পুলিশকে ধরবে কোন পুলিশ!

bangladesh-policeঅভিযোগ উঠেছে নৃশংসভাবে পিটিয়ে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যার ঘটনায় পাঁচ লাখ টাকা পুলিশকে দিয়ে গত শুক্রবারে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব চলে যায় কামরুল ইসলাম। সামিউলের বাবা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, বুধবার ঘটনার দিন রাতেই তিনি মামলা করতে গেলে জালালাবাদ থানার পুলিশ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। মামলা থেকেও আসল অপরাধীদের আড়াল করতে চেষ্টা করেছে পুলিশ।

পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন নয়। আসামিদের সঙ্গে যোগসাজসে সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়া, আসামিদের নানা সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দেওয়া, সঠিক এফআইআর না করা এবং সঠিক তদন্ত না করা। আবার পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত করার দায়িত্বও যায় পুলিশের কাঁধেই। এই ব্যবস্থাটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এমনটাই উঠে এসেছে মানবাধিকারকর্মীদের কথায়।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চট্রগ্রামের রাউজান থানার ভেতর থাকা সীমা চৌধুরী হত্যা মামলায় বিচারক ১২০ পৃষ্ঠার রায় দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন, এখানে (মামলায়) বাদি পুলিশ, আসামি পুলিশ, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ। এখানে সঠিকভাবে তদন্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের রাউজান থানার সীমা চৌধুরীকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর মধ্যরাতে চার পুলিশ সদস্য বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং পরে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায়। জেলখানার হেফাজতে ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সীমা মারা যায়। ধর্ষণ মামলা হলেও সব আসামি খালাস পায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারক তার রায়ে উল্লেখিত কথা লেখেন। এলিনা খান বলেন, পরে আলামত গোপন ও সঠিক তদন্ত না করায় এলিনা খান তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাদি হয়ে ধর্ষণ মামলা করেন।

ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত, দুর্বল প্রসিকিউশন ও আইনি দুর্বলতার কারণে বেশিরভাগ মামলার সফল পরিণতি হয় না বলে গত পাঁচ জুলাই মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ আয়োজিত ‘মানবপাচার পরিস্থিতি ও সমস্যা উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, পুলিশের তদন্ত ব্যবস্থা মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। ওয়ান সিক্সটিফোর (১৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি) কিভাবে নিতে হয় তাও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা জানেন না। দুর্বল তদন্তের কারণে আমরা অনেক চাঞ্চল্যকর মামলায়ও শাস্তি দিতে পারি না। তদন্তে ত্রুটি থাকলে কোনও মামলা টেকানো যাবে না। সঠিকভাবে তদন্তের জন্য পুলিশের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সাত দিনের মধ্যে আমি আইজিকে ডেকেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, আপনারা আয়োজন করেন, আমরা বিচারপতিদের দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। দরকার হলে আমিও যাব। কিন্তু স্যরি টু সে, এখন পর্যন্ত কোনও সাড়া পাইনি।

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রধান বিচারপতিও এর বাইরে নন। এলিনা খান বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। দ্বিমত পোষণের পথ নেই।

এলিনা খান আরও বলেন, মামলার তদন্তু যেভাবে হওয়া উচিত সেভাবে আমাদের দেশে হয় না। পুলিশ অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে তদন্ত করে।

এলিনা খান বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ সরকারের পক্ষে বেশি কাজ করে। এখানে রাষ্ট্র বনাম সরকার সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এটা মোটেই কাম্য নয়।’

‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, একটি মামলায় যখন পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রকৃত ঘটনা জিজ্ঞেস না করে একটি সাদা কাগজে নিজেদের মতো করে লিখে সেখানে আশপাশের মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এরপর যখন মামলায় সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে সাক্ষীর সাক্ষ্য মেলে না তখন এমনিতেই মামলা দুর্বল হয়ে যায়, মামলার মেরিট নষ্ট হয়। আসামি খালাস পেয়ে যায়। আমি নিজেই এর প্রমাণ।’

একটি মামলার জন্য সুরতহাল রিপোর্ট, স্ক্যাচ ম্যাপ, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, জব্দ তালিকা এবং সাক্ষী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবগুলোর মধ্যে মিল থাকলেই কেবল মামলা শক্ত হতে পারে। কিন্তু এটি সম্ভব হয় না পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের কারণে।

এলিনা খান বলেন, একটি মামলায় একজন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে, সেই তদন্ত দেখার জন্য একজন সুপাইভারজার থাকেন, এরপর সেটি দেখেন একজন পাবলিক প্রসিকিউটর। কিন্তু পিপি’দেরও সেই ভূমিকা আমরা দেখি না। এরপরও তদন্তে দুর্বলতা পেলে অনেক সময় বিচারকরাও পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।

যাদের রক্ষক হিসেবে কাজ করার কথা তারা যদি ভক্ষক হয় সেটা রাষ্ট্রের জন্য একটা বড় ঝুঁকি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে কথাগুলো বললেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ আছে বলে মনে করি না ।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, সরকারের উচিত এ বিষয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করা। নয়তো সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা তৈরি হবে। সরকার এত এত ভালো কাজ করছে, কিন্তু কিছু বিপথগামী মানুষের দায় সরকার কেন নেবে? সরকারকে বুঝতে হবে, সরকারের সমালোচনা করা হয় শুধু দোষারোপ বা বেকায়দায় ফেলার জন্য নয়। একটি সরকার কখনই কোনও বাহিনীর হতে পারে না, সরকার হয় জনগণের।

পুলিশের কোনও মামলায় পুলিশই তদন্ত করে এটা শোভনীয় নয়। তিনি বলেন, একটা কথা আছে, ‘ইউ ক্যান নট বি অ্যা জাজ অন ইউর ওউন কোর্ট।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দায়মুক্তির পথ খোলা থাকে এটা আইনের শাসনের প্রতিও হুমকিস্বরূপ- বলেন ড. মিজান।

বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

—বাংলা ট্রিবিউন


শেয়ার করুন