কয়লা গায়েব!

বন্ধ হয়ে গেল বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

এক হাজার ৪২ টন কয়লা গায়েব হওয়ার পর কয়লা সংকটের কারণে সোমবার (২৩ জুলাই) থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের একমাত্র কয়লা ভিক্তিক দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। এতে করে জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ হওয়া ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কমে গেছে।

যার ফলে বিদ্যুৎ সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দিনাজপুরসহ রংপুর বিভাগের আট জেলায়।

এর আগে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করে রাখা ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ হয় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে।যার বর্তমান বাজার মূল্যে ২২৭ কোটি টাকার ওপরে। এ ঘটনায় কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন মহাব্যবস্থাপককে প্রত্যাহার করা হয়। এর পরে একই ঘটনায় আরও একজন মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপককে সাময়িক বরখাস্তও করে কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।

বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাকিম বলেছেন, কয়লা সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ কয়লা সরবরাহ করতে না পারায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটই বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে তারা।

তবে বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদ কয়লা গায়েব এর ঘটনা অস্বীকার করে জানান, কয়লা গায়েব নয় সিস্টেম লস অর্থাৎ রোদে শুকিয়ে, পানিতে ধুয়ে, বাতাসে উড়ে, মাটিতে মিশে অনেক কয়লা নষ্ট হয়েছে। তাই কয়লার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

কয়লা খনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমদকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করে পেট্রোবাংলায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোম্পানি সেক্রেটারি ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করে সিরাজগঞ্জে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে।

আর সাময়িক বরখাস্ত কর্মকর্তারা হলেন- আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান, মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ও খালেদুল ইসলাম উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর)।

এ ব্যাপারে বিসিএমসিএলের একজন কর্মকর্তা জানান, দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই চারজনের বিরুদ্ধে এখন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা যেখানে স্তূপ করে রাখা হয় সেখানে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা মজুদ থাকার কথা ছিল। অথচ সেখানে এখন এক টন কয়লাও নেই বলে জানান কোম্পানির আরেকজন মহাব্যবস্থাপক। প্রতি টন কয়লার বর্তমান বাজার মূল্য ১৬ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ২২৭ কোটি টাকার কয়লার কোনো হদিস নেই।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির অদূরে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হাকিম জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে চালাতে প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাময়িকভাবে উত্তোলন বন্ধ থাকায় ও মজুদ ফুরিয়ে আসায় ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটিতে সোমবার থেকে তিনটি ইউনিটই বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন।

এদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেক্ট্রি সাপ্লাই কোম্পানি লিঃ নেসকো এর রংপুর জোন এর প্রধান প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন সরকার বলেন, ‘রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় প্রতিদিন ৬৫০ মেগওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।কয়লা সংকটের কারণে গত এক মাস থেকে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুইটি ইউনিট বন্ধ থাকায়, সেখান থেকে মাত্র ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসতো।’

‘যার ফলে গত এক মাস থেকে বিদ্যুতের কিছু ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এখন পুরোপুরি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ায় এই ঘাটতি আরও বাড়লো।’

‘বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হলেও, বাইরে থেকে বিদ্যুৎ এনে চাহিদা পূরণ করা হবে’ বলেও জানান তিনি। তবে এতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, এর সাথে লোডশেডিং হতে পারে।

গত সোমবার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য আবু সাঈদ কয়লা খনি এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার পর কয়লা গায়েব হওয়ার কথা প্রথম সামনে আসে।

ঘটনাটি তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদ জানান, ২০০৫ সাল থেকে এখান থেকে এককোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। খোলা আকাশের নিচে কয়লা রাখা হয়। এতে অনেক কয়লা নষ্ট হয়েছে। এটা বোর্ডকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে বোর্ড কাজ করছে।

তার দাবি, যে অভিযোগ উঠেছে তা কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না। তদন্তে সিস্টেম লোকসানের বিষয়টি বেড়িয়ে আসবে।

এ ব্যাপারে নব-নিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইযুব খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডি২৪লাইভের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিঃ এর মহাব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে নতুন ফেইজ থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হবে, কয়লা উত্তোলন শুরু হলেই কয়লার এই সংকট শেষ হয়ে যাবে।’


শেয়ার করুন