দরিয়ানগরের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

mohammad nurul hudaড. মনিরুজ্জামান :

১. দাখিলা বয়ান
কবি নূরুল হুদা দরিয়ানগরের কবি। দরিয়ানগর শুধু কক্সবাজারই নয়, ঈদগাহ-ও। এইখানেই কবির জন্ম (৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯), গ্রামের নাম পূর্ব পোকখালি। ঈদগাহ হাইস্কুল থেকে কুমিল্লা বোর্ডে ম্যাট্রিকে (ম্যাট্রিক পরীক্ষা) তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মেধার পরিচয় রেখেছিলেন। তিনি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র (ইংরেজিতে এম.এ)। ছাত্রজীবনে ‘অধোরেখ’ সংকলনটি সম্পাদনা করে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর বাংলা একাডেমীর পরিচালক কবি নূরুল হুদা জার্মান, জাপান, আমেরিকা, হাওয়াই, লন্ডন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, বেইজিং, শ্রীলংকা, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন এবং তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে সম্মাননাও গ্রহণ করেন। তিনি আর যে সব স্বীকৃতি ও সম্মাননা লাভ করেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৮), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আলাওল পুরস্কার (১৯৮৩), কবি আহসান হাবীব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), তুরস্কের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা লাভ (১৯৯৭), কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), কক্সবাজার মেয়র কর্তৃক নগর চাবি প্রদান (২০০৯) প্রভৃতি। তিনি বহু গ্রন্থ ও কাব্য রচয়িতা, বহু ভাষার ধ্রুপদি সাহিত্যের রূপান্তরসাধক এবং আপন ভাষা ও দেশমাতৃকার অসংকোচ সেবক। তিনি বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁকে দেশ-বিদেশের নানাজন নানাভাবে সম্মাননা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। নাট্যকার মমতাজউদ্দীন বলেন, মুহম্মদ নূরুল হুদা শব্দ শিকারী কোথা থেকে না কোথা থেকে শব্দকে খুঁজে আনে। বাছবিচার করে না। ইলিয়ডে তার আনন্দ, শেক্সপীয়রে তার নেশা, বাল্মীকিতে সে অনুরাগী, হোমারে সে অভিভূত আর কোরানে সে আকণ্ঠ। আর আছে তার সাগর, আছে পাহাড়, আছে ঈদগাহ বিদ্যালয়।’

তাঁর পঞ্চাশে সংবর্ধনাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় সময়মানুষ নামে। সম্পাদকত্রয়ী (বিশ্বজিৎ ঘোষ ও অন্যান্য, ১৯৯৯), গ্রন্থভূমিকায় (‘প্রসঙ্গত’) কবির সাহিত্যসৃষ্টির পরিচয়কে যেভাবে উল্লেখ করেন সেটি উদ্ধৃত করে আমরাও তাঁর সব্যসাচী স্বরূপটি বিশদ করতে চাই– মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কাব্যনাট্য, গান ইত্যাদি। কিন্তু সর্বত্রই তাঁর কাব্যরুচি ও কাব্যিক শাসন যুক্ত হয়ে পড়ে, যার কারণে অনিবার্যভাবেই তার রচনায় তৈরি হয় স্বকীয়তা ও ভাবনার একটি নতুন প্রান্ত। মুহম্মদ নূরুল হুদার সৃষ্টিশীলতায় দ্বৈত সত্তা বিরাজমান। প্রথম সত্তায় আমরা তাঁর কবিতায় হই আকৃষ্ট, হৃদয়াবেগ দিয়ে তা গ্রহণ করি; আর তাঁর কবিতার দ্বিতীয় সত্তায় আমরা লাভ করি বহুমাত্রিক চিন্তা-উদ্রেককর বিচিত্র অনুষঙ্গ, যা পাঠ করতে আমরা হই আচ্ছন্ন ও সম্মোহিত। সৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ কবি’র কবিতা শুধু আকৃষ্ট করে না, আকৃষ্ট স্তর পার হয়ে তা বিশেষ আচ্ছন্নতা বিস্তার করেÑ যেখানে তার রচনায় বহুমাত্রিক জ্যোতিবলয়ের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। মুহম্মদ নূরুল হুদার অধিকাংশ রচনায় আমরা এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি।’

২. মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার বিষয় ও বিষয়ান্তর
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা নির্মাণকলা ও বিষয়বৈচিত্র্যের সমাহারে সৃষ্ট। অর্থাৎ তাঁর কবিতা বুঝতে হলে শুধু বিষয়ের ধারা গ্রহণ করলেই চলবে না, নির্মাণে কলাকুশলতাগুলির পর্যবেক্ষণ আবশ্যক হবে। প্রথমে আমরা তার বিষয়গত সম্পাতে দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করবো, তবে কবিতা কী বিষয়ক, সেটা দেখাও বাংলা কবিতা-পাঠের একটি আবহমানকালের বিশেষ ধারা। যেমন আমরা বলি রোমান্টিক কবিরা প্রেম ও প্রকৃতির বিষয়ে নিমগ্ন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কবি বা বর্ষার কবি ইত্যাদি।

নূরুল হুদা প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছেন দেশের পটভূমিতে। এই পটভূমি খুবই বিস্তৃত। দেশাত্মক কবিতায়ই শুধু নয়, মিথ বা পুরাকীর্তি কবিতা থেকে দর্শন (জীবনানুভূতির দার্শনিক উদ্ভাসসমূহ) ও ঐতিহ্য সন্ধানের ও সম্পূরক অন্যবিধ ভাবনারও সকল পর্যায়েই তা সত্য।
১. নাতাশা সবুজ বাংলা দূর রাশিয়া।
২. দূরে যাচ্ছো, বৃষ্টির প্রপাত থেকে দূরে যাচ্ছো রিমঝিম পায়
বাজিয়ে শঙ্খের চুড়ি, হাওয়ায় এলিয়ে দিয়ে কালো কেশদাম…
৩. হৃদয়কে করো আকাশের নীলে উন্মীলন।
৪. সবুজ চরের মতো প্রনয়িনী আঁচলের কাছে/সম্পর্কিত কে সেই যুবক
৫. এর চেয়ে স্পষ্টতর কোনো পটভূমি নেই,
এর চেয়ে স্পষ্টর কোনো ব্যাকরণ নেই আমার কবিতার।

প্রকৃতি এইভাবে নীল সবুজ রঙে, শব্দে (রিমঝিম বৃষ্টিপাত) ও প্রতিবেশ ও দৃশ্যান্তর প্রপঞ্চে সরব হয় নূরুল হুদার কবিতায়। তাঁর কবিতা যেমন শব্দ-প্রেক্ষিত রচনা করে (‘শুক্লা শকুন্তলা’, ‘তামাটে কিশোর’, জন্মজাতি, উদয় প্রণাম, অস্তপ্রণাম, যুক্তপ্রণাম, পূর্ব পৃথিবী-পশ্চিম পৃথিবী-অশোক পৃথিবী ইত্যাদি), তেমনি রচনা বা সন্ধান করে নানা বাক্যবন্ধন, চিত্রকল্প ও বর্ণনা এবং লোক-ঐতিহ্য ও দেশী-বিদেশী ধ্রুবসাহিত্যের কথন সৌন্দর্যও– তার নাটকীয় (সৃষ্টিশীলতা ও অন্যান্য জন্মজাতি প্রভৃতি) ধরণকে রক্ষা করে বুননে কুশলতা এনে। তিনি কবিতায় গল্প আনেন, গল্পে কবিতাÑ দেয়াল ভেঙে দেয়াল গড়ার অন্যরকম বিমূর্ততার দেহবিলাস যেন।

৩. প্রকৃত ও প্রকৃতির কবি হুদা
নূরুল হুদা কবিতাকে ভাবেন অন্যরূপে। আজকের সময় ও সমাজে যখন কবিতার জনপ্রিয়তা ন্যূনতম পর্যায়ে তখন তাঁর বিশ্বাসের চরে কবিতা সবুজ হয়ে ওঠে। তপন বাগচী কবি নূরুল হুদার কবিতা বিষয়ক ১৩টি আবিষ্কারোপন ধারণার শেষতম মননীকৃত সত্যবোধটি ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁর ভাষায়–
‘১৩. কবিতা এখন একটি জনপ্রিয় সাহিত্য মাধ্যম। দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ভাষারূপ পায় আমাদের কবিতায়। নূরুল হুদা এখানে কবিতা গবেষক। (ড.Flaming Flowers…’) কবিতার ঐতিহ্যকে তিনি অমান্য করেন না এবং একইভাবে কাব্যান্দোলনের ইতি-নেতি উভয় ধারা ও তাদের বৈপরীত্যের গুরুত্বকেও স্বীকার করেন। নূরুল হুদার কবিতা-দর্শনে এই বিষয়কে উদারতার উদাহরণ হিসাবেই গ্রহণ করা যায়। তাঁর সৃষ্টিতে তাই তাৎপর্য পরিবর্তন ও মোড় যেন কোনও অনায়াস সৃষ্ট তা সারলিক বা অজটিল। তিনি এইভাবে একটি উত্থানকে অনায়াস লব্ধ করে নিতে চান।
আজ রাতে তোমার এ মুখ
আমাকে বদলে দেবে, বদলাবে মানুষের বুক।
সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে হয়ত তিনি শামুকবৃত্তি গ্রহণ করতে চান এখানে। রোদ-দুপুরে শামুক যেমন নিজের ভেতরেই আশ্রয় নেয় নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে। ‘ওই জরুরী মুখ’ কবিতার (নির্বাচিত কবিতা) মাঝেই কবিকে আহ্বান জানাতে শুনি–
বেড়ে ওঠো প্রদীপের পাশে হে মুখ, জরুরী মুখ।

কবির কবিতারাশি কবির বিশ্বাস-অবিশ্বাস দুই-ই। উভয়ই প্রবল সেখানে। দ্বন্দ্বে ও মিলনে তার যাত্রা যেমন তাঁর ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ কবিতায় ‘যুগলাঙ্গ যাত্রা’র কথা বলা হয়েছে। এগুলিকে বলা যায় নিবিড় উপলব্ধি, সরকার আমিন একেই বলেছেন ‘ধনাঢ্য অনুভব’। তিনি যথার্থই বলেন, ‘কবিতা প্রকৃত আবেগের ব্যাপার। প্রকৃত ও প্রকৃতি ছাড়া কবিতা হয় না।’ নূরুল হুদা প্রকৃত কবি ও প্রকৃতির কবি– দুই-ই।

৪. হুদা কবিতার শ্রেণীকরণ
নূরুল হুদা কবিতাকে সন্ধান করেছেন দেশের পথে, ঐতিহ্যের পথে ও সৃষ্টিকলায়। তিনি সচেতন এবং সমকালীন। তাই তিনি উপলব্ধি করেন নিজের অঞ্চল ও সেই সাথে লোকাশ্রিত এক প্রতিবেশ তার ঐতিহ্য ও বিবিক্ততাকে নিয়ে। তার সাথে তিনি যুক্ত করেন কোনও প্রান্তহীন প্রান্তকে। তাঁর নাকি তামাটে কিশোর কিংবা মানুষগুলিকে তিনি সন্ধান করেছেন, তবে তা শুধু ইতিহাসের নয়, ভূগোলের। বর্তমান পৃথিবী ইতিহাস-ভূগোলে বিভক্ত। ওই ভূগোল-চিন্তা উত্তরাধুনিক। আগামী প্রজন্মের।

হুদার কবিতা অহংকারযুক্ত এবং অলংকারযুক্ত উভয়ই। তাঁর সৃষ্টিকলার এটাই সৌন্দর্য। কবিতায় যদি স্টাইল বলা যায়, এখানেই তার খাজাঞ্চীর পত্তন কিংবা এক চানকের পদপাত। অনেকের আপত্তি থাকে। বলবেন তিনি দুরূহ, সরলতা তার মেকি, তিনি লোকযোগবাহ নন, ভিতরে আবহে দর্শন পাঠ এবং উত্তরাধুনিক বিস্তারক হয়ত, হয়ত না। এ জন্যই হুদা কবি। তাঁর কবিতা বহু শ্রেণীজ (ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিভাজন), কিংবা সমকেন্দ্রিক সবই (অসীম সাহার মূল্যায়ন)। কবি দুই-ই। কবির বহুমুখিতার উৎস একই। আসলে ঝর্নামুখটি বিচিত্র ধারার।

৫. হুদার ভূগোল নির্মাণের চতুর্থ তাৎপর্য : অন্য বা আত্মরেনেসাঁ
ভূগোলের প্রতিবেশ এমন এক বিশ্ব যা ভৌগোলিক প্রান্তিকতা-শূন্য। যেমন দলিতরা বিচ্ছিন্ন না হয়েও ভূমিকা অস্বীকার না করেও তারা আজ তৃতীয় বিশ্ব, চতুর্থ বিশ্ব বা অন্য কোনও বিমূর্ত বিশ্বের দাবিদার। হুদার কাব্য-উপকরণে এই কারণেই ইতিহাস গড়িয়ে যায়, ভূগোল উঠে আসতে চায় ইতিহাসে। আসলে এখানে দুইপক্ষেরই সীমা অনির্দেশ্য। কবিতা জাগে শেষ পর্যন্ত বিষয়ান্তরে ও নির্মাণ-সঞ্চারণে। সেখানে অনবরতই অস্থিরতা, সন্ধান-চাঞ্চল্য এবং প্রতীকের অব্যাহত সম্পাদন। হয়ত অন্তর্গত এক বৃহত্তর ও উদারতর শিল্পানুভূতিই এখানে তার অনুষঙ্গ ও যোগবাহ।
হুদা-কবিতার যদি অন্য ব্যাখ্যা মেনে নিতে হয় তাহলে তা ৪৭-এর ভূগোলে (মূর্ত স্বদেশ) প্রত্যাবর্তনের ও অনুবাদের কল্পনা। তা আধুনিকমাত্র। অর্থাৎ তা বিগত প্রজন্মের, আগামী প্রজন্মের কীরিট-সত্য নয়। উত্তরাধুনিকের হাত ধরে মিথের পূর্ণ ব্যাখ্যা বাংলা ভাষায় এখনও হয়নি। নক্ষত্র-সত্যসমূহ যে সব মিথে ধৃত হয়ে আছে, কিংবা গ্রীক মিশর-সুরলোকের সিরীয়-এশীরিয়া দ্বন্দ্বের দেশ যার ফলে মহাভারত বর্জিত অসুরদের (হিট্টিদের) ভারতে আশ্রয় গ্রহণ লোকবিশ্বাসসমূহ আভারত যে ধর্মরূপ গ্রহণ করেছে তার বৈজ্ঞানিক লোকতন্ত্রগত বিচার (Folkloristic Science) আমাদের ভাষায় ও সাহিত্যে অদ্যাবধি অনুপস্থিত। হুদার পুরান-পুননির্মাণে সলিমুল্লাহ খান ও তাঁর পূর্বসুরীদের পুথি-চর্চা বা পুনঃনির্মাণের ছায়াপাত ঘটেছে, পূর্বতন রূপে বা উৎসে ফেরা তাঁর কাছে কষাঘাতের হাতিয়ার ব্যবহারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। নূরুল হুদা সেইরূপ সমাজ সচেতন অথবা সাম্যবাদী ধারারও কবি নন। তিনি মানববাদী। এই সাধারণ মানববাদ কী অর্থ বহন করে? আগামী প্রজন্ম কী তাৎপর্য গ্রহণ করবে এই ‘সমাজবাদ’ থেকে? একে ‘মায়াবাদ’ বললেই বা কী? এই প্রশ্নে এখানে হুদার প্রকৃত উদ্ধার আবশ্যক হলে বলবো–
‘আমাকে জাগালে যদি কেন বাজালে না’
একথা বা এই সূফীদর্শন ‘এই জরুরি মুখ’-এর কবির হতে পারে না। উত্তরাধুনিক কোনও কবি প্রতীক্ষাপীড়িত দর্শনের মুখাপেক্ষী নয়। নূরুল হুদার উত্থান ও জাগরণ স্বতোঃপেক্ষী।

৬. হুদার দরিয়া বন্দনা, জাতিসত্তার ক্রন্দনে ও স্বপ্নে
‘কক্স সাহেবের বাজার এখন দরিয়ানগর/ এই নগরত হাইস্কুল বাঁচি হাজার বছর– মুহম্মদ নূরুল হুদা
দরিয়া-নন্দন নূরুল হুদা নতুন শতাব্দীতে এসে মাতৃবন্দনা করেন ‘দরিয়ানগর কাব্য লিখে। সমুদ্র পার্শ্ববর্তী স্থলভূমিতে বসে নীল দরিয়ার ডাক তাঁকে আকুল করেছে। তার সাথে মিশে আছে ঐতিহ্য এবং শিকড়ের ইতঃস্তত সন্ধানী যাত্রা। নূরুল হুদার শিকড় ৮০-র দশকেও উন্মাতাল এবং শনাক্ত হয়ে উঠেছিল–
এতো রাতে কে কড়া নাড়ে, কে?
প্রশ্নের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছিল তাঁর সত্তার পরিচয় (‘অন্তত এইভাবে তুমি জেনে নাও/ আমার মা কিষাণী/ অন্তত এইভাবে আমাকে জানতে দাও / আমি আর অনাবাদী নই।’) কিংবা ঘোষণা দিয়েছিল সত্তার অহংকার ও সম্ভাবনাকে। গ্ন্থটির নাম ‘আমরা তামাটে জাতি’ (১৯৮১), যার পূর্ব প্রকাশ ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ (১৯৭৫)। মাঝখানে আরও ছিল ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’ (১৯৮০), যে কাব্যে একটি ভবিষ্যৎবাণীও ছিল, যেহেতু কবিরাই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তিনিও লিখেছিলেন কাব্যের সূচনামূলক নাম কবিতাটিতেই–
‘দূরে আছি? ভয় নেই, কেঁপো না মৃন্ময়ী।’
… … …
আসন্ন বিজয় লিপি তোমাকে পাঠাবো আমি তাদের মুখেই।
অদ্ভুত সব প্রাবন্ধিক চিন্তা ও বিশ্বাসের মূল (মোমিনের সত্তা) থেকে গভীর দৃষ্টিতে আঁকা কিছু চিত্র ছিল এই কবিতায়, তাহা ভরাট সংখ্যাচিহ্নে পর্বান্বিত ও ধাপ বহুলতায় নির্মিত কাব্যটিতে।

… এমনকি আঠারো বছরের একজন মেধাবী কবির নৌকাকেও
অনাবশ্যক টালমাটাল দেখেছি,
এবং ক্ষোভ–
কেন দেখি,
মনুষ্য-অস্তিত্ব যাকে বংশবীজ জেকেছে একদা
তারই নাম হত্যাতন্ত্র– শোণিত অক্ষরে?

কবিরা প্রেমিক, বিপরীত গমন তার ধর্ম নয়, আবারও প্রমাণ হলো তা কবি হুদার জাতিসত্তামূলক অরন্তুদ কবিতা ধারায়। দরিয়ানগর কাব্যে’র কবিও প্রেমী এবং দ্রষ্টা, যেন অন্য আদিকবি, নাকি বাল্মিকী– যিনি দুষ্মন্ত-শকুন্তলাকে ব্যবধানের মহিমায় সৃষ্টি করেন এবং পুনঃ ‘বড় প্রেম’ (যেমন শরৎচন্দ্রে পাই) দিয়ে দূরে নিয়ে যান। হুদা প্রায় একই রভসে একই প্রতিক্রিয়ায় ঐতিহ্যকে প্রসারিত করেন প্রাচীন কবিদের স্মরণ যজ্ঞের মধ্য দিয়ে– আবর্তমান সাগরের জোয়ারের আবর্তের মাঝে; নতুন সৃজনী অভিঘাতে।
কক্সবাজার তথা দরিয়ানগর এর কাব্য ইতিহাস পুনর্পাঠের অত্যন্ত তাৎপর্যবহ কবিতাটি তাই উদ্ধৃত করছি :
আপাতত ক্ষান্ত দিলাম এই দরিয়ানামা
মধ্যযুগে লেখেন যিনি কাব্য ‘জঙ্গনামা’
তাঁকে হাজার সালাম।
তাঁকে হাজার সালাম নামটি নিলাম নসরুল্লাহ খাঁ
সতেরো শতকে মনসুর লেখেন ‘শিরনামা’,
তিনি রামুবাসী।
তিনি রামুবাসী, আবদুল-আলী চকরিয়া বাস,
আলেম শায়ের মনদরদী বান্দা আল্লাহর খাস,
সঙ্গে মজিবুল্লাহ।
সঙ্গে মজিবুল্লাহ, মৌলানা, আমির মোহাম্মদ,
নতুনচন্দ্র, মজহারুল হক, ভনে সবাই পদ
শেষেতে সিদ্দিকী।
শেষেতে সিদ্দিকী কবি আবদুর রশীদ নাম
বিশ শতকের প্রথমার্ধে কাঁকারা মোকাম,
আরো কতো জ্ঞানী।
আরো কতো জ্ঞানী কতো গুণী নকশীকাঁথার তলে
বানাইয়া ভাসাইল পদ মৈনপাহাড়র ঢলে
তার নাই ইয়ত্তা।
তার নাই ইয়ত্তা কাব্যকথা দইজ্জার রূপচাঁদা
ছুরিশুটকি সারি সারি দড়িত যেন বাঁধা
দেখে নতুন কবি।
দেখে নতুন কবি নতুন ভাষা নতুন ভালোবাসা
হাইল্লাছাড়ি হঁওলাগীতি শুনতে আবার আশা
তুমি কলম ধরে।
তুমি কলম ধরে মউজে চড়ো পড়ো কাব্য খাঁটি
কালি তোমার দইজ্জার পানি, কাগজ তোমার মাটি,
আহা কাব্যগীতি।
আহা কাব্যগীতি নাব্যস্মৃতি আপাতত রোধ,
দরিয়ানগর কাব্য হয় না তামাম শোধ
কবির কলম চালু
সুতরাং মধ্যযুগ থেকে স্তর পরম্পরায় কক্সবাজারের স্থানিক ইতিহাস সন্ধান করলে কথিত অন্ধকার সহজেই তিরোহিত হয়। আশা করব ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকার নয়, সন্ধান করবেন আলো, আরো আলো….।

৭.
পূর্বকাব্যেও এসব বিষয়ের সাক্ষ্য পাই–
মারণাস্ত্র সম্পর্কে চেনে না।
সূর, মৃত্যুতো আমার অস্ত্র– এক মাত্র আমার–
আমার অস্তিত্বে তার শক্তি-সাধ অমত্ত-অপার।
নূরুল হুদার প্রেম দ্রাবিড় সত্তাকে মৃন্ময়ী করে, যার কীর্তি প্রশ্নাতীত–
ত্রিকালই ধ্যানী তুমি জন্মমৃত্যু হতবাক তোমার অতীত
তার প্রতি বিশ্বাসও তেমনি–
নৈরাজ্য আঁধার এলে এমন কি পশুপাখি তোমাকে দেখে না
গুপ্তচর কোনদিকে কোনোদিন তোমাকে তো পালাতে দেখিনি
নিশীথে প্রদীপ জ্বেলে তোমাকেই খুঁজি শুধু একা
মহিয়সী, সুদিনে কখনো তবু নক্ষত্রের হদিস মিলে না?
বিশ্বাসের ও এবং সংরাগের বাস্তভিটায় তাই অনবরত সন্ধান, অনবরত প্রত্যাশা–
দেশবাসী উদগ্রীব আজো যুদ্ধোত্তর তোমার স্বদেশ
সাতটি রশ্মির মতো তুমি কি ফিরবে তবে কাল সুপ্রভাতে
সেই দ্রাবিড়ভূমির আততায়ীরা যারা ‘জানে না যে এদেশ জলের/তাদের বিষাক্ত অস্থি জমে আছে স্তরে স্তরে পলির আড়ালে/ তোমার অপাপ রক্তে তার পাপস্পর্শ আছে/’ তাই কবি জানিয়ে রাখেন:

আমি তো রক্তের সাক্ষী যে রক্তে খুলে যায় হরিৎ তোরণ
আমি তো রক্তের সাক্ষী, যে রক্তে ফিরে আসে হারানো স্বজন
রক্ত নয় কোনো দ্বিধা, রক্ত এক অবিমিশ্র জীবন শপথ
কবি বলেন,
তোমার দ্রাবিড় রক্তে অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শ লেগে নেই
তারই পরিনাম–
তোমার বিশাল স্বপ্ন জ্বলে উঠি পরিব্যাপ্ত সবুজে শ্যামলে
আলোর পর্দার কনিষ্ঠ
এবং তার সাথে যুক্ত হয় কবির নিজস্ব স্বপ্ন–
বিশাল তিমির মতো একটি নতুন দ্বীপ্তি
আজ রাতে জাগবে সাগরে,
ক্রমে ক্রমে বাড়বে ভূভাগ
শ্যামল বৃক্ষের সারি, পাখিডাকা বন আর
দৃপ্ত জনপদ
দেশকে এত গভীরভাবে আর কে জেনেছে এমন আশাবাদের আসরে?

৮. কবির প্রান্তহীন প্রান্ত : শেষ নাহি যার শেষ কব তার কেমনে
কবির কাব্যসংখ্যা ২০১৩ পর্যন্ত তিনটি ইংরেজি অনুবাদকাব্যসহ প্রায় পঞ্চাশোর্ধ, তদাতিরিক্তি রয়েছে তাঁর ছড়া ও শিশুতোষ কাব্য এবং ১৬টি কাব্য ও ছড়াগ্রন্থের সংকলন ‘শিশু-কিশোর সমগ্র’। কবির নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ ভ্রমণ ডাইরি আছে বহু, যেমন রয়েছে ইংরেজি গ্রন্থ ও বাংলায় অনুবাদ গ্রন্থও। সম্পাদিত গ্রন্থও রয়েছে বহুতর। এবং সকলই অনন্য।

সময়মানুষ, স্বতন্ত্র এবং মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি ও কাব্যকোবিদ প্রভৃতি সমকালীন ও সম্পাদনা গ্রন্থে তাঁর গ্রন্থাদি নিয়ে ও সামগ্রিকভাবে নানা আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও বের হয়েছে একাধিক। এসব আলোচনায় তাঁর মূল্যায়ন ঘটেছে মিশ্র-অবিমিশ্র উভয়রীতিতেই। বন্ধুদের কাছে তিনি প্রিয় কবি, বড় কবি, সৎ কবি এবং ‘মহাকবি’ও; আবার বন্ধুদের মূল্যায়নেই তিনি আলংকারিক, তিনি গদ্য, শিকড়ঘেঁষা বলে তিনি দক্ষিণী, প্রথম দিকের কাব্যে তিনি ‘দুরূহ’, তিনি আত্মবাদী (‘আত্মবাদ হচ্ছে নিজেকে না জানার, নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখারই শিল্পসর্বস্ব কসরৎ’– বশীর আল-হেলাল), বা ‘একই কেন্দ্রবিন্দুতে বারবার ঘুরে ফিরে আসার প্রবণতার প্রাধান্য’ আছে তার কাব্যে, আছে স্ববিরোধিতা এবং ‘অপ্রয়োজনীয় অলংকৃতি তাঁর কবিতার উজ্জ্বলতম সম্ভাবনাকে পূর্বাপর খণ্ডিত করেছে’ (অসীম সাহা) ইত্যাদি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর কবিতার যুগ ও পর্যায় বিভাজন উল্লেখ করেছেন, মোটামুটি আত্ম আবিষ্কারের তাগিদ ও যুগযুগান্তর অনুষঙ্গ নির্ণয় প্রয়াস। দ্বিতীয়ত বঙ্গজ জীবন ও সংস্কৃতির সাহিত্যিক উপাদানগুলির পুনঃস্থাপন ও মিথের পুননির্মাণ প্রয়াস এবং এই পর্যায়ে তিনি স্থির লক্ষ্যও সার্থক; তবে যিসাস মুজিব প্রভৃতি সৃষ্টির তৃতীয় অবস্থাটিতে কবির উত্তরণ, সেখানে ‘থীম ও বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য ও সমান্তরাল উন্মোচনে’ কবির নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত।

শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি-তে কবির অভিযাত্রা ‘দ্রাবিড় সভ্যতার দিকে’ এবং ‘এই অভিযাত্রা হুদাকে একটা আলাদা চেহারা দান করেছে’– এই উক্তি দ্বারা অসীম সাহা জানিয়েছেন (হুদার) বহুবর্ণে সজ্জিত শব্দের প্রতিমাকে’ যেখানে ‘পাঠককে আঙ্গিকের একঘেঁয়েমি ভুলে (ও) হুদার অন্তর্গত সঙ্গীতকে কান পেতে শুনতে হয়।’ নরেন বিশ্বাস যাকে বলেছেন ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’। তবে সৈকত আসগর যাই বলুন, আহমদ রফিক মাটি-সংলগ্ন শিকড়ঘেঁষা সামাজিক (হুদার) লেখকচৈতন্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য’ বলে স্বীকার করেন। তিনি ধরিয়ে দেন ঐতিহাসিক সত্য যা হুদাকাব্যে ভ্রান্তি রচনা করেছে, সেটি হলো ‘এদেশের জাতিসত্তার আদি মানব-মানবী নগরসভ্যতার জনক দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর নয়, বরং অষ্ট্রিকভাষী কৃষিজীবী কৃষ্ণকায় জনগোষ্ঠী (সময়মানুষ, পৃ. ২৪) কবিতার তথ্যমূল্য অধিক হলে কালিদাস ভূমিস্যাৎ হয়ে যান তাৎক্ষণিক পাঠেই। নূরুল হুদা তাঁর শকুন্তলাকে (নাট্যিক অবয়বকে)- করেছেন সার্থক সংকট ‘শুক্লা’। কালিদাসের দীপ্তিময় উক্তি বা সংলাপের নতুন ভাষ্য সৃষ্টি হয়েছে এখানে, যেমন হয়েছে বহু কবিজনের (রবীন্দ্রনাথসহ) পুরাতনের নতুন নির্মাণগুলিতে। (অবশ্য সনেটগুচ্ছ আকারে আর নেই; আলাউদ্দিন আল আজাদের পরীক্ষাও সামান্য তুলনীয়। শেষোক্তজনের সাথে অতীতের স্মরণ আছে, একক থীমে তা উদ্ভাসিত নয়।) শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি, অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী এবং আমরা তামাটে জাতিতে কবির অনিঃশেষ উক্তি ও কাজকর্মগুলি ১৯৮৪ পর্যন্ত তাঁকে ধাবমান বেগমান ও গতিমান করে রেখেছিল বলে ঐতিহ্যের পুনঃপুন সম্ভাবনা ও পুনঃনির্মাণ, অন্য অর্থে অখণ্ডিত রেনেসাঁর উদ্ভবে তিনি তখন উন্মাতাল। কবি তখন পর্যন্ত শুধুই কবি, সব্যসাচীর হাত প্রসারিত হয়নি একশত। কবি নূরুল হুদা নিজের কাছেও নিঃসঙ্গবাহু। এবং অস্বীকৃত, অপুরস্কৃত, হয়ত অগৃহীতও। শুক্লা শকুন্তলা তাঁকে পুরস্কার এনে দেয় (আলাওল পুরস্কার ১৯৯৩)। এবার তিনি স্বীকৃত স্বারসতজন। দুবাহু মেলে উড়বেন এরপরে। পরবর্তী কাব্য তাঁর নানা গ্রন্থ রচনার অভিজ্ঞতা ও প্রবীনজনের মনস্তত্বসম্ভূত। সেখানে তখন তিনি বাইরের জাতকেও স্বীকার করবেন। তখন আসবে তাঁর গদ্যের যুগও। এবং গদ্যে-পদ্যে নির্মাণেরও পালা।

একটা উপসংহার তার আগে রচিত হওয়া জরুরি। নূরুল হুদার কীভাবে উচ্চায়ন উর্ধায়ন শিরোরহন বা শীর্ষায়ন ঘটলো? ঐতিহ্যের সন্ধানে ও পুনঃস্থাপনে, না সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসারণে? প্রবাদে পাই Who followed tradition is a worst citizen, he who creates or extends tradition is the first class citizen’ নূরুল হুদার অবস্থান কোথায়? উপর্যুক্ত সমালোচনাগুলিতেই তার ইঙ্গিত আছে। সাহিত্যের সর্বশাখার বিচরণের শক্তি তার আছে, নূরুল হুদা সব্যসাচী, এসবই ঠিক, আমার মূল্যায়ণ এতদূর পৌঁছাবে না, সীমিত পৃষ্ঠায় সে চিন্তাও নিরর্থক; কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে কবির কায়াবাদী আলোচনা করা গেলেও আচরণবাদী আলোচনা আদপেই দুরূহ, অসম্ভব না হলেও তা অসমাপক বার্তাসুলভ হতে বাধ্য। কায়ারও থাকে ‘পঞ্চডাক’ নানা উপশাখা– কবি হুদারও আছে অর্ধংশতাধিক কাব্য ও তার স্বরূপ বা উপশ্রেণী। যেমন তাঁর অধ্যাত্মকবিতা, লোকানুগত কবিতা (লোককবিতার ধারায় আধুনিক সৃষ্টি), ইত্যাদি এবং তারও নানাধারা; এছাড়া কবিতামাত্রেই তো প্রেমার্চনা–
‘আমাকে জাগালে যদি কেন বাজালে না?’

এই অন্তক্রন্দন, ভেতরের শোক (বা শোকানল) নিয়ে কি তার বিচার-বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ হতো?
কিন্তু নূরুল হুদা নিজেই নিজের অন্তরায়,– তাঁর সমালোচকগণ নন।


শেয়ার করুন