বালু নদের শ্যামল শোভায় একদিন

downloadমো. মনির হোসেন :

ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের পরিচয় নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। এখানে জালের মতো ছড়িয়ে আছে হাজারো নদী। তাদেরই একটি বালু নদ। বেলাই বিল ও ঢাকার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলাভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে ডেমরা-তারাবো সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যা নদীতে পড়েছে এ নদ। কাপাসিয়ার কাছে সুতি নদীর মাধ্যমে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে এর একটা ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। সংযোগ আছে টঙ্গী খালের মাধ্যমে তুরাগ নদের সঙ্গেও।

বর্ষায় জলে টইটম্বুর বালু নদ সেজেছে অন্য রূপে। বালুর স্বচ্ছ-স্ফটিক জল, জলে ভেসে থাকা হেলেঞ্চা আর কচুরিপানা, জলে ঝাঁপ দেয়া দুই পাড়ের গাছগাছালি বালুকে করেছে শ্যামলীমাময়। আর সেই শ্যামল শোভায় গা ভাসাতে আমরা ক’জন বেরিয়ে পড়লাম ভরা বর্ষার বালু নদে। কহর দরিয়া থেকে আমাদের যাত্রা। সঙ্গে ছিলেন নদী পরিব্রাজক শাতিল, সবুজ, আরিফুল ইসলাম, অরণ্য, গায়েন মোস্তফা ও রনি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রাণ মাহবুব রসিকতা করে বললেন, ভাই আজ কষ্টের দরিয়া থেকে যাত্রা করলেন কেন। আমিও রসিকতা করে বললাম, বালুর কষ্ট বোঝার জন্য। গল্পে-আড্ডায় চলে এলাম উলুখোলা ব্রিজের কাছাকাছি। অকূল দরিয়ায় আমরা ভাসছি। বিলের মাঝখানে বৃক্ষঘেরা একটি বাড়ি দেখে মনে হলো, বিশাল সাগরের মধ্যে একটি দ্বীপ। সেই বাড়ির পাদদেশে ঢেউগুলো প্রতিনিয়ত আছাড় খাচ্ছে। বালুর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে মাটিবহনকারী নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা, ভ্রমণপিপাসুবাহী নৌকা। এর মিছিলে আছে আমাদের নৌকাও।

হঠাত্ বৃষ্টি শুরু হলো। আহ! ঝম ঝমাঝম বৃষ্টি। গায়েন মোস্তফা গান ধরল, ‘আষাঢ় মাইয়া বৃষ্টিরে, ঝম ঝমাইয়া পড়েরে, বন্ধু আমার রইল কোন বৈদেশে…।’ গান শুনতে শুনতে আমরা চলে এলাম উলুখোলা বাজারে। সবাই মিলে পুরো বাজার ঘুরে দেখলাম। আম, আনারস, কাঁঠাল, লটকন, পেয়ারাসহ মৌসুমি ফলের বাহারি আয়োজন। আরো আছে নতুন পানির মাছ পুঁটি, বৈছা, খৈলসা, টেংরা, শিং, মাগুর আর কৈ। তবে চোখ আটকে গেল টেংরার দিকে। এত বড় টেংরা আগে কখনো দেখিনি। আমার মতো অনেকেই এ দৃশ্য দেখছেন।

বরাবরের মতো এবারো আমরা নদীর অতীত শুনলাম নদীপাড়ের বাসিন্দাদের কাছ থেকে। তারা জানান, বালু নদের দুই পাড়ে লাখো মানুষের বসতি। এ নদে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখানকার মাছ সুস্বাদু হওয়ায় এর কদরও বেশি ছিল। নদের পানি গৃহস্থালি কাজেও ব্যবহার হতো। মাঝিরা মনের আনন্দে পালের নৌকা বেয়ে ভাটিয়ালি গেয়ে ছুটে যেতেন দূর-দূরান্তে। বালু নদ তার সে রূপ হারিয়ে এখন পরিণত হয়েছে ময়লার ড্রেনে। ঢাকা শহরের বর্জ্য এসে এ নদে পড়ায় বিষাক্ত হয়েছে পানি। বর্ষাকাল ছাড়া এ নদ থাকে প্রায় মাছশূন্য।

বাজার ঘুরে আবার ট্রলারে। যাত্রা বালু আর শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলের দিকে। বালু নদের উলুখোলার ঠিক পরের জায়গাটা বেশ নীরব। গাছগাছালি আর ঝোপঝাড় বেষ্টিত এ অংশ মনকে ক্ষণিকের জন্য নিয়ে যায় আমাজানের জলারণ্যে। চারপাশের নিস্তব্ধতা আর নদীময় পরিবেশ মনকে আনন্দে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমরাও নবানন্দে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ইছাপুরাসহ রূপগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ শেষে পৌঁছে গেলাম ডেমরা-তারাবো ব্রিজের নিচে, যেখানে বালু নদ শীতলক্ষ্যার সঙ্গে মিলে গেছে। দুই নদীর সঙ্গমস্থলটিও দেখতে খুব সুন্দর। যে কেউ থমকে দাঁড়াবে ১ মিনিটের জন্য হলেও। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বালু নদের রয়েছে শতাধিক ট্রিবুইটারি। সেগুলোও এখন জলে টইটম্বুর। ভরা বর্ষায় টইটম্বুর বালুর শ্যামল শোভায় নিজেকে ভেজাতে বেরিয়ে পড়ুন এ ঈদের ছুটিতেই।


শেয়ার করুন