বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ কতটুকু মানা হয়?

017422362_30300-550x310 (1)বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ কতটুকু মানা হয়? আর নীতিহীন সাংবাদিকতার বিস্তারের কারণই বা কী? প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের দলবাজি নিয়ে। আছে আর্থিক অসততা ও মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষার অভিযোগ।
এক
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একটি সেরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘মাছরাঙা টিভি’-র একটি প্রতিবেদন প্রচারের পর তা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। প্রতিবেদনের বিষয় নিয়ে কেউ তেমন প্রশ্ন না তুললেও, প্রশ্ন ওঠে উপস্থাপনা নিয়ে। শিক্ষার মান নিয়ে করা সেই প্রতিবেদনে সদ্য এসএসসি পাশ করা কিছু শিক্ষার্থীকে সাধারণ জ্ঞানের কিছু প্রশ্ন করা হয়। সেসব প্রশ্নের অধিকাংশেরই জবাব তারা দিতে পারেনি।
প্রতিবেদনটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। প্রতিবেদনে ওই শিক্ষার্থীদের সরাসরি দেখানো হয়। ফলে তারা সামাজিক, পারিবারিক এবং সামগ্রিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষার্থীদের মুখগুলো সরাসরি প্রতিবেদনে দেখানোর অদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। প্রতিবেদনে যেসব তথ্য, বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তা কি শিক্ষার্থীদের সরাসরি না দেখিয়ে তুলে ধরা সম্ভব ছিল কিনা। আর শিক্ষার মানের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের ‘ফোকাস’ করা ঠিক হয়েছে কিনা।
দুই
বিবিসি বাংলা গত মাসে তাদের ওয়েবসাইটে একটি খবর প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রী’র তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে। তাতে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির নেতা মান্দি এন সাফাদির ইউটিউবে প্রচারিত একটি বক্তব্যের ভিত্তিতে বলা হয়, জয়ের সঙ্গে সাফাদির ওয়াশিংটনে বৈঠক হয়েছিল। এই প্রতিবেদনে জয়ের কোনো বক্তব্য নেয়া হয়নি বা স্বাধীন কোনো সূত্র থেকে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়নি। পরে অবশ্য বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।
তিন
গত ১৪ই ডিসেম্বর কক্সবাজারে ৪০ হাজার অবৈধ মাদক ইয়াবাসহ আটক হন বেসরকারি টেলিভিশন গাজী টিভির স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ সেলিম ও তার স্ত্রী মুন্নি আক্তার। তারা গজী টিভির স্টিকার লাগানো একটি গাড়িতে করে ঐ ইয়াবা বহন করছিলেন। সেলিম একইসঙ্গে কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক কক্সবাজার বার্তা’.র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
উপরের তিনটি ঘটনা যে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সার্বিক চিত্র তা নয়, তবে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন চিত্রও নয়, কারণ, বাংলাদেশে ‘এথিকস অফ জার্নালিজম’ বা সাংবাদিকতার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে প্রায়ই। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহমফুজ আনাম নিজেই সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি ওয়ান ইলেভেনের সময় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তার পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবরকে ‘সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা’ বলে স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, স্বাধীন কোনো সূত্র থেকে ওই তথ্য নিশ্চিত করা যায়নি। ওই খবর প্রকাশকে তিনি ‘সম্পাদকীয় ভুল’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মোট দাগে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করা যায়।
১. রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব
২. মালিক পক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা
৩. ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা আদায়
৪. অদক্ষতা
বেসরকারি টেলিভিশন চানেল একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নীতিহীনতা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে। এটা যতটা না অদক্ষতার কারণে, তার চেয়ে বেশি স্বার্থ, সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক লাভের কারণে হয়েছে। আমি বলবো না সবাই, তবে বড় এক গ্রুপ সিনিয়র সাংবাদিক নিজেদের স্বার্থে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন। একদিকে তারা এটা করে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন, অন্যদিকে মালিকের ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে পদ টিকিয়ে রাখছেন। আমি বলবো, এই দালাল সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার নৈতিক বিচ্যুতির জন্য দায়ী।’’
তিনি বলেন, ‘‘এ সব ক্ষমতাধর নীতিহীন সাংবাদিকদের কাছে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরাও জিম্মি। তারা যদি সিনিয়র ওই সাংবাদিকদের কথা মতো নীতিহীন সাংবাদিকতায় রাজি না হন, তাহলে চাকরি হারাতে হয়। এরকম অনেক উদাহরণ আছে। আমি নাম বলতে চাই না। তাদের সবাই চেনেন। ’’
সাংবাদিকতার নীতিমালা না মানায় অনেক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়ছেন গণমাধ্যমের গ্রাহক। এমনকি কোনো কোনো মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয়ও নেমে আসছে। আর সার্বিকভাবে গণমাধ্যম আস্থার সংকটে পড়ছে।
রাশেদ চৌধুরীর মতে, ‘‘বাংলাদেশে কারো কারো কাছে সাংবাদিকতা অবৈধ সম্পদ আর ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতার অতি প্রয়োজনীয় নীতিমালা এখানে উপেক্ষিত। শব্দ ব্যবহার, জেন্ডার নীতিমালা, ছবি ও ফুটেজের নীতিমালা এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত। নারী ও শিশু, তৃতীয় লিঙ্গ, আদিবাসী, হেট স্পিচ এই বিষয়গুলো এখানকার সংবাদমাধ্যম তেমন আমলে নেয় না বা বুঝতে পারে না। আর এখানে তখ্য ‘ক্রসচেক’ করার ক্ষেত্রে রয়েছে ভয়াবহ ঘাটতি। ’’
তাই তো শিশুকে কোনো ঘটনায় ‘এক্সপোজ’ করা যাবে, কখন যাবে না তা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এ কারণেই এখানে এখানো ‘কিশোর অপরাধীর’ ছবি ছাপা হয়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে দেখানো হয় সংবাদমাধ্যমে। আর কোনো এক পক্ষের অভিযোগ যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এক নারীর ‘চরিত্র’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত বছর। আর সেই নারীর একান্ত ব্যক্তিগত ছবিও প্রকাশ করে। পরে অবশ্য টেলিভিশন চ্যানেলটির বিরুদ্ধে মামলা হয়। আরেক টেলিভিশন চ্যানেল কিশোরদের ‘অপরাধের’ চিত্র সরাসরি প্রচার করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। আর ব্যবসায়িক স্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বা পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করার বহু উদাহরণ আছে বাংলাদেশে।
ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে সংবাদ প্রকাশ করা বা না করা বাংলাদেশে একটি সাধারণ ঘটনা। প্রতিবেদক প্রতিবেদন তৈরির পরও তা আটকে যায় বা উল্টে যায় স্বার্থের কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রধান সমস্যা হলো সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের অভাব। সাংবাদিকতার সাধারণ কিছু নীতিমালা আছে, যা সারা বিশ্বেই স্বীকৃত।
এর বাইরে কোনো কোনো দেশের আইনই সেই দেশের জন্য কিছু নীতিমালা বেঁধে দেয়। আমরা যদি সাংবাদিকতার সাধারণ নৈতিকতা নিয়ে কথা বলি, তাহলে বলা যায় এখানে তা ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। ’’
তিনি বলেন, ‘‘এর প্রধান কারণ প্রশিক্ষণের অভাব । এছাড়া আগে সংবাদ দেয়ার প্রবণতা বা প্রতিযোগিতাও অন্যতম কারণ। তবে এর বাইরে আরো অনেক কারণেই সাংবাদিকতার এথিকস এখানে লঙ্ঘন করা হয়। সেটা রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে হতে পারে।’’
সাংবাদিকতার এই অধ্যাপক মনে করেন, ‘‘এথিকস ভঙ্গ করর বা না মানার কারণে সাংবাদিকরা শেষ পর্যন্ত নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। তারা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যান। ’’
এই দু’জন বিশ্লেষকই অবশ্য মনে করেন এর বাইরে রাজনৈতিক চাপও নীতিমালা ভঙ্গের অন্যতম প্রধান কারণ।
-ডিডাব্লিউ থেকে নেয়া।


শেয়ার করুন