নিরাপত্তাহীনতায় নারী মিডিয়া কর্মীরা

91682_f1সিটিএন ডেস্ক:

সোমা ও জুতি (ছদ্মনাম)। চাকরি করেন কাওরান বাজারের একটি মিডিয়া হাউসে। অফিস শেষে রাতে বাসায় ফিরেন তারা। কিন্তু ইদানীং বাসায় ফিরতে আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় তাদের। সাম্প্রতিক কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ওলটপালট করে দিয়েছে তাদের মনোজগৎ। একদিন কাওরান বাজারে সিএ ভবনের সামনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোটরসাইকেল আরোহী তাদের লক্ষ্য করে অশালীন কথা বলতে থাকেন। যার বেশির ভাগই মুদ্রণ অযোগ্য। জুতি বর্ণনা করছিলেন আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। রাত তখন সাড়ে নয়টা। মাইটিভি অফিসের ঠিক দশ গজ দক্ষিণে। হাঁটতে ছিলেন তিনি। হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার ‘এক্স করোলা’ তার পাশে এসে গা ঘেঁষে থামালো। সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজনের একটি গ্র“প প্রাইভেট কার থেকে রাস্তায় নামলো। একজন বলে উঠলেন, আমাদের সঙ্গে চলেন। কোথায় যাবেন, পৌঁছে দেবো। এ কথা শুনেই জুতি দ্রুত ভয়ে আশপাশের মানুষের দিকে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে প্রাইভেট কার গ্র“প ওই স্থান থেকে খুব দ্রুত সটকে পড়লো। শুধু সোমা ও জুতি নয়, ঢাকা শহরে এভাবেই হাজার হাজার নারী প্রতিনিয়ত রাতে এ রকম গ্র“পের মুখে পড়ছেন। কেউ কখনও বলছেন। কেউবা হজম করছেন নীরবে। তাদের প্রশ্ন- আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? এ ছাড়া পরিবহন সংকটের কারণে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করছেন কামরুন নাহার। অনেক সময় ক্লাস শেষ হতে তার রাত ৯টা বেজে যায়। তখন ধানমন্ডি থেকে মতিঝিলের আরামবাগ তার বাসায় না পৌঁছা পর্যন্ত প্রচ- আতঙ্কে থাকেন তিনি। কারণ, প্রায়ই নানা বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। ‘র’ আদ্যক্ষরের এক নারী চাকরি করেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে। তিনি রাতে চলাচলে তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এ প্রতিবেদকের কাছে। যাকে তিনি ‘সেক্সসুয়াল হেরেজমেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই নারী কর্মী বলেন, একদিন কাওরান বাজার থেকে একটি গণপরিবহনে ওঠেন তিনি। বাসের ভেতরে তিনি সামনে একটি সিটে বসেছিলেন। কিন্তু একটি ছেলে অনাকাঙিক্ষতভাবে তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে। একপর্যায়ে ওই ছেলেটি তাকে সেলফোন নম্বর দিয়ে বলতে থাকে ফোন দিও। তিনি জানান, ‘শুধু ইয়াং ছেলেরাই নয়, বয়স্করাও মাঝে মাঝে মেয়েদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করে। পুরুষদের এমন আচরণে মনে হয়, রাতে যেসব মেয়ে চলাচল করে তারা সবাই খারাপ নারী।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ২১শে মে রাতে রাজধানীতে মাইক্রোবাসে তুলে এক গারো তরুণীকে গণধর্ষণ করে একদল যুবক। ২১ বছর বয়সী এ তরুণী কুড়িলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন একদল যুবক তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। রাতে ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য মেয়েটিকে নিয়ে থানায় থানায় ঘুরে পুলিশের অসহযোগিতার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় অভিভাবকদের। চলতি বছরের আগস্টের গোড়ার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গণধর্ষণের শিকার হন বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজের এক ছাত্রী। ওই কলেজছাত্রী এক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন। ভাটারা এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক শিশু। যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই ফয়সাল, শাহাদাৎ ও বাবু নামের তিন যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। একই মাসে রাজধানীর উত্তরায় এক কর্মজীবী তরুণী কর্মস্থল থেকে বন্ধুর সঙ্গে বাসায় যাওয়ার সময় গণধর্ষণের শিকার হন। এর আগে জুলাইয়ে লালবাগে এক তরুণীও বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন।
নারীদের জীবিকার তাগিদে কিংবা নানা কাজে বাইরে যেতে হয়। আসলে ঢাকা শহরকে নারীদের জন্য ‘অনিরাপদ’ ভাবেন কিনা? এ প্রশ্ন রাখা হয় ঢাকার রাস্তায় বেশ কজন পুরুষের কাছে। অনেক পুরুষ বলেছেন, আজকাল রাতে নারীদের চলাফেরা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ রকম একজন যাত্রী মাহমুদ। তিনি একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, রাতে নারীদের চলাফেরায় এখন ব্যাপক সমস্যা হয়ে পড়েছে। একদিন এক মেয়ের সঙ্গে দু-তিন পুরুষকে অপ্রীতিকর কিছু কথা বলতে শুনেছি। তা একপর্যায়ে বাকবিতা-ে রূপ নেয়।
গত ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে বিভিন্ন শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেন। এ সময়ে দেশে ২৪৪৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তারা উল্লেখ করেন। নেতারা বলেছেন, বাসে, ট্রাকে, মাইক্রোবাসে, নৌকায়, রিকশায় গণধর্ষণ প্রতিদিন ঘটে চলেছে। সুতরাং এ পরিস্থিতি উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন) মুনতাসিরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। রাতে যারা এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হন তাদের থানায় বা পুলিশের কাছে দ্রুত অভিযোগ দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কন্ট্রোল রুমকে জানাতে পারেন। টহল পুলিশকে জানালে সহায়তা দেবে। গাড়ির নম্বর রাখতে হবে। সবাই সচেতনভাবে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে এ রকম ঘটনা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
নগরীতে পরিবহন সংকটে যত ভোগান্তি: নিত্যদিনের যাত্রায় পরিবহনে নৈরাজ্যের কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষের জীবন। রাজপথে প্রাইভেট কারের বিস্তার, গণপরিবহন কমে যাওয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানসহ বিভিন্ন কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রতিদিনের যাত্রীরা। চাহিদার প্রায় অর্ধেক বাস-মিনিবাসে ঝুঁকি নিয়ে দুর্ভোগের যাত্রা সারেন সাধারণ মানুষ। সমপ্রতি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটকের অভিযানে অনেক বাস গ্যারেজবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্ভোগের রাজধানীতে পরিণত হয়েছে এ নগরী। যাত্রীবাহী বাস কমে যাওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাসে চড়তে পারছেন না যাত্রীরা। সেই সঙ্গে রয়েছে দুর্ভোগের যানজট। বিশেষ করে সকালে অফিস শুরুর আগে ও বিকালে ছুটি শেষে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। নারী ও শিশু, অসুস্থ, বয়স্ক যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বি আরটিএ) পরিসংখ্যাস অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে রাজধানীর রাস্তায় প্রাইভেট কার নেমেছে ১০ হাজার ১৭০টি। গড়ে প্রতিদিনে ৪৮টি করে। অথচ এ সময়ে মিনিবাস নেমেছে মাত্র ৫২টি। এর আগে ২০১৪ সালজুড়ে রাজধানীতে প্রাইভেট কার রেজিস্ট্রেশন নিয়েছিল ১২ হাজার ৯৭২টি। প্রতিদিন গড়ে ৩৬টি করে। এ সময় মিনিবাস রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে মাত্র ১৩৫টি। রাজধানীর রাজপথে পালা দিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বাড়ছে না গণপরিবহন। ফলে দুর্বিষহ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। রাজধানীতে বর্তমানে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি রয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। নগরীতে মানুষের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। কিন্তু বাড়তি যাত্রী-চাহিদার বিপরীতে গণপরিবহন না বেড়ে বরং কমে গেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির (মেট্রো আরটিসি) বাসরুটের তালিকা অনুযায়ী, ১৬৬টি রুটে সাত হাজার ৩৬২টি গাড়ির সিলিং থাকলেও বর্তমানে অর্ধেকের বেশিতে যানবাহন নেই। সিটিতে চলছে চার হাজারের কিছু বেশি বাস। পরিবহন মালিকরা বলেছেন, যাত্রী বাড়লেও রাজধানীতে যানজটের কারণে বাসের ট্রিপসংখ্যা (আসা-যাওয়া) কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। এজন্য নতুন গাড়ি রাস্তায় নামানোর ব্যাপারে মালিকদের আগ্রহ কম।
রাজধানীর যানজট ও পরিবহন নিয়ে চলতি বছরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগ এক গবেষণা পরিচালনা করে। পুরকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এ বিষয়ে মানবজমিনকে জানান, তাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা শহরে গণপরিবহন আরও বাড়াতে হবে। পথচারীদের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। হাদিউজ্জামান আরও জানান, ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে কোন পরিবহন মিলে মোট ২২ মিলিয়ন ট্রিপ দেয়া হয়। ট্রিপের গড় দূরত্ব ৫ দশমিক ৪ কিলোমিটার। প্রতি ট্রিপে ৩০ মিনিট করে দেরি ধরে এ হিসাব করা হয়েছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে ঢাকা সিটিতে বছরে আর্থিক হিসেবে ৩২ হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টার ক্ষতি হয়। এ হিসেবে প্রতিদিন ৮৭ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার টাকা আর ঘণ্টা হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৬৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বিপুল জনসংখ্যার নগরে সাধারণ পথচলা মানুষের জন্য গণশৌচাগারের (পাবলিক টয়লেট) সংখ্যা ৭৯টি। সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও নোংরায় এগুলো সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিতান্ত বিপদে পড়ে শুধু পুরুষেরা এসব গণশৌচাগার ব্যবহার করতে বাধ্য হন। আর নারীদের কথা না বলাই ভাল। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কর্মকর্তারা বলেছেন, জায়গার অভাবে তারা নতুন গণশৌচাগার নির্মাণ করতে পারছেন না। আর যেখানে জায়গা আছে, সেখানে শৌচাগারের চাহিদা কম। শৌচাগারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবহারোপযোগী করা প্রসঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, বার্ষিক চুক্তিতে কিছু শর্তসাপেক্ষে শৌচাগারগুলো ইজারা দেয়া হয়। এগুলো দেখবাল করার দায়িত্ব আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের। এ ক্ষেত্রে শৌচাগার পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব ইজারাদারের। ডিসিসির আওতাধীন এলাকায় যে ৭৯টি শৌচাগার আছে তার ৫৪টি দক্ষিণে এবং ২৫টি উত্তরে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ কাজের তাগিদে বাড়ি থেকে বের হন। তাদের শৌচাগারের প্রয়োজন। সে হিসাবে মহানগর ঢাকায় শৌচাগারের যে সংখ্যা, তা খুবই নগণ্য। মহিলাদের টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী বলে তিনি মন্তব্য করেন। জনসংখ্যার বিবেচনায় শহরে প্রচুর স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার দরকার। বিশেষ করে রেল, বাসস্টেশনে এগুলো তৈরি করতে হবে। উন্নত দেশে তিন ধরনের টয়লেট আছে উল্লেখ করে এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, তা হলো সাধারণ, প্রস্রাব ও পায়খানা এবং গোসল করার জন্য আলাদা। সিটি করপোরেশন তো তৈরি করবেই। এ ছাড়া এনজিওগুলো এগিয়ে আসতে পারে শৌচাগারে তৈরিতে। এগুলোর তদারকি করতে হবে। সূত্র: মানবজমিন


শেয়ার করুন