পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা বঞ্চিত : অমর্ত্য সেন

PPPPসিটিএন ডেস্ক:
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমরা কত বঞ্চিত, তা এখন বোঝা সম্ভব হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড এবং প্রতীচী ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ রবিবার গোর্কি সদনে রবিবার প্রকাশ করে অমর্ত্যবাবু নিজের বক্তব্য লিখিত ভাবে দেন। সেই লেখাতেই ওই মন্তব্য করেছেন তিনি। যা সংখ্যালঘু উন্নয়ন সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবির উল্টো সুর বলেই মনে করছেন অনেকে।
সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় মুসলিমদের দুর্দশা নিয়ে যথেষ্ট হইচই হয়। সেই রিপোর্টকে হাতিয়ার করেই মমতা মুসলিম ভোটকে নিজের পক্ষে আনেন এবং ক্ষমতায় আসেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তিনি দাবি করে আসছেন, তাঁর জমানায় মুসলিমদের বিরাট উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ দিন স্ন্যাপ, গিল্ড এবং প্রতীচীর তৈরি যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে অমর্ত্যবাবু লিখেছেন, ‘‘বাঙালি মুসলিমদের যে কতটা বঞ্চনা সহ্য করতে হয়, তা কেবল বহু মাত্রিক পাঠের মাধ্যমেই বোঝা যায়।’’ অর্থনীতিবিদের মতে, সাচার কমিটির রিপোর্ট পরোক্ষ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই রিপোর্টটির ভিত্তি প্রত্যক্ষ ভাবে পাওয়া তথ্য।
অমর্ত্যবাবুর বক্তব্য, ওই রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের দরিদ্র এবং বঞ্চিত মানুষদের সিংহভাগই মুসলিম। জীবনের মানের নিরিখে তাঁরা অসমঞ্জস ভাবে দরিদ্র এবং বঞ্চিততর। আর্থিক ভাবে বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা উচ্চ শ্রেণিতে থাকতে পারেন, তাঁদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে ভূমিহীন, শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া এবং গরিব মুসলিমের বিশেষ উপকার হবে না বলেও অমর্ত্যবাবু জানিয়েছেন।
অমর্ত্যবাবুর আরও বক্তব্য, অতীতের প্রেক্ষিতে বর্তমানের বঞ্চনাকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি অঞ্চলের ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চিত মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা জমি সম্পর্ক, সামাজিক বাধা, ব্যবসার সুযোগ, সরকারি সাহায্যের ব্যাপ্তি এবং সীমা এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। অতীতের আলোয় বর্তমানকে বুঝতে হলে ইতিহাসে ভাল দখল থাকা প্রয়োজন।
ওই রিপোর্ট এবং অমর্ত্যবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু বিত্ত উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওই সংস্থাগুলির রিপোর্ট আমরা দেখিনি! আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি লিখে ওঁদের কাছে ওই রিপোর্টের কপি চাইব। কীসের ভিত্তিতে, কী ভাবে, কেমন সমীক্ষা করেছেন, দেখব। আর আমাদের সরকার কী কী কাজ সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য করেছে, তার একটা রিপোর্ট অমর্ত্যবাবুর কাছে পাঠিয়ে দেব।’’
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার কখনওই বলেনি, ৩৪ বছরে আমরা সব কাজ করে ফেলেছিলাম। কিছু কাজ করেছিলাম। অনেক কাজ বাকিও ছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সার্বিক ভাবে উন্নয়ন। সরকারের শেষের দিকে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা করে উন্নয়নের চেষ্টাও করেছিলাম।’’ এর পর সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রথম বছরেই সংখ্যালঘু-সহ সব ক্ষেত্রেই ৯০ শতাংশ কাজ করা হয়ে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, উনি যা করেছেন, তা ৪০০ বছরেও কেউ করতে পারবে না। তার মানে এই সরকার ফিরে এলে অমর্ত্যবাবুদের সমীক্ষায় যেমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তেমন অবস্থাই ৪০০ বছর থাকবে। সেই জন্যই আমরা বলছি, শুধু সরকার নয়, অবস্থার বদল চাই।’’ সেলিমও মনে করেন, সাচার কমিটির রিপোর্ট ছিল সরকারি সূত্রে পাওয়া পরোক্ষ তথ্য-নির্ভর। কিন্তু ওই সংস্থাগুলি প্রত্যক্ষ সমীক্ষা করেছে। তার জন্য ওই তিন সংস্থাকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন সেলিম।
প্রসঙ্গত, বাম এবং কংগ্রেস দু পক্ষেরই অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে একটা মনিটরিং কমিটি থাকে। যা রাজ্যে রাজ্যে সংখ্যালঘুদের জন্য কী কাজ হচ্ছে, তার উপর নজরদারি চালায়। মোদী সরকারের আমলে এ রাজ্যের জন্য মনিটরিং কমিটিতে সিপিএমের সেলিম এবং কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)-র নাম ছিল। তা নিয়ে তৃণমূল দিল্লিতে প্রবল আপত্তি জানানোয় শে পর্যন্ত কমিটি গঠিত হয়নি। তার ফলে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে এ দিন সাহিত্যিক শক্সখ ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের সমাজজীবনে বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক অপরিচয় আছে। তার থেকে আসে অজ্ঞানতা। সেখান থেকে জন্মায় অবিশ্বাস। তার থেকে আসে অসহিষ্ণুতা। সেখান থেকে তৈরি হয় অশান্তি, যা কখনও কখনও দাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।’’ পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ই এই সমস্যা ঠেকানোর পথ এবং সেটা সরকারের নয়, সমাজের দায়িত্ব বলে শক্সখবাবু মনে করেন।
ওই অনুষ্ঠানে এ দিন অমর্ত্যবাবুর বক্তৃতা করারই কথা ছিল। কিন্তু যে বিমানে তিনি দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন, সেটি দেরি করে। ফলে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে তিনি অনুষ্ঠানে পৌঁছন। তা ছাড়া, তাঁর শরীরও বেশ খারাপ। তা সত্ত্বেও এ দিন সকাল থেকে তাঁকে দু’টি বৈঠক করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তিনি এ দিন বক্তৃতা করতে পারেননি। কিন্তু বললে যা বলতেন, তা দিল্লি এয়ারপোর্টে বসে লিখে ফেলেন। সেটাই পরে অনুষ্ঠানে দেওয়া হয়। এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, দিল্লি থেকে এ দিন যাত্রী বেশি থাকায় তাঁদের অন্য একটি বিমানের ব্যবস্থা করতে হয়। সেটি দেরিতে আসে এবং তার পরে তাতে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। সব মিলিয়ে বিমান ছাড়তে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট দেরি হয়।-আনন্দবাজার।


শেয়ার করুন