কক্সবাজার বন বিভাগের উদাসিনতা

পরিবেশ সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন চরম ভোগান্তিতে উপকারভোগীরা

মোজাম্মেল হকঃ
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ: বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে প্রায় ৪৫০.০ বর্গ কি:মি এলাকা জুড়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ বিস্তৃত। ২৪/৬/২০০১ ইং তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন নং পবম/ শা-২/ বন (প্রা:স:)-২২ (৬) ২৯৬ মূলে কক্সবাজার বন বিভাগকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ গঠন করা হয়। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে ৩৬৬০২.০৫ হেক্টর সংরক্ষিত বন ভূমি এবং ৭৫৭২.৮৬ হেক্টর রক্ষিত বনভূমি রয়েছে। হাতী, হরিণ, বানর ও হনুমান ইত্যাদি সহ অসংখ্য পাখ-পাখালীর বিচরণ সম্বলিত এ বিভাগের বনাঞ্চল খুবই প্রকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত। বঙ্গোপসাগর ঘেষা শত বছরের পুরনো গর্জন বন, ঐতিহাসিক কদম গুহা, টৈংগার পাগাড় সমৃদ্ধ টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, নেটং পাহাড়, কক্সবাজাস্থ রাজার কুল বোটানিকেল গার্ডেন, সমুদ্র তটের প্রায় একশত কিলোমিটার ব্যাপী নয়নাভিরাম ঝাউ বাগান ও অপূর্ব-নৈসর্গিক হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক, দরিয়া নগর পিকনিক স্পট, ইনানী ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার প্রভৃতি এ বন বিভাগের অনন্য বিশিষ্ট্য।

সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্য: সামাজিক বনায়ন হলো স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে উপকারভোগী হিসাবে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রম। বনায়ন পরিকল্পণা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বৃক্ষরোপন ও পরিচর্যা, বনজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, লভ্যাংশ বন্টন ও পূন:বনায়ন ইত্যাদি সব কাজেই তারা ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত থাকবে। ভূমিহীন, দরিদ্র, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্থ গ্রামীণ জনগনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করাই সামাজিক বনায়নের মূল লক্ষ্য। সামাজিক বনায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্ঠি করে তাদেরকে Sepl  Dependent হিসাবে গড়ে তোলা।

সামাজিক বনায়ন: দেশের সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০০৪ কে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করে প্রনয়ন করা হয়েছে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০১০। বন বিভাগ কতৃক বাস্তবায়িত সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের আওতায় এ যাবৎ প্রায় ৭৯,২৯৮ হেক্টর উডলট বাগান, ১০,৬২৬ হেক্টর কৃষি বন বাগান, ৬৬,৪৭২ কি:মি ষ্ট্রীট বাগান সৃজন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানে প্রায় ৭ লক্ষ ১ হাজার ৪৮৮ জন উপকার ভোগী সম্পৃক্ত আছেন। তন্মধ্যে মহিলা উপকারভোগীর সংখ্যা ১লক্ষ ৩৪ হাজার ৫৪২ জন।

বনায়নের প্রসার: বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে যে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ব্যাপক বনায়নের লক্ষে ১০ কোটি ১৫ লক্ষ ৪০ হাজার চারা বিক্রয় ও বিতরণ করা হয়েছে। শুরু হতে ২০১৮-২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের আওতায় ৪৩ হাজার ৯৪৩ হেষ্টর এবং ১৮ হাজার ৩৬২ কি:মি: বাগান কর্তন করা হয়েছে। উৎপাদিত কাঠ বিক্রি করে ১২২৭ কোটি ৮২ লক্ষ ১৮ হাজার ৯১০ টাকা পাওয়া গেছে। এ যাবৎ ১ লক্ষ ৯১ হাজার ৮৫৪জন উপকারভোগীর মাঝে বিতরণকৃত লভ্যাশের পরিমাণ ৩৮৩ কোটি ২৩ লক্ষ ৫ হাজার ৪৫ টাকা। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩৩ কোটি ৫৮ লক্ষ ৪৫ হাজার ২শত ৩২ টাকা।

কক্সাবজার বনায়ন: কক্সবাজার উত্তর-দক্ষিণ-বন বিভাগের অধীনে অন্তত ১০ হাজার হেষ্টরের ও বেশি বনভূমিতে সামাজিক বনায়ন গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক দফা বাগান কেটে সেখানে পূনরায় গড়ে তোলা হয়েছে (টিএফএফ) উডলট ও ফলজ বাগান। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে কক্সবাজার উত্তর-দক্ষিণ বন বিভাগের জমিতে ২০০১ সাল থেকে সামাজিক বনায়নের কার্যক্রম শুরু হয়। এই এলাকার অসংখ্য হত দরিদ্র উপকারভোগী নারী-পুরুষ বন বিভাগের সাথে অংশিদারিত্ব মূলক দলিল চুক্তির মাধ্যমে বনায়ন তৈরী করে আসছে। শুধুমাত্র একটু নজরদারী ও বাগান রক্ষনা-বেক্ষনের মাধ্যমে এসব উপকারভোগী নারী-পুরুষ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে সক্ষম হচ্ছে।

উপকারভোগীদের হয়রানি: বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে উপকার ভোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব হত দরিদ্র উপকারভোগীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে একটি বাগানকে মেসিউরড করে তোলে। চারা রোপন, সার প্রদান, পরিচর্যা, ডাল-পালা কর্তন, দলবেঁধে পাহারা দেওয়াসহ নানাবিধ পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি বাগান যখন ১০ বৎসরে পদার্পন করে এবং বাগান কর্তনের সময় হয় তখন থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা চর্চা শুরু হয়। সামাজিক বনায়নের মিয়াদ যখন ১০ বৎসর পূর্ণ হয় তখন- রেঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় বাগানের সব গাছ গুলো মার্কিং করতে। মার্কিং শেষ হলে ‘লড’ বাঁধার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।‘লড’ বাঁধা শেষ হলে, লড গুলো অকশন দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। অকশন পর্যায়ে শুরু হয় নানাবিধ বিড়ম্বনা। অনেক গুলো বাগানের এক সাথে অকশন দেওয়ার জন্য সিডিউল তৈরী করা হয়। সিডিউল অনুযায়ী অকশন আহবান করা হয়।

একটি বাগানের অকশন পর্ব শেষ হতে এক থেকে দেড় বৎসর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এরপর শুরু হয় উপকারভোগীদের লভ্যাংশ দেওয়ার পালা। উপকারভোগীগণ লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য দফায় দফায় বিভিন্ন অফিসে ধর্ণা দেওয়ার পরও সময় মত লভ্যাংশ আদায় করতে পারে না। একবার রেঞ্জ অফিসে, রেঞ্জ অফিস থেকে এসিএফ অফিসে এবং এসিএফ থেকে ডিএফও অফিসে দৌড় ঝাঁপ করতে করতে অবশেষে বাগানের অংশিদার প্রতিটি উপকারভোগী থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎকুচ গ্রহণ করার পর লভ্যাংশের চেক ছাড় হয়। এত কিছু হয়রানি পর ভবিষ্যতে কেউ কি সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী হতে আগ্রহী হবে? সামাজিক বনায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি পূর্ণ হবে? কাজেই বন বিভাগের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিল পদ্ধতি পরিহার করে অতি সহজিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক বনায়নের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায় সামাজিক বনায়ন থেকে উপকারভোগীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে করে সবুজ বনায়ন উজাড় হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ অতিশীঘ্রিই মরু অঞ্চলে পরিণত হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, খরা, বন্যা অতিবৃদ্ধি, অনাবৃদ্ধি, ঝড়-তুফান জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দেখা দেবে।

প্রভাষক
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
টেকনাফ সরকারি কলেজ।


শেয়ার করুন