পাঠোদ্ধার হয়নি যে প্রাচীন লিপি-সংকেতের

সিটিএন ডেস্ক 

অতীত চিরকালই রহস্যে ঘেরা। অতীতের ছিটেফোঁটা যা কিছু সামনে চলে আসে, সেগুলো দিয়েই ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া সময়কে জানার চেষ্টা চলছে। অতীত উন্মোচনের অন্যতম হাতিয়ার হলো মানুষের রেখে যাওয়া লেখা, সংকেতলিপি। অতীতের লেখার অক্ষর বা চিহ্ন ভিন্ন, অনেকটা সংকেতের মতো। অঞ্চল ও সময়ভেদে এসব সংকেত বা চিহ্নের ধরনেও ভিন্নতা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার ২০০ বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয়দের মাটির ফলক লেখার প্রাচীনতম পদ্ধতিগুলোর একটি। বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় খোদাই করা উটপাখির ডিমের খোসা খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোর বয়স আনুমানিক ৬০ হাজার বছর। হয়তো লেখার বয়স আমাদের ভাবনার চেয়েও বেশি। সংস্কৃতির জন্ম প্রায় হোমো সেপিয়েন্সের মতোই প্রাচীন।
বিশ্ব ইতিহাসের নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অসংখ্য ফলক, স্ক্রল, লিপি উদ্ধার হয়েছে, যার অনেকগুলোই হেঁয়ালিপূর্ণ। এগুলোর কোনো কোনোটার পাঠোদ্ধার সম্ভব হলেও রহস্যে আবৃত রয়েছে গেছে অনেকগুলো। এসব গোপন সংকেতের আড়ালে কী তথ্য লুকিয়ে আছে, সে নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন পণ্ডিত ও গবেষকরা। কিছু কিংবদন্তি সংকেত ও পাঠ্যও রয়েছে, যা এমনকি বিশ্বে সেরা ক্রিপ্টোগ্রাফার, কোড উদ্ধারকারী ও ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে এখানো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু এসব লিপিগুলোয় কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলোকে বোঝার চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকায় এসব ধাঁধার রহস্যভেদের গুরুত্বও অপরিসীম। একনজরে পাঠোদ্ধার হয়নি এমনই কিছু বিখ্যাত ভাষা, সংকেত ও লিপি—

লিনিয়ার এ
১৮৯৩ সালে এথেন্সের বাজার থেকে রহস্যময় লিপিসহ কিছু প্রাচীন শিলা কিনেছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার আর্থার ইভান্স। পরবর্তী সময়ে ক্রিট দ্বীপের নসোসে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় তিনি শিলাগুলোর একটি সংকেত চিনতে পারেন এবং দ্বীপের বিভিন্ন স্থান থেকে আবিষ্কৃত খোদাই করা ট্যাবলেট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সংকেতগুলোর মধ্যে তিনি দুটি ভিন্ন পদ্ধতির সন্ধান পান, যেগুলোকে তিনি ‘লিনিয়ার এ’ ও ‘লিনিয়ার বি’ নাম দেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ‘লিনিয়ার বি’ পাঠোদ্ধার করা গেলেও অধরা রয়ে গেছে ‘লিনিয়ার এ’।
ধারণা করা হয়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ১৪৫০ অব্দের মধ্যে ক্রিটবাসী প্রাচীন মিনোয়ানদের লেখার পদ্ধতি হলো ‘লিনিয়ার এ’। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থেরার অগ্ন্যুত্পাতে ধ্বংস হয়ে যায় মিনোয়ান সভ্যতা।
ওলমেক ফলক
আমরা মেসোআমেরিকার প্রাচীন, শক্তিশালী মায়া ও আজটেক সভ্যতার সঙ্গে সুপরিচিত। কিন্তু এর বাইরে আরেকটি তৃতীয় রহস্যময় সংস্কৃতির কথা আমরা ভুলে যেতে বসেছি—ওলমেক সভ্যতা। ১২০০ থেকে ৪০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত এ সভ্যতা বিকশিত হয়। কিন্তু দক্ষিণ-মধ্য মেক্সিকোর স্যাঁতসেঁতে, ক্রান্তীয় নিম্নভূমিতে তাদের প্রায় সব ধরনের ভঙ্গুর নিদর্শন, এমনকি কবরস্থান পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল কিছু স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্যের পাশাপাশি কাঠের কিছু বিরল নিদর্শন টিকে গেছে, যার মধ্যে পাথরের তৈরি কিছু দৈত্যাকৃতি মাথা রয়েছে।
১৯৯৯ সালে সড়ক নির্মাণের সময় একটি লিপিবদ্ধ পাথরের ট্যাবলেট আবিষ্কারের পর সভ্যতাটির লিখন ব্যবস্থা সামনে আসে। ট্যাবলেটে ৬২টি প্রতীক রয়েছে, যার কিছু দেখতে ভুট্টা বা পোকার মতো, বাকিগুলো অনেক বেশি বিমূর্ত। ট্যাবলেটটি খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সালের বলে জানা গেছে, যা এখন পর্যন্ত পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে প্রাচীনতম লেখার নিদর্শন। এই লিপির অর্থ এখনো উদ্ধার হয়নি।
ভিনকা প্রতীক
দানিউব লিপি, ভিনকা চিহ্ন ও প্রাচীন ইউরোপীয় লিপি হিসেবেও পরিচিত ভিনকা সিম্বল। নিউলিথিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম সহস্রাব্দে) মধ্য ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের ভিনকা সংস্কৃতির নিদর্শনে এ লিপি পাওয়া গেছে। সিংহভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, এটি কোনো লিখন পদ্ধতি নয়, বরং ব্যক্তিগত প্রতীক বা কোনো ধরনের অলংকার। তবে স্বল্প সংখ্যক ইতিহাসবিদ মনে করেন, এটি আসলে প্রথম দিকের লিখন পদ্ধতি, যা অন্যান্য প্রাথমিক লিখন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে।
১৯৮৫ সালে রোমানিয়ার টরডোসে (বর্তমান টুরডাস) প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় অপরিচিত কিছু প্রতীক আবিষ্কার করা হয়। পরে ১৯০৮ সালে সার্বিয়ার শহরতলি ভিনকায় একই ধরনের লিপি উদ্ধার হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ ভিনকা প্রতীক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। এ সংখ্যকই প্রাচীন মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু ভিনকা প্রতীকগুলো নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা গবেষকদের। প্রতীকগুলো জ্যামিতিক নকশা নাকি পূর্ণ বিকশিত লিখন ব্যবস্থা সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে পণ্ডিতদের মধ্যে।
মায়া হায়ারোগ্লিফিকসে রহস্যময় লিপি
শত শত বছর ধরে ভাষাবিদরা মায়া সভ্যতার প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিকস লিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছেন। পর্বতের গায়ে খোদাই, রঙিন মৃিশল্প আর হস্তনির্মিত বাকলের কাগজে এসব লিপি লেখা রয়েছে। মায়া সভ্যতার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দিকগুলো বোঝার জন্য এ লিপিগুলোর গুরুত্ব অসীম। পাঠোদ্ধার প্রক্রিয়ার দ্রুত উন্নতি ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে নিকট ভবিষ্যতেই লিপিগুলো রহস্যের দ্বার খুলে দেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তবে লিপিগুলো আদতে কোনো ভাষার প্রতিনিধি নয় বা এটি কোনো সম্পূর্ণ লিখন পদ্ধতি নয় বলে দীর্ঘদিন পণ্ডিতরা মনে করে আসছিলেন। কখনো মানব, পশু, অপার্থিব বস্তুর আকৃতির শত শত অতুলনীয় চিহ্ন আর বিমূর্ত নকশা লিপিটিকে অত্যন্ত জটিল করেছে। ১৯৫০-এর দিকে প্রথমবার পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি ঘটে। মায়ান লিপিটি অন্তত আংশিকভাবে ধ্বনি নির্দেশক বলে জানা যায়।
ইস্টার দ্বীপের দুর্বোধ্য রঙ্গোরঙ্গো লিখন
উনিশ শতকে বিশ্বখ্যাত ইস্টার দ্বীপে খোদাই করা চিহ্ন-সংবলিত প্রাচীন শিল্পকর্ম আবিষ্কার হয়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কয়েক হাজার মাইল পশ্চিমের প্রত্যন্ত দ্বীপটি শত শত মনোলিথিক নৃতাত্ত্বিক দৈত্যাকৃতি মূর্তির জন্য সুপরিচিত, স্থানীয়ভাবে যেগুলোকে মোয়াই বলে ডাকা হয়। আবিষ্কৃত জটিল নকশাগুলো প্রতীক বা কোনো ধরনের লেখা হিসেবে বোঝা গেলেও আজও এসব সংকেতের মানে উদ্ধার করা যায়নি। অনেকেরই বিশ্বাস, এ রহস্যময় লিপির অর্থ উদ্ধার হলে দ্বীপটির প্রাচীন সভ্যতার পতনের কারণ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
১৮৬৪ সালে ইস্টার দ্বীপে মিশনারি হিসেবে গিয়ে রঙ্গোরঙ্গো লিপি প্রথম উদ্ধার করেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের খ্রিস্ট ভিক্ষু ইউজিন ইরাউদ। দ্বীপ থেকে অস্বাভাবিক লিপিসংবলিত ২৬টি কাঠের ট্যাবলেট খুঁজে পাওয়ার কথা লিখে গেছেন ইরাউদ। রঙ্গোরঙ্গো প্রতীকগুলোর আকৃতি মানুষ, পশু, উদ্ভিদের মতো। লিপিগুলোয় জ্যামিতিক নকশাও রয়েছে।
হেঁয়ালিপূর্ণ ভায়নিচ পাণ্ডুলিপি
১৯১২ সালে নিলামে অংশ নিতে রোম যান পোলিশ-আমেরিকান বই ব্যবসায়ী উইলপ্রিড এম ভায়নিচ। সেখানেই তিনি একটি তোরঙ্গের ভেতর খুঁজে পান ১৫ শতকের বিরল পাণ্ডুলিপি, যা ভায়নিচ পাণ্ডুলিপি নামে আজ বিশ্বে সুপরিচিত। আবিষ্কারের পর পরই অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে পাণ্ডুলিপিটি, চলছে বহু গবেষণা। কিন্তু এর নকশা, লেখা এমনকি বিশ্বের বহু স্বনামধন্য ক্রিপ্টোগ্রাফারেরও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ইয়েলের বাইনেকে রেয়ার বুক অ্যান্ড ম্যানুস্ট্রিপ্ট গ্রন্থাগারে তালাবদ্ধ রয়েছে পাণ্ডুলিপিটি।
কে লিখেছে ভায়নিক পাণ্ডুলিপি, আজো জানা যায়নি। এমনকি এর ভাষাও অপরিচিত। পাতায় পাতয় আঁকা চিত্রগুলো রহস্যে ভরপুর। পুরো লেখায় যে গুপ্ত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কোনো ক্ষেত্রে কিছু শব্দ কেবল একটি নির্দিষ্ট অংশে ব্যবহার হয়েছে, কখনো কিছু অক্ষর কেবল নির্দিষ্ট শব্দে। শব্দের বারংবার ব্যবহারও ভীষণ অদ্ভুত, চেনাজানা কোনো ছন্দের সঙ্গে এর মিল নেই। অনেকের ধারণা, কোনো তথ্য গোপন করতে লেখক এ ভাষা তৈরি করেছেন। আবার কারো কারো মতে, এটা কোনো পাগলের প্রলাপ। তবে ভায়নিক পাণ্ডুলিপির গোলকধাঁধা সমাধানের দিকে চোখ রয়েছে সবার।
সিন্ধু উপত্যকার ভাষা
প্রায় চার হাজার বছর আগে বর্তমান পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান ও ইরানজুড়ে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা, যা অনেক সময়ই হরপ্পা সভ্যতা হিসেবেও পরিচিত। প্রাচীন আমলের জলবায়ু পরিবর্তন সভ্যতাটির বিলুপ্তির কারণ হিসেবে ধরা হয়। মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল হরপ্পার, বেশকিছু মেসোপটেমিয়ান গ্রন্থে যাদের ‘মেলুহা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার লোকরা লেখার যে পদ্ধতি ব্যবহার করত, আজো তার রহস্য উন্মোচিত হয়নি। তবে তারা যে লেখার জন্য একাধিক সংকেত ব্যবহার করত, সেটা জানা গেছে। পণ্ডিতরা আশা করছেন, হয়তো কোনো একদিন সিন্ধু ও মেসোপটেমিয়ান (ভাষাটির জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়েছে) দুই ভাষাতেই লেখা টেক্সট উদ্ধার হবে, আর তা সিন্ধু সভ্যতার লেখনীর রহস্য খুলে দেবে। যদি এমন কোনো টেক্সট থেকেও থাকে, তবে ইরাক বা আরব উপকূলের কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। অতি সম্প্রতি সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার বিষয়ে গবেষণাপত্র লিখে আলোড়ন তুলেছেন বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়।
মেরোইটিক লিপি
সুদানের মেরোই শহরে কুশ রাজ্যের আমল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর থেকে ৩৫০ অব্দ পর্যন্ত। এ রাজ্যের মানুষরা লেখার জন্য মেরোইটিক ভাষা ব্যবহার করত। টানা ও হায়ারোগ্লিফিকস—এ দুই ধরনের লিপি মেরোইটিক লেখায় ব্যবহূত হতো। ১৯০৭-১১ সালে ব্রিটিশ মিসরবিদ ফ্রান্সিস গ্রিফিথ লিপিগুলোর রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তবে মেরোইটিক ভাষাটি সম্পর্কে এখনো বহু কিছু জানা বাকি রয়ে গেছে। সঠিক ভাষাজ্ঞানের অভাবে পণ্ডিতরাও লিপিগুলোর যথাযথ অনুবাদ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।


শেয়ার করুন