সরকারকে এ অবস্থা অবসানে বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে আগের তুলনায় লেবার উইং আরো অনেক বেশি শক্তিশালী করা উচিত। ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস ট্রেনিং মডিউলেও পরিবর্তন করা উচিত, যাতে যারা সার্ভিস দেবে তারা যেনো জেনে বুঝে বাংলাদেশী কর্মীদের যথাযথ সেবা দিতে পারে।


শেয়ার করুন