পুলিশি নির্যাতনে সাধারণ মানুষ, প্রতিকার নাই

Police_Bd_1-400x224সিটিএন ডেস্ক:

একের পর এক পুলিশি নির্যাতন। সম্প্রতি পরপর ঘটে যাওয়া দুটি পুলিশী নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ মানুষের মাঝে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি।
বুধবার রাজধানীর পল্টনে মেহেরবা প্লাজার সামনে আইয়ুব নামে ব্যাংক এশিয়ার এক কর্মচারিকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মাহবুব নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে আটকে রাখে জনসাধারণ। দুপুর দেড়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত যাত্রাবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনীশঙ্কর কর। গত ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানার উত্তর কুতুবখালির একটি বাসায় ওই নারীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে যাত্রাবাড়ি থানার ওসি অবনীশঙ্কর। তার সঙ্গে আরও দুজন পুলিশ সদস্য জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
বুধবার (২০ জানুয়ারি) দুপুর ২টার দিকে নারী ও শিশু আদালত-২-এ পুলিশ কর্মকর্তা অবনীশঙ্করের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই ‘নির্যাতিত’ নারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন। নারী ও শিশু আদালত-২-এ ওই মামলার আংশিক শুনানিও হয়েছে। তবে আদালতে এখনও এই অভিযোগটি রেকর্ডভুক্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আদালত আগামীকাল আরও শুনানি করে মামলাটি নথিভুক্ত করতে পারেন।’
সাধারণ মানুষ পুলিশি নির্যাতনে শিকার হচ্ছে জেনেও পুলিশের আইজি বলেন ভিন্ন্ কথা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছেন, যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।’
দেশের দুই নাগরিক সম্প্রতি পুলিশী নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর রাষ্ট্রকে ‘মানবিক’ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র তুমি এমন কাজ করো না, যাতে নাগরিকদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি পোস্ট ট্রমাটিক সমস্যা, প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারেন। আর তেমন কিছু হলে রাষ্ট্র কেন বৈষম্য বিলোপ আইন করে তার আওতায় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে না? ১৮ জানয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
পুলিশের নির্যাতনে শিকার হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা বরিশালের আগৈলঝাড়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ও গাছ ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান বাদল সেরনিয়াবাত (৪৫) আহত করার অভিযোগ উঠেছে।
১৬ জানুয়ারি শনিবার দুপুরে এই ঘটনার পর আহতকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার বাদল গৈলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, পেশাগত জীবনে কাঠ ব্যবসায়ী এবং শেরাল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।
আহত বাদল অভিযোগ করেন, দুপুরে দক্ষিণ শিহিপাশা গ্রামের সিরুর দোকানে বসা ছিলেন তিনি। ওই পথে আগৈলঝাড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম থানার পিকআপ নিয়ে স্থানীয় এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় সড়কের পাশে রাখা কাটা গাছ পিকাপে বাধা পেলে ওসি মনিরুল ইসলাম তাকে গালমন্দ করেন। একপর্যায়ে ওসি মনিরুল ইসলাম ও চালক মোকলেচুর রহমান গাড়ি থেকে নেমে এসে এলোপাথাড়ি চড়থাপ্পর মারেন। পরে পিকআপে উঠানোর চেষ্টা করেন তারা।
ময়মনসিংহের ভালুকায় ইউনিয়ন যুবলীগ কর্মী কায়েস মাহমুদকে (৩০) মডেল থানা পুলিশ রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে মারাত্বক নির্যাতন করেছে বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। তবে পুলিশ বলেছেন কায়েস হয়রানী মামলার ওয়ারেন্টভূক্ত আসামি। সে দৌড়ে পালানোর সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ১৬ জানুয়ারি শনিবার রাতে উপজেলার বরাইদ গ্রামে।
সম্প্রতি রাজধানীতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিন যুবক। তাদের মধ্যে দুজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনটি ঘটনাতেই গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে পুলিশের দুই উপ-পরিদর্শক (এসআই)’কে। ক্লোজ করা হয়েছে তিনজনকে।
অভিযুক্ত একজন রয়েছেন বহাল তবিয়তে। পৃথক এই তিন ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। যদিও ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী নির্যাতনের ঘটনায় উপ-কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু আদালতের নির্দেশের কপি থানায় না পৌঁছানোর কারণে তা কার্যকর হয়নি। আদালতের নির্দেশ পৌঁছলেই তা পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি।
গত ৯ই জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুরে খালার বাসা থেকে কল্যাণপুরে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী। তাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মারধর করে বড় অঙ্কের টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদার।
পুলিশের নির্যাতনে গুরুতর আহত রাব্বী এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। রাব্বীর স্বজনরা জানিয়েছেন, এখনও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি রাব্বী। তার মানসিক অবস্থা নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তায় তারা। ঘটনার পরদিন পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন রাব্বী। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়। ক্লোজ করা হয় এসআই মাসুদ শিকদারকে। শনিবার এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের তেজগাঁও জোনের সহকারি কমিশনার মোহাম্মদ হাফিজ আল ফারুক। এ বিষয়ে তিনি জানান, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরই এসআই মাসুদকে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
এদিকে গত ১৫ই জানুয়ারি ভোরে যাত্রাবাড়ী থানার মীর হাজীরবাগ এলাকায় পুলিশের বেদম প্রহারে গুরুতর আহত হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাশ।
এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আরশাদ হোসেন আকাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ক্লোজ করা হয়েছে ওই থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) নূরে আলম, কনস্টেবল শহিদুল ও লিয়াকতকে।
১৭ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ এর সি ব্লকের মুসলিম সুইটসের সামনে থেকে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা প্রলয় বৈদ্যকে আটক করে পুলিশ। এ সময় তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন কাফরুল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আমিনুল ইসলাম। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবগত করা হলে তাকে রাত ১১টায় ছেড়ে দেয়া হয়।
ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করছেন পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারি কমিশনার এডিএম জাকির হোসেন। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। এমনকি বহাল তবিয়তে রয়েছেন এএসআই আমিনুল ইসলাম। এ বিষয়ে প্রলয়ের ভাই পলাশ বৈদ্য জানান, তারা এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত আশা করেন। পুলিশের তদন্তের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। মামলার বিষয়ে কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে পুলিশের মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার কাইয়ুমুজ্জামান খান বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।


শেয়ার করুন