দৈনিক হিমছড়ি’র ১৮ বছর

Humayionহুমায়ুন সিকদার:

সংবাদপত্র শিল্পের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এর পথচলা আদৌ কুসুমাকীর্ণ ছিল না। নানা বন্ধুর পথ পেরিয়ে সংবাদপত্র আজ শিল্পের মর্যাদায় আসীন। যে পত্রে সংবাদ পরিবেশিত হয় বা বিদেশীদের সহস্র সংবাদকে বুকে ধারণ করে যে পত্র সর্বসাধারণের সামনে পরিবেশিত হয় সে পত্রকে সংবাদপত্র বলে। এ জন্য সংবাদপত্রকে Current History বা ইতিহাস চলন্তিকা বলে। সংবাদপত্রকে ইংরেজীতে News Paper বলে। কেননা চর্তুমেরুর সংবাদ পরিবেশিত হয় News শব্দটির পূর্ণরূপ হচ্ছে N-North, E-East, W-West, S-South.অর্থাৎ উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ তথা চর্তুদিকের খবরের সমন্বয় জালের সমাবেশ। বলা বাহুল্য ওই কাগজের চলতি বিশ্বের খবরা খবর লিপিবদ্ধ হয়। তাই একে সংবাদপত্র বা ইতিহাস চলন্তিকা বলা হয়। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চীনে সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয় বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। এরপর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও রুমসহ আস্তে আস্তে সারাবিশ্বে সংবাদপত্র চালু হয়। বর্তমান প্রযুক্তি যুগে সংবাদপত্র ঘটনা প্রবাহ জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সংবাদপত্র বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। মাসিক, পাক্ষিক, সপ্তাহিক ও দৈনিক। অন্যান্য বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সংবাদপত্র রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ জেলা কক্সবাজারে রয়েছে ১৮’র অধিক দৈনিক। তৎমধ্যে কক্সবাজার পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ‘হিমছড়ি’ নামকে ধারণ করে প্রকাশিত হয়েছে ‘দৈনিক হিমছড়ি’। হিমছড়ি জেলা সদর থেকে ১০ কি:মি দক্ষিণে ঝর্ণাবেষ্টিত নয়নাভিরাম লীলাভূমি পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে প্রতিবছর দেশে-বিদেশ থেকে লক্ষ কোটি মানুষ আগমণ করে থাকে এক নজর দেখার জন্য। সত্যিকার অর্থে ওই নামকে ধারণে প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে দেড় যুগ আগে এই পত্রিকাটি। ১৯৯৭ সালে কক্সবাজারে শুধুমাত্র পত্রিকা ছিল ৩টি। তৎমধ্যে দৈনিক হিমছড়ি, দৈনিক কক্সবাজার ও দৈনিক সৈকত। তখন লেটার প্রেসে পত্রিকা ছাপানো হতো। লেটারে প্রেসে পত্রিকা ছাপানো কত কষ্টকর তা যারা প্রত্যক্ষদর্শী তথা তখনকার পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন তারাই একমাত্র ভূক্তভোগী। এরপরেই প্রকাশিত হয় দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ ও দৈনিক বাঁকখালী। ১৯৯৯ সালে স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যাদি নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। ২০০২ সালে দৈনিক বাঁকখালীতে ষ্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করে আমার সাংবাদিকতা পেশা শুরু। এ পেশায় দৈনিক বাঁকখালীই আমার হাতেখড়ি। এরপরে অগ্রজ জনাব শারেক ভাই’র আহ্বানে ২০০৮ সালের অক্টোবরে দৈনিক হিমছড়ি পরিবারের সদস্য হয়ে অদ্যাবধি কর্মরত আছি। নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে ১২ ডিসেম্বর। তখন কক্সবাজারে ৬টি পত্রিকা প্রকাশিত হত- দৈনিক হিমছড়ি, দৈনিক কক্সবাজার, দৈনিক সৈকত, দৈনিক আজকের দেশবিদেশ, দৈনিক বাঁকখালী ও দৈনিক দৈনন্দিন। তখনকার সময়ে অনলাইনের ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। সংবাদ সংগ্রহে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যেতাম ওই সময়। এছাড়া ওই আমলে অফিসে জনবল কম থাকায় রুটিন মাফিক রাতের দায়িত্ব পালনের পর সকালে লঞ্চঘাটে পত্রিকার বান্ডিল দিয়ে আসা এবং অসংখ্যবার অফিসের জন্য নাস্তা আনাসহ আন্তরিকতার সহিত হকারের দায়িত্ব পালন করেছি। একইভাবে অগ্রজ সম্পাদক জনাব শামসুল হক শারেক ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব হাসানুর রশীদ ভোর সকালে অফিসে এসে জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পত্রিকা পৌঁছেছে কিনা তা নিয়মিত তদারকি করতেন। এছাড়া সহকর্মী কাইসারুল ইসলাম বিজ্ঞাপন বিভাগের দায়িত্বের পাশাপাশি ভোর বেলায় সার্কুলেশন বিভাগও দেখাশুনা করতেন। মুলত তখন বলতে গেলে আমরা চার জনই এ পত্রিকায় সাংবাদিক, ষ্টাফ ও হকার। হিমছড়ির এ পর্যন্ত পথচলা এই ৪ জনের ত্যাগ ও অবদান কোন অংশে কম নয়। কোন একটি প্রতিষ্ঠানকে পরিচিতি ও স্থায়ীত্ব করার নিমিত্তে কিছু ব্যক্তিবর্গের ত্যাগ-কোরবানী ও আন্তরিক পরিশ্রম থাকে। দৈনিক হিমছড়িতে আমাদের ৪ জনেরই ওই ত্যাগও আন্তরিক পরিশ্রমে এ পর্যন্ত চলমান। অনেকটা সেই আলোচিত পক্তির মতো ‘যখন তোমার কেউ ছিলনা, তখন ছিলাম আমি/আমরা- এখন তোমার সব হয়েছে পর………।’
পাশাপাশি উপজেলা প্রতিনিধিদের সহযোগিতাও বলার মত। অফিসে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরীতে কলাকৌশল সম্পর্কে যথার্থ ধারণা দিতেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অগ্রজ জনাব শামসুল হক শারেক এবং তখন থেকে এই পর্যন্ত যার আন্তরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়েছি তিনি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব হাসানুর রশীদ। এ দুই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদ্বয়ের কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ রাখবে আমাকে। উখিয়া প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকালীন সময় ২০১০ সালে আমাদের সাথে অফিসে যুক্ত হয়েছেন সহযোদ্ধা এএইচ সেলিম উল্লাহ। বর্তমানে বলতে গেলে পত্রিকাটি সাজানো ফুলের বাগান। আজ সাজানো এ বাগানে সহযোদ্ধারা অনেকেই কর্মরত আছেন।
বর্তমানে দৈনিক হিমছড়ি’র ১৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ৬ ফেব্রুয়ারী। যুগপূর্তি উপলক্ষে হিমছড়ি পরিবারকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে অত্র দৈনিক জেলায় অনেক ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। উন্নয়ন সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী দৈনিক হিমছড়ি। কেননা নির্ভীক, বস্তুনিষ্ট ও সাহসী এবং নিরপেক্ষ একটি দৈনিকের নাম হিমছড়ি। হিমছড়ি কোন সংবাদকে রং দিয়ে বা তিলকে তাল করেনা। সত্য প্রকাশে আপোষহীন পত্রিকার নাম দৈনিক হিমছড়ি।
নৈস্বর্গিক সমূদ্ররানী সৈকত বেলাভূমি রূপসী কক্সবাজার জেলার ঐতিহ্য সুখ দুঃখের সমন্বয় অগ্রগতির পদক্ষেপসহ উন্নয়নের কথা বলার যার অঙ্গীকার তার নাম দৈনিক হিমছড়ি। শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি জৈবিক ও মৌলিক চাহিদার সমাবেশ দৈনিক হিমছড়ি। কক্সবাজারে অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত গ্রাম বাংলার মানুষের কথা বলে সকলের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে দৈনিক হিমছড়ি। সকলের প্রত্যাশা হলুদ তথা অপসাংবাদিকতাকে পরিহার করে আপোষহীন বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনের ধারা অব্যাহত থাকবে হিমছড়ি পত্রিকার। সাংবাদিকতার নীতিমালা, সংবাদপত্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শকে ধারণ করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে দৈনিক হিমছড়ি। বিশ্বখ্যাত সমূদ্ররানী কক্সবাজারের শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, চোরাচালান ও রোহিঙ্গামুক্তকরণে দৈনিক হিমছড়ি যথেষ্ট থাকবে এটাই আমার আত্মবিশ্বাস। মিথ্যার ছড়াছড়ি, আর্থিক-ব্যবসা, আন্দাজ-অনুমান নির্ভর সংবাদ পরিবেশন থাকবেনা দৈনিক হিমছড়িতে এটাই আমার প্রত্যাশা।
প্রখ্যাত জার্মান সাংবাদিক এসডব্লিউ টলেস্টয়’র মতে সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র শিল্প অনেকটা হুমকির মুখে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, সমাজপতি, কালোবাজারী ও রাজনীতিবীদ তথা অপেশাদারীদের হাতে সংবাদপত্র জিম্মি হওয়ায় প্রকৃত সংবাদসেবীরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কেউ পত্রিকা কিনে আবার কেউ ভাড়া নিয়ে রাতারাতি সম্পাদক/ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিক হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। যারা সংবাদ’র ইন্ট্রু পর্যন্ত লিখতে জানেনা তাদের দ্বারা জাতি কি আশা করবে! তারা মুলত তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, সমাজনীতি, রাজনীতি, সেভ করার জন্য সংবাদপত্রের শরনাপন্ন হয়েছে। এছাড়া নিজেকে এ পেশায় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হিসেবে জাহির করার জন্য পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া লাভের চেয়ে ক্ষতির দিকই বেশী বলে জেলার সিনিয়র এক সাংবাদিক মনে করেন। তাদের দ্বারা সংবাদপত্রের সেবা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেয়ে ব্যক্তির চরিত্রহনন ও উস্কানিমূলক সংবাদ পরিবেশন! ফলে তাদের পশ্রয়ে যত্রতত্র সাংবাদিক কার্ডের ছড়াছড়ি, যা এ ধান্দ্বাবাজদের বিচরণ চোখে পড়ে। ফলে এ পেশার প্রকৃত সাংবাদিকদের মাথা হেড হয়ে যায়। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির প্রকাশিত ২০১৪ সালের আইনকণ্ঠ নামক স্মারকগ্রন্থে বিশিষ্ট আইনজীবী কবি সোলতান আহমদ ‘ধান্দ্বাবাজ সাংবাদিক’ নামে কবিতার পংক্তি- লেখাপড়া হলনা বেশ ডিগ্রী যখন নাই অগতির তাই গতি হল সাংবাদিকতাই, লেখার কায়দা শিখে নিলো যোগ্যতাটা সার- হয়ে গেল পত্রিকাতে মস্ত রিপোর্টার, সাংবাদিকের ‘ডান্ডি কার্ড’ মস্ত হাতিয়ার, যাকে তাকে ব্লেকমেইলিং এ কে দেয় বাঁধা আর? দূর্বলতায় টোকা মেরে হাতায় মালকড়ি- সৎ সাংবাদিক অপবাদে লজ্জায় যান মরি, মহান পেশার কলঙ্ক আজ মাত্র গুটিকয়, সাংবাদিক না সাংঘাতিক তাই সর্বজনে কয়।
দৈনিক হিমছড়ি হীনমন্যতা পরিহার করে স্বাধীনচেতা ও স্বকীয় নীতির কারণে পাঠকের হৃদয় জয় করত সামর্থ্য হয়েছে। দৈনিক হিমছড়িতে রয়েছে একঝাঁক তরুণ অথচ অভিজ্ঞ সাংবাদিক। যারা হিমছড়ির প্রাণ বললেও অত্যুক্তি হবেনা। যাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে এ পর্যটন নগরীকে দেশ বিদেশে পরিচিতি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। অনেক সমৃদ্ধ লেখনী সারাদেশে আলোচিত হচ্ছে। সাগর আর পাহাড়ের সমন্বয়ে আমাদের প্রিয় কক্সবাজার। সাগরের বিশালতা পাহাড়ের মৌনতা উদার আকাশের নীচে ধ্যানী সাধকের ন্যায় সৌম্য ধ্যান মগ্ন। প্রাকৃতিক কারণে এখানকার মানুষেরা শান্ত প্রকৃতির উদার মনোভাবাপন্ন। এখানকার জনগোষ্ঠি বিভিন্নভাবে অবহেলিত। পর্যটন নগরী হওয়া সত্ত্বেও এখানকার রাস্তা-ঘাট অনুন্নত। বিশ্বখ্যাত সমূদ্র সৈকত শ্রীহীন। পর্যটন শিল্পে অকাল বৈধব্যের চিহ্ন। স্বাস্থ্য এলাকা হিসাবে স্বাস্থ্যের মান অনেক নীচে। মাদকাসক্তির কালো থাবায় তরুণ সমাজ বিপদগামী। প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কাটা, ভূমি দখল, চর দখল, নদী দখল ও প্যারাবন দখল এখানকার নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। ঘুষ-দূর্নীতি ওপেন সিক্রেট, সীমান্তে চোরাচালান, রোহীঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ও অনৈতিক কর্মকান্ডই জেলার উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। এ সমস্ত বাঁধাগুলোকে ডিঙ্গিয়ে জেলার সার্বিক উন্নয়নে লেখনীর মাধ্যমে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে দৈনিক হিমছড়ি এটাই জেলার অগণিত পাঠককূলের প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশা পূরণে দৈনিক হিমছড়ির সুন্দর ও উজ্জ্বল সফলতা। ১৯৯৭ সালে হিমছড়ির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অগ্রজ মুহাম্মদ শামসুল হক শারেক’র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে আজ পর্যন্ত প্রকাশনার বহুল প্রচার অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হাসানুর রশীদ’র সম্পাদনায় নিয়মিত হিমছড়ি প্রকাশিত হচ্ছে।
দল, ব্যক্তি, গোষ্টিপ্রীতি ও শায়েস্তা করার মনমানসিকতা ছিলনা এবং ভবিষ্যতেও থাকবেনা অত্র দৈনিকে। অন্যায়, অসুন্দর নয় বরং সত্য প্রকাশে অবিচল থাকবে দৈনিক হিমছড়ি। বঞ্চিত, নির্যাতিত ও গণমানুষের সমস্যার কথা বলবে দৈনিক হিমছড়ি। তাহলেই জনপ্রিয়তা ও গণমানুষের মুখপাত্র হিসাবে হৃদয়ে অঙ্কিত থাকবে দৈনিক হিমছড়ি। দৈনিক হিমছড়ির পথচলা সফল হউক। এ কামনা করছি মহান আল্লাহর নিকট। -আমীন।

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক হিমছড়ি।


শেয়ার করুন