“দূষণ হঠাও হালদা বাচাও”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রাণোচ্ছল শিক্ষার্থী, যারা সুযোগ পেলেই ছুটে যান নদী ভ্রমনে । তবে সেটা মোটেও আনন্দ ভ্রমণ নয়, বরং এই ছুটে যাওয়া শুধুমাত্র নদীর প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসা থেকেই । হ্যা আমরা বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য । আমরা চেষ্টা করি শত সমস্যায় জর্জরিত নদীগুলোকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করতে ও নদী বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে । আমরা কাজ করি মৃতপ্রায় নদী গুলোকে দুষণের হাত থেকে বাচানোর জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি ও নিরীহ, অবহেলিত নদীকেন্দ্রিক মানুষ গুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ।

“দূষণ হঠাও হালদা বাচাও” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গেল ২৫শে আগস্ট বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এবারের গন্তব্য ছিল মা মাছের ম্যাটারনিটি ক্লিনিক নামে পরিচিত দক্ষিন এশিয়াতে কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী । হালদার বর্তমান অবস্থা ও এখানে পরিচালিত বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের গবেষণার প্রকৃতি জানতে কথা হয় স্থানীয় অধিবাসী ও মাৎস্যজীবিদের সাথে ।

নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকে আয়োজিত এই ভ্রমনে অংশ নেন হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র ও মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মাদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাকী বিল্লাহ ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ।

সরেজমিনে ভ্রমণ করে ও স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় যে কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র এই নদী অনেক আগে থেকেই জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে । কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে এই নদী তার স্বকীয়তা হারিয়েছে । নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করা, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ও কিছু অসাধু ব্যাবসায়ীদের অবাধে মা মাছ নিধনের কারনে হালদাতে মা মাছের ডিম ছাড়ার পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।

স্থানীয় এক ডিম সংগ্রহকারী বলেন এবছর তার হিসাবমতে হালদা থেকে পাওয়া সর্বমোট ডিমের পরিমান ১০ হাজার কেজি থেকেও কম । যদিও সরকারি হিসাবমতে এই পরিমান অনেক বেশি যার কারন হিসাবে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেছাচারিতাকেই দায়ী করেন । এভাবে চলতে থাকলে হালদা নদীর এই ঐতিহ্য খুব বেশিদিন টিকে থাকবে না বলে তিনি মনে করেন ।

হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন বাংলাদেশে কোন নদীকে যদি জাতীয় নদী হিসাবে ঘোষনা করতে হয় তাহলে হালদা নদীকেই করা উচিত । কারন বাংলাদেশে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশেই শেষ হওয়া এটিই আমাদের একমাত্র নদী যার উৎপত্তি খাগড়াছড়ী পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার বদনাতলী পাহাড় থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কর্ণফুলীতে এসে শেষ হয়েছে । যার উপর উজানের কোন দেশের নিয়ন্ত্রন নেই । তাই এটি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র ও মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মাদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না বলেন বাংলাদেশ নামক দেহে বঙ্গোপসাগর হল হৃদপিণ্ড ও দেশের সমস্ত নদীগুলা এর শিরা উপশিরা স্বরুপ তাই আমাদের সকলের উচিত হালদা সহ দেশের সকল নদীগুলোকে সংরক্ষণের জন্য কাজ করা । চবির ফিশারিজ বিভাগের ছাত্র ও বানপদ চবি শাখার সাধারন সম্পাদক মোঃ সোহরাব হোসেন সোহাগ মনে করেন যে হালদা নদীকেন্দ্রিক সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের গবেষক দলের উচিত স্থানীয় মৎস্যজীবিদেরকে সাথে নিয়ে তাদের গবেষণা পরিচালনা করা । কারন তথাকথিত তাত্বিক জ্ঞানের সাথে ব্যাবহারিক জ্ঞানের সংমিশ্রন না ঘটাতে পারলে কোন গবেষণা ই ফলপ্রসূ হতে পারে না। বরং ফলাফল হিতে বিপরীত হতেপারে । একথার প্রমান পাওয়া গেল হালদা নদীর মাদারীপোল পয়েন্টে সারিবদ্ধ অসংখ্য বাঁশ দেখে ।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল এগুলো কোন এক সরকারী গবেষণা প্রজেক্ট কতৃক স্থাপন করা হয়েছিল মা মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে । তাদের গবেষণা কাজ শেষ হলেও তাদের স্থাপিত বাশগুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে । বলা বাহুল্য এই বাঁশগুলো ই সময়ের আবর্তে সিল্টেশনের ফলে একসময় হালদার নাব্যতা সংকটের কারন হবে । একই বিভাগের আরেক ছাত্র রবিউল কাউসার হালদার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হালদাতে স্থাপিত রাবার ড্যাম ও বাঁধ গুলো খুলে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ।

সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শাহীন শুভ বিজয় মনে করেন যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যর দিক দিয়ে অদ্বিতীয় এই নদীকে বাঁচাতে হলে দল মত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে এমন দিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলার মানুষ তাদের নিজস্ব একটা নদী আছে বলে দাবি করতে পারবে না । তাই আমাদের সকলের উচিত হালদা রক্ষায় এগিয়ে আসা ।এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নুসরাত ঊর্মি বলেন যে হালদা কে আবার আগের রুপে ফিরে পেতে হলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে যেন কলকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহন না করে সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠান নদীতে ফেলতে না পারে । আর এজন্য প্রশাসনের গুরুত্ব সবার আগে । বানপদ চবি শাখার সভাপতি ফরহাদ হোসেন পরিদর্শন শেষে বলেন যে হালদা ও কর্ণফুলী চট্টগ্রামের আর্শিবাদ । হালদার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ নদীকে যদি আমরা হারিয়ে ফেলি তাহলে এর মত বোকামির আর কিছু হতে পারে না ।

এখন অনেকে বলেন, তরূণ্রা আজ বিপথে গেছে, কিন্তু আমি বলব না এখনো সম্ভবনা জেগে আছে, আমি মনে করি যারা মা, মাটি, মানুষকে ও এদেশের নদীকে ভালবাসতে পারে তারা কখনো বিপথে যেতে পারে না । তাই এখনি সময় তরুন দের মধ্যে দেশ প্রেম জাগ্রত করা ।

 


শেয়ার করুন