পাহাড় ঘিরে ষড়যন্ত্র

Pahar-400x181সিটিএন ডেস্ক:

মানব পাচার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র বাণিজ্যের লক্ষ্যে রোহিঙ্গা এবং জঙ্গি সংগঠনগুলো পাহাড় ঘিরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এদের সহায়তা করছে পাহাড়ের স্থানীয় অপরাধীরা। পাহাড়ের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্রে নেমেছে একটি গোষ্ঠী। এরা জঙ্গি ও অপরাধীদের সংগঠনগুলোকে ম“ দেয়াসহ নানাভাবে উস্কানি দিচ্ছে। সন্ত্রাসীদের আত্মগোপনের জন্য আস্তানা তৈরি, মানব ও মাদক পাচারের রুট শনাক্ত করা এবং অস্ত্র মজুদের স্থান চিহ্নিত করে দিচ্ছে স্থানীয় অপরাধীরা। স্থানীয় এবং আশ্রিত সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের নিরীহ মানুষকে অস্ত্র ও মাদকের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিছু এলাকার মানুষকে মাদক (পপি) চাষে বাধ্য করেছে সন্ত্রসী সংগঠনগুলো। তবে গোয়েন্দা নজরদারির এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের মুখে সংগঠনগুলো এক জায়গায় স্থির হতে পারছে না।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, দুর্গম এলাকায় স্থায়ী আস্তানা গড়ে তোলার জন্য জমি লিজ নেয়ার চেষ্টা করছে একাধিক নিষিদ্ধ উগ্রপন্থী জঙ্গি সংগঠন। এসব জমিতে আত্মরক্ষা ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল শেখানোর লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতেই তারা এ উদ্যোগ নেয়। জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়টি গোপন করে অন্য নামে লিজ নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জমি লিজ নেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। সংগঠনগুলো এ কাজে উগ্রপন্থী রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। সমতলের একটি সংগঠনের নেতাদের মাধ্যমে এজন্য অর্থও জোগান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বান্দরবানের থানছি, নাইক্ষ্যংছড়ি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ও উত্তর রাঙ্গুনিয়ার দুর্গম জনপদে বেশির ভাগ জঙ্গি সংগঠন তাদের আস্তানা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলের বাইশারী, আলীখিয়ং, পানছড়ি, দুছড়ি, তুমব্রজ যোগাইন্না ও গুনধুমও তাদের পছন্দের জায়গা। সমতলের একটি সংগঠনের স্থানীয় নেতারা পাহাড়ি এলাকায় ঘাঁটি করার জন্য তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে। তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানের মুখে কেউ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, উগ্রপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাঁটি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের নজরদারির কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। কেউ ঘাঁটি গাড়তে পারবে না। বিভিন্ন সময় আইনশৃংখলা বাহিনী পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গিদের অনেক ঘাঁটি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গিরা এ অঞ্চলে ঘাঁটি করার পরিকল্পনা করছে। তাছাড়া মাদক পাচার, অস্ত্র বাণিজ্য, রোহিঙ্গা প্রতিরোধেও এ অঞ্চলে কাজ করছে যৌথ বাহিনী।

তিনি বলেন, আরাকান আর্মির ইস্যুর পর আমরা কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করেছি। যাতে করে কেউ এ দেশে ঘাঁটি করতে না পেরে সে বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নজরদারি ও গোয়েন্দা অনুসন্ধান বাড়াতে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিছু স্থানীয় লোক স্বার্থের বিনিময়ে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এ ধরনের কয়েকজনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। যেহেতু দুর্গম এলাকাকে বেছে নিচ্ছে অপরাধী ও জঙ্গিরা তাই এসব এলাকায় যেন নজরদারি করা হয় সে বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সম্প্রতি বান্দরবানের থানছিতে বিজিবি ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের গোলাগুলি হয়। অভিযানের মুখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এর পরদিন আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে সংগঠনটির একাধিক সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের আস্তানা হিসেবে একটি সাদা রঙের দোতলা বাড়ির সন্ধান পায় আইনশৃংখলা বাহিনী। এ বাড়ি থেকে সেনা পোশাক উদ্ধার করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাড়িটি ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। এর আগে পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাসীদের একটি ঘাঁটির সন্ধান পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এখানে বিমান ছিনতাই, সামরিক কায়দায় ফায়ারিং, বোমা তৈরি এবং বিভিন্ন স্থানে হামলার কৌশল শেখানোর কাগজপত্র, বুকলেট উদ্ধার করে। এছাড়া এই ঘাঁটি থেকে বিপুল অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে র‌্যাব। চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি মাসে এ ঘাঁটির সন্ধানের পর গুঁড়িয়ে দেয় র‌্যাব।

সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাকে বেছে নিচ্ছে। সমতলে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের মুখে তারা দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। আত্মগোপনের পাশাপাশি অস্ত্র লুকিয়ে রাখছে। এছাড়া পাহাড়ে অস্ত্রের চালানের লেনদেনও হচ্ছে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য মানুষ অপহরণ করে পাহাড়ে লুকিয়ে রাখার ঘটনা ঘটছে। মুক্তিপণ দিতে দেরি হওয়ায় অনেককে ফিরিয়েও দেয়া হয়নি। নৌপথে মানব পাচারের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগ্রহীদের এনে রাখা হচ্ছে পাহাড়ের গোপন আস্তানায়। সেখান থেকে সুবিধামতো সময়ে ট্রলারে তুলে দেয়া হচ্ছে। একইভাবে সীমান্ত পার হয়ে আসা মাদকের চালানও পাহাড় হয়েই দেশে ঢুকছে। পাহাড় থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা পাহাড়ে বসবাসকারী অভাবী মানুষগুলো সম্পর্কে জানে। নগদ টাকা দিয়ে তাদের প্রায় কিনে ফেলার মতো অবস্থা করে রেখেছে গ্র“পগুলো। টাকার বিনিময়ে অভাবী মানুষগুলো সন্ত্রাসীদের হয়ে কাজ করছে। কেউ কাজ করতে না চাইলে তাদের কঠোর সাজা ভোগ করতে হয় বলেও জানা গেছে। ফলে তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসীদের হয়ে কাজ করছে। তাদের জন্য গোপন আস্তানা তৈরি করে দিচ্ছে। সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করছে। এদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছে।

আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাহাড়ে অভিযান চালাতে গিয়ে গত ২০ বছরে (১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত) সন্ত্রাসী হামলায় বান্দরবান জেলায় দুজন সেনা সদস্য, এক এসআইসহ ৫ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। একই সময়ের মধ্যে ২ জন মৌজা হেডম্যান, একজন ইউপি চেয়ারম্যান এবং আরও ২০ জন নিহত হন। এ সময়ে শতাধিক অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় একং গুমের ঘটনা ঘটেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সাতছড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের পর র‌্যাব আরও অভিযান এবং অনুসন্ধান জোরদার করে। পাহাড়ি অঞ্চলে অপরাধীরা গহিন এলাকা বেছে নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে অনুসন্ধান ও নজরদারি অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা ওই অঞ্চলকে ব্যবহার করছে নানা কারণে। এর মধ্যে তারা দুর্গম বা যেখানে মানুষের আগাগোনা কম সে ধরনের স্থান ব্যবহার করে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধী বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড় একটি দুর্গম জনপদ। প্রয়োজন না হলে কেউ কারও খবর রাখে না। অপরাধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতেও অনেক সময় লেগে যায় আইনশৃংখলা বাহিনীর। এই সুযোগে অপরাধীরা গা ঢাকা দেয়। এরা স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সহায়তায় সহজেই আত্মগোপন করতে পারে। তারা যত সহজে পাহাড়ে লুকাতে পারে আইনশৃংখলা বাহিনী সেই গতিতে অভিযান চালাতে পারে না। এছাড়া অনেক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরদারিও শিথিল থাকে। আইনশৃংখলা বাহিনী দূর থেকে নজরদারি করে। নিজস্ব সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। কোথাও কোথাও নজরদারি কমে যাওয়ার সুযোগ নেয় অপরাধী গোষ্ঠী। এ সুযোগে তারা আশ্রয়স্থল ও প্রশিক্ষণের ঘাঁটি তৈরির চেষ্টা করে। এ ধরনের শিথিলতার সুযোগে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি ঘাঁটি গড়ে তোলে অপরাধীরা। গত ফেব্র“য়ারি মাসে র‌্যাব এই ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে উত্তপ্তাবস্থা বিরাজ করছে তাও এক ধরনের ক্রাইমের অন্তর্ভুক্ত। এটাকে আমরা ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা আন্তঃদেশীয় অপরাধ বলে থাকি। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এ ধরনের অবস্থা বিভিন্ন কারণে হতে পারে যেমন মাদক পাচার, রোহিঙ্গা ইস্যু ও মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো। এ ধরনের কার্যক্রমগুলো করতে বাধা পেলেই সংশ্লিষ্টরা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে দিয়ে এদের দমনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে কক্সবাজারের শতাধিক রোহিঙ্গা প্রশিক্ষণ নিয়ে শিবিরে অবস্থান করছে। কক্সবাজারের রামুর খুনিয়া পালং, ঈদগড়, সদর উপজেলার ইসলামপুর, চকরিয়ার হারবাং, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম এলাকায় ছোট ছোট গ্র“পে বিভক্ত হয়ে এই জঙ্গি গ্র“পগুলো কাজ করছে। আফগানিস্তান ফেরত মুজাহিদ মাস্টার আইয়ুব এদের সঙ্গে কাজ করছে। ১৯৯৬ সালে এই ক্যাম্প সংলগ্ন ল্যাদাখালী এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৪১ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। তাদের বেশির ভাগ জঙ্গি জামিনের পর পাহাড়কে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। যুগান্তর


শেয়ার করুন