বিচারকদের চাকরিবিধি সুপ্রিম কোর্টই পারে: ব্যারিস্টার আমীর

বিডিনিউজ :

আইন মন্ত্রণালয়কে ছাড়াই রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।

বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের টানাপড়েনের মধ্যে রোববার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ মত তুলে ধরেন অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।

কয়েক মাসে দফায় দফায় সময় নেওয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত মাসের শেষে শৃঙ্খলাবিধির একটি খসড়া জমা দিলেও কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি তা গ্রহণ না করে ফেরত দেন।

মতপার্থক্য নিরসনে ৩ অগাস্টের মধ্যে যে কোনো দিন আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনায় বসারও প্রস্তাব দেন তিনি। সেই বৈঠক হয়নি; আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বসতে চাইলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে যাননি।

এই প্রেক্ষাপটে রোববার মাসদার হোসেন মামলায় আবেদনকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম আপিল বেঞ্চে এই মত লিখিত আকারে উপস্থাপন করেন।

আদালতকে তিনি বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা করতে আইন মন্ত্রণালয়ের দরকার নেই। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ বিধিমাল করে ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে কেবল রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিলেই হয়।

বরাবরের মতোই এদিনও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিধিমালার গ্যাজেট প্রকাশে আবারও সময় চাইলে আপিল বেঞ্চ তা মঞ্জুর করে দুই সপ্তাহ সময় দেন।

ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম

পরে ব্যারিস্টার আমীর সাংবাদিকদের বলেন, “১৭ বছর আগে একই আবেদন করেছিলাম। তখন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল রায়ে বলেছিলেন, রুলস প্রণয়নে একটি আইনি বাতাবরণ থাকা দরকার। ১৭ বছর পরেও এসে আবেদন করে বলেছি, বিচারপতি মোস্তফা কামালের ওই রায়ের অংশ রিভিউ করতে হবে। কারণ ১১৬ অনুচ্ছেদ মতে, বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকবে।
“এই জন্য সুপ্রিম কোর্ট এ রুলস প্রণয়ন করে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে দেখিয়ে আসলেই হয়। এখানে মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের দরকার নেই।”

সংবিধানের ‘অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা’ শীর্ষক ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুর) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।”

ঘটনাক্রম

মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়।

ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।

সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।

এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।

এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিধিমালা নিয়ে “রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”

সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে সরকারকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সময় নেওয়া হচ্ছিল।

এর মধ্যে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। তার ধারাবাহিকতায় তিনি ২৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চাকরিবিধির খসড়া দিয়ে এলেও সর্বোচ্চ আদালত তা গ্রহণ করেনি।


শেয়ার করুন