বার্ডস আই: আদিবাসী দিবসে আদি ভাবনা

mahfuz মাহ্ফুজুল হক

মানুষ, মনুষ্য, মানব, হিউম্যান, রেস, না-স ইত্যাকার শব্দগুলো দুই হাত, দুই পা, দুই চোখ, দুই কর্ণ, এক নাসিকা, এক মুখ, এক মাথা বিশিষ্ট প্রাণীটিকে বুঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হয়। কোটি কোটি সৃষ্টির মাঝে একমাত্র এই প্রাণীটি জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধিমত্তা, ধীশক্তি, মানবিকতা ইত্যাদি বিশেষণে অনন্য বলেই অপরাপর সকল সৃষ্টির চাইতে সেরা। পশু বা প্রাণীর মধ্যে কম-বেশিসহ পশুত্ব/পাশবিকতা এবং মনুষ্যত্ব/মানবিকতা (এনিম্যালিটি এন্ড হিউম্যানিটি/রেশন্যালিটি) উভয় গুণই বিদ্যমান। শারীরিক প্রয়োজনে কৃত কার্যাবলীকে মূলতঃ পশুসুলভ বা পাশবিকতা বলা যায়। যথা – ক্ষুৎ-পিপাসা, মল-মূত্র ত্যাগ, ঘুম-বিশ্রাম, যৌন চাহিদা, গরম-ঠান্ডার অনুভূতি ইত্যাদি পশুসুলভ আচরন যা মানুষ ও অপরাপর সকল প্রাণীর মধ্যেই বিরাজমান। উপরোক্ত জৈবিক চাহিদা পূরণ সহজসাধ্য না হলে তারা হিং¯্র হয়ে ওঠে এবং সর্ববিধ উপায়ে তা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে মানুষ নামক প্রাণীটি একটু ব্যতিক্রম। মানুষও একইভাবে ওই সকল চাহিদা পূরণ করতে চায় তবে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সে বিবেক তাড়িত হয়, রেশন্যাল হয়। এখানে তার মনুষ্যত্ববোধ তাকে ভাল-মন্দ, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, শালীন-অশালীন ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করতে বলে। (তবে এক্ষেত্রেও কিছু কিছু মানুষ পশু বা তার চেয়েও অধমের মতো আচরন করে। খাবার, যৌন তৃপ্তি, আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদির জন্য খুনোখুনি থেকে শুরু করে সকল বর্বর পন্থা তারা অবলম্বন করে।) এই বোধটুকু আছে বলেই মানুষ ’সৃষ্টির সেরা জীব’ (আশরাফুল মখ্লুকাত)। সে বিবেক তাড়িত হয়ে এবং স্বপ্রণোদিতভাবে সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বিষয় থেকে জ্ঞান আহরন করে আর তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই মানুষ সভ্য হয়, সভ্যতা গড়ে তোলে। স্বীয় বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সে নিত্য আবিষ্কারে ব্রতী হয় এবং তারই সৃষ্ট প্রযুক্তি তাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়।
মানব সৃষ্টির প্রারম্ভ আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া (আঃ) থেকেই। আদম থেকেই সম্ভবতঃ ’আদি’, ’আদিম’ শব্দের উৎপত্তি। কেননা পৃথিবীতে আদমের চেয়ে আদি কোন মানুষ নেই এবং ছিলেনও না। তিনি নবী ছিলেন। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, নবীগন (আঃ) স্ব স্ব যুগের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী-গুণী ও সর্বোত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সুসভ্য মানুষ ছিলেন। আদি পিতা আদমকে সৃষ্টি করা হলো এবং মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিলেন। ফিরিশ্তাকূল তাঁর জ্ঞানের বহর দেখে চমৎকৃত হলেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁর প্রতি অবনত হলেন। প্রতিটি মানব গোষ্ঠী/জাতির কাছে মহাপ্রভূ নবী পাঠিয়েছেন এবং তাঁরা সবাই জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতায় শ্রেষ্ঠতম ছিলেন। প্রাচীণ ঐশী গ্রন্থসমূহের কোথাও আমরা নবী বা মহাপুরুষদেরকে অসভ্য-বর্বররূপে পাই না। মানুষ আগুন ও পরিচ্ছদের ব্যবহার জানতো না – এমন কাহিনী উদ্ভট বৈ কিছু নয়। মানুষ উলঙ্গ থাকতো, পশু-পাখির কাঁচা মাংস খেতো – ইত্যাদি কল্প-কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। হাজার হাজার বছর পূর্বের যে সকল সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে যুগোপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার, শিল্পকলার চর্চা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। সভ্য মানুষগুলো সচরাচর সাগর বা নদী তীরে বসতি গেড়ে উন্নত জীবন ধারায় সিক্ত হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বচ্ছল জীবন যাপন করেছে, নেতা বা রাজার আনুগত্য করে নিয়ম-কানুন মেনে ভব্যতার পরিচয় দিয়েছে। হ্যাঁ, মানব জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা বিভিন্ন কারণে সমতল ছেড়ে বন-বাদাড়কে নিজেদের বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়েছিল তারা সময়ের পরিক্রমায় সভ্যতা-ভব্যতা হারিয়ে ফেলে এবং বাঁচার তাগিদে পশুদের মতো জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। তারা কাঁচা মাংস খায়, উলঙ্গ থাকে, কেশ বিন্যাস করে না, গুহায় বাস করে, ভাষা জ্ঞান না থাকায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলে। এদের খুঁজে পেতে প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেতে হয় না, হাল জমানার পাহাড়ে-জঙ্গলে এদের দিব্যি দেখা মেলে। আমার এক বন্ধুসহ কয়েকজন বেশ কয়েক বছর পূর্বে মোজাম্বিক সফরে গিয়েছিলেন। বিমান বন্দরে তাদের বরণ করতে এলেন বিরাট বপুধারী জনাকয়েক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, গায়ে আদম ছুরত মানে পুরোপুরি উদোম, তাদের জাপটে ধরে চুমুতে চুমুতে ভাসিয়ে দিলেন। অতঃপর গাড়িতে চড়ে তারা দূর গাঁয়ে গেলেন – উদ্দেশ্য ওই গ্রামবাসীকে কাপড় পড়াবেন, ভব্যতা শেখাবেন। তাই তারা সাথে করে পর্যাপ্ত পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, বিদেশীদের আগমন উপলক্ষে সেখানে জনসমাগম হলো, কথা হলো, মতবিনিময় হলো এবং এক পর্যায়ে মেহমানরা তাদের সাথে নীত পরিধেয় তাদের পড়তে দিলেন। গ্রামবাসী পুরুষ-মহিলা-শিশু নির্বিশেষে সবাই মহাখুশী। তারা কাপড় নিলেন, গায়ে দিলেন, নেচে গেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এবং মেহমানদের সাথে ঘুরে ঘুরে ছবিও তুললেন। তারপর যথা পূর্বং তথা পরং। পরিধেয় সেই নতুন জামা-কাপড় খুলে ভাঁজ করে রেখে দিলেন। প্রশ্ন করা হলে জবাব এলো, তোমরা বিদেশী মেহমান। তোমাদের আনীত উপহার আমরা গ্রহন করলাম, তা গায়ে চড়িয়ে তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম এবং যতœ করে রেখে দিলাম। তোমরা আবার এলে তখনও একইভাবে এসব কাপড় পড়ে কৃতজ্ঞতা জানাবো। আর আমরা আমাদের জীবন ধারা নিয়ে ভালোই আছি। এবার বলুন, আপনি কি তাদেরকে পোষাক পড়ার শালীনতা/ভব্যতা শেখাবেন নাকি নিজেই তাদের কাছ থেকে ন্যাংটা হওয়ার কালচার শিখবেন?
ইদানীং ’আদিবাসী, আদিবাসী’ বলে দিকে দিকে বেশ শোরগোল উঠেছে। আর ওই শোরগোলে সুর মিলিয়ে জাতিসংঘ ৯ অগাস্টকে ’বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘেরই একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ’আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’ আদিবাসীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত ১০৭ নম্বর কনভেনশন গ্রহন করে ১৯৫৭ সনে যাতে বাংলাদেশ সম্মতি দেয় ১৯৭২ সনে। সেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জীবন ধারা, সমাজের অপরাপর জনগোষ্ঠী থেকে তাদের ভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনাচার, জীবন যাপনের স্বকীয় পন্থা, ভাষা, সামাজিক রীতি-নীতি, সামাজিক সংস্থা ও আইন-কানুন ইত্যাদির সুরক্ষার কথা বলা আছে। উক্ত বিষয়াদি আলবৎ পালনীয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কেয়ার টেকার সরকার আমলের উপদেষ্টা রাজা দেবাশীষ রায়সহ বাংলাদেশের কতিপয় উপজাতীয় নেতা ও তাদের এদেশীয় সহযোগী আইএলও কনভেনশনে উপজাতিগুলোর নামসহ তাদেরকে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্থানীয় বা আদিকাল থেকে বসবাসরত হিসাবে দেখানোর জন্য জোর তদবির শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে উক্ত সংস্থা ১৯৮৯ সনে ১৬৯ নম্বর কনভেনশন গ্রহন করে এবং বাংলাদেশ যাতে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাতে অনুস্বাক্ষর করে তার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। উক্ত কনভেনশনে চাকমা, মারমাসহ বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় সকল উপজাতীয় গোষ্ঠীর নামসহ তাদের আদিবাসী (ইন্ডিজেনাস) হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তা করতে বার বার অস্বীকার করতে থাকে এই যুক্তিতে যে, বাংলাদেশে আদৌ কোন আদিবাসী নেই এবং কখনো ছিলোও না। বাংলাদেশে যারা রয়েছেন তারা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (এথ্নিক গ্রুপ) বা উপজাতি (ট্রাইবাল)। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী শফিক আহমদ ১৮ জানুয়ারী, ২০১১ তারিখে বলেন, ’বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই।’ ৮ জুন, ২০১১ তারিখ তার দেওয়া বক্তব্য ’বাংলাদেশে যে সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস করেন তারা উপজাতি’ একথার সমর্থনে তিনি ওই বক্তব্য দেন। তিনি আরো বলেন, ’স্বাধীনতার পূর্ব থেকে দেশের কোন নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত লোকজনই আদিবাসী।’ তিনি আইএলও কনভেনশনের কথা উল্লেখ করে ৮ জুন, ২০১১ আরো বলেন, ’আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান্স এবং অষ্ট্রেলিয়ার এব্অরিজিন্স হচ্ছে আদিবাসী। আদিবাসী তাদেরই বলা হয় যারা কোন বিদেশী আধিপত্যবাদীর দ্বারা জবরদস্তি বিতাড়িত হন এবং তা-ই ঘটেছিলো ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সময়। এমনই ঘটনা ঘটায় বৃটেন ও অষ্ট্রেলিয়া। আমাদের বিষয়টি ভিন্ন।’ বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোন অবস্থাতেই যেন ‘উপজাতি’ এর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসাবে উল্লেখ না করা হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কার্যক্রমের উপর নজরদারী বৃদ্ধিকরণসহ সতর্কতামূলক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বরাষ্ট্র সচিব এবং পার্বত্য ৩ জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক বরাবরে এই গোপনীয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে।
২০১১ সনের প্রাথমিক আদম শুমারী রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। চাকমারাই সর্ববৃহৎ যারা সংখ্যায় ৪৪৪,৭৪৮ জন এবং দ্বিতীয় মারমা যাদের সংখ্যা ২০২,৯৭৪ জন। অন্যান্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – সাঁওতাল, গারো, মুরং, তংচঙ্গা, বোম, খাসিয়া, মনিপুরি, ত্রিপুরা, জৈয়ন্তিয়া। বৃহৎ দুটি উপজাতি গোষ্ঠীর দিকে যদি দৃষ্টি দেই তবে দেখি, তারা কেউ বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা নহেন। চাকমারা মূলতঃ আরাকানি। তারা এদেশে অভিবাসী হয় ১৫শ শতকে। আরাকানি রাজা ম্যাং ব্যাং ১৫৪৬ সনে কর্ণফুলী তীরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল দখল করে চাকমাদের পূনর্বাসিত করেন। এরা ভারতের মিজোরাম, অরুণাচল এবং ত্রিপুরাতেও বসতি গড়ে। আবার মারমারাও বার্মার বাসিন্দা। আরাকানি শাসকেরা বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল দখল করে তথায় বর্মী রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আর সে সময়ই মারমারা এখানে বসতি গড়ে। ধর্ম, ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার, পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, গান, বাদ্যযন্ত্রসহ মারমাদের যাবতীয় আচরনই বার্মিজ। চাকমা, মারমা উভয়ই গোষ্ঠীই মূলতঃ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। (সূত্র: আদিবাসী সম্পর্কিত ওয়েবসাইট।)
এবার আসি সমতলের বাসিন্দাদের বিষয়ে। ইতিহাস সাক্ষী, খৃস্টপূর্ব সহ¯্র বছর থেকে আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন যুগ অতঃপর দ্বাদশ শতকের প্রারম্ভে শুরু হওয়া মুসলিম শাসনামল এবং সর্বশেষ ইংরেজ আমল – এই দীর্ঘ তিন হাজার বছর ধরে বাংলায় বসবাস করেছেন সমতলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলো। তন্মধ্যে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের মানুষই ছিলেন। এদেশের আদি বাসিন্দা কি তিন হাজার বছর ধরে বসবাস করা উল্লিখিত জনগোষ্ঠী নাকি মাত্র পাঁচশত বছর পূর্বে বিদেশ থেকে এদেশের পাহাড়িয়া অঞ্চলে উড়ে এসে জুড়ে বসা উপজাতিরা ? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রেওয়াজ থেকে কারো চালচলন ভিন্ন ধরণের হলেই তাকে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে ’বিশেষ’ সুবিধা দিতে হবে- এর আদৌ কি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে? নাকি এই ধরণের দাবীর পেছনে গভীর কোন ষড়যন্ত্র কাজ করছে?
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ইউরোপ বিশেষ করে ইংল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই সকল দেশের আদি অধিবাসীদের উপর কী নিষ্ঠুরতাই না চালিয়েছে। অষ্ট্রেলিয়ায় এদেরকে এব্অরিজিনাল, কানাডায় ইন্ডিজেনাস আর আমেরিকায় বলা হয় রেড ইন্ডিয়ান্স। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান্স ও আলাস্কার এস্কিমোসহ সবার কপালেই জুটেছে নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। মূলতঃ অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আমেরিকার আদি অধিবাসীদের উপর সুসভ্য (?) ইউরোপীয় অভিবাসীদের পরিচালিত নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও জবরদস্তি স্বদেশ থেকে উৎখাতের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ওই সকল অঞ্চলের আদি অধিবাসীরা নিজ দেশে পরবাসী এবং বিদেশী দখলদারদের দ্বারা শোষিত-নির্যাতিত-নিষ্পেষিত। মানবতাবিরোধী এহেন অপরাধের বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতেই আদিবাসীদের সুরক্ষার বিষয়টি পাদপ্রদীপের আলোয় (লাইম লাইট) এসেছে। শ্বেতকায় ইউরোপীয়রা কী পরিমাণ নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারে তার নজির ইতিহাসের পাতায় ভূরি ভূরি। মার্কিন মুল্লুকের কালো অধিবাসীদের নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র। তারই একটি এলেক্স হ্যালী’র ’রুট্স’। কয়েক পর্বের এই ছবিটি বাংলাদেশ টেলিভিশনেও বার কয়েক প্রদর্শিত হয়েছে। ইউরোপীয়রা জাহাজে করে সশস্ত্র অবস্থায় আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে যেয়ে লুকিয়ে উৎ পেতে থাকে। ক্ষেত-খামারে কর্মরত কর্মচঞ্চল হাসি-খুশী কালো মানুষগুলোকে তারা সন্তর্পনে ঘিরে ফেলে এবং তাদের উপর অতর্কিতে জাল ছড়িয়ে দিয়ে পশু বা মাছ ধরার মতো করে ধরে হাতে পায়ে লোহার বেড়ী পড়িয়ে জাহাজ ভর্তি করে এবং তাদের দখল করা নতুন উপনিবেশ সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। সেখানে ওই অসহায় মানুষগুলোকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এরপর রচিত হয় তাদের উপর নির্যাতনের লোমহর্ষক সব কাহিনী যা এককথায় নৃশংস, ভয়াবহ, অমানবিক। যাই হোক, এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করা যাবে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা, প্রায় সমগ্র দুনিয়াকে কলোনী বানিয়ে লুটপাট, শোষণ-বঞ্চণাসহ হেন মানবতা বিরোধী অপরাধ নেই যা তথাকথিত সুসভ্য ইউরোপীয়রা করেনি। কথায় আছে, বেশ্যারা নাকি বুড়ো হলে দোকানদার হয়। ইউরোপীয়রা এখন সাধু সেজেছেন আর বিশ্বময় মানবতাবাদের ফেরি করছেন। তারা এখন ’আদিবাসীর অধিকার’ বিষয়টিকে তাদের সওদার নতুন পণ্য বানিয়েছেন।
ঘটনাস্থল বাংলাদেশ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় দেখভাল করবার জন্য কমিশন (সিএইচটি কমিশন) হচ্ছে ইউরোপের কোপেনহেগেনে। ১২ সদস্যের এই কমিশনের একমাত্র বাংলাদেশী সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল। তিনি আবার ঐ কমিশনের দু’জনের এক কো-চেয়ারম্যান। বৃটিশ লর্ড সভার সদস্য লর্ড এরিক এ্যবভুরি কমিশনের প্রধান। তার বাইরের পরিচিতি হচ্ছে, তিনি একজন মানবাধিকার নেতা। আর প্রকৃত পরিচয় হলো, সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ পূর্ব তিমুর’কে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক স্বাধীন খৃষ্টান দেশ বানানোর অন্যতম প্রধান নায়ক। পূর্ব তিমুর বিষয়ক এসাইনমেন্ট সফল হওয়ার পর তিনি জুম্মল্যান্ড এসাইনমেন্ট নিয়ে এখন কাজ করছেন। দৈনিক হিমছড়ি ১৮ জানুয়ারী ২০১০ ও ১ মার্চ ২০১০ সংখ্যায় ’জুম্মল্যান্ড’ বিষয়ক কলামে আমি এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তখন আমি বলেছিলাম, খৃষ্টান মিশনারীরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মিয়ানমার ও ভারতের পার্বত্যাঞ্চলের বিশাল এলাকা নিয়ে জুম্মল্যান্ড নামে এক স্বাধীন খৃষ্টান দেশ প্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে। বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত উল্লিখিত পার্বত্যাঞ্চলের অধিকাংশ উপজাতিকে ইতোমধ্যে খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষা দেয়া হয়ে গেছে। তাদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করার জন্য জাতিসংঘ (ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি), ইউরোপীয় কমিশন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও (যাদের প্রায় সব ক’টি খৃষ্ট দেশের এবং তাদের হিডেন এজেন্ডা হচ্ছে মিশনারী তৎপরতা পরিচালনা করা। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ১০টি বিদেশী এনজিও সরাসরি খৃষ্টান মিশনারী তৎপরতায় লিপ্ত।) সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। ইউএনডিপি একাই সেখানে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে মর্মে খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ উপজাতি জনগোষ্ঠীর মাত্র ছয় থেকে সাত লক্ষ লোকের জন্য আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা রহস্যজনক নয়কি? আরও একটি ’পূর্ব তিমুর নাটক মঞ্চায়ণ’ ঠেকাতে হলে বাংলাদেশকে নিতে হবে ত্বরিত পদক্ষেপ। সময় কিন্তু দ্রুত ফরিয়ে আসছে। আর ওরা খুবই পাকা খেলোয়াড়।

সেল নাম্বার – ০১৭৩১৪৭৩৪৩৪, E-mail- [email protected]


শেয়ার করুন