মুহাম্মদ শামসুল হক শারেক:
টেকনাফের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো আলোচনার ঝড় তুললেন এমপি অব্দুর রহমান বদি। এমপি বদির ইশারায় টেকনাফে নজির বিহীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলেই মনে করেন সবাই। যদিও দলের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। বিদ্রোহ করে যারা জিতেছেন তারাও নৌকা প্রতীকের সমর্থক, এমপি বদির সমর্থক। পর্যবেক্ষকদের মতে এটি এমপি বদির রাজনৈতিক দূর দর্শিতা এবং উখিয়া-টেকনাফে তাঁর জন সম্পৃক্ততার প্রমাণ।
আগের দিনে রাজা-বাদশা, জোতদার-জমিদাররা নানাভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতো যুগের পর যুগ। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই ক্ষমতা ভোগ করে আসতো। আর সেই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হতো। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জায়েজও মনে করা হতো ওসব কিছু। আধুনিক বিশে^ ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা ভোগ করার সেই পুরানো পদ্ধতি সেকেলে, অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ বিবেচিত হয়েছে। কারণ সেখানে সাধারণ জনগণের পছন্দ অপছন্দের কোন তোয়াক্কা করা হয়না। নেতা নির্বাচনে তাদের মতামতের প্রতিফলন হয়না। তাই নির্বাচিত নেতাদের প্রতি তাদের আস্তা এবং ভালবাসা থাকে না। সেখানে জনগণের প্রতিও নেতাদের কোন দরদ বা দায়বদ্ধতা থাকেনা। তখন সমাজে হিং¯্রতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব বিবেচনায় অধুনিক বিশে^ নেতা নির্বাচনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনকেই সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ধারা বলে এ পর্যন্ত স্থিত।
আমাদের দেশেও গনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন হয়ে থাকে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকার ঘোষিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী গতকাল ২২ মার্চ ইউনিয়ন পরিষদে হয়েছে ভোট গ্রহণ হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে সারা দেশের কথা আমি বলব না। সংবাদকর্মী হিসেবে বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধে টেকনাফ গিয়েছিলাম নির্বাচন পর্যবেক্ষণে। সেই সুবাদে দেখা হবে আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে। বাল্যকালে টেকনাফ হাই স্কুলে পড়া-লেখা ও পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত-তাবলীগের কারণে পরিচিতি ছিল টেকনাফের সর্ব মহলে। কর্মব্যস্ততায় যাওয়া আসা কম হয় সেখানে। ভাবলাম নির্বাচনের সুযোগে সেখানে দেখা হবে সেই ৩৫ বছর আগের বন্ধুদের। সিনিয়র কাউকে না পেয়ে অনুজ জুনিয়ার কিছু সংবাদ কর্মীদের সহযাত্রী হয়েছিলাম আমিও।
আগের দিন (২১ মার্চ) নির্বাচন কমিশনের পাশ সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। সাংবাদিকের স্টিকার লাগানো একটি গাড়িতে ঘুরছিলাম সংবাদ কর্মীদের সাথে। টেকনাফ সদর, সাবরাং, সেন্টমার্টিন ও বাহারছরা ইউপিতে নির্বাচন থাকলেও সদর ও সাবরাং এর ভোট কেন্দ্র গুলোতে আমরা ভোট কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করি। অতীতে অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু গত ২২ মার্চ টেকনাফ সদরের নির্বাচনে বেশ কিছু ব্যতিক্রম বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি। ভোটারদের মাঝে ছিল স্বতর্স্ফুততা, উৎসব মূখর পরিবেশে ভোট দান, ভোট কেন্দ্রে মহিলাদের ব্যাপক উপস্থিতি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জিরো টলারেন্স ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। আমাদের নজর ছিল কোন কেন্দ্রে অনিয়ম হচ্ছে কিনা, ব্যালট ছিনতাই, কোন প্রতীকে নিয়ম বর্হিভূতভাবে সিল মারা হচ্ছে কিনা ওদিকে। কিন্তু না, দেখা গেছে, কোন কেন্দ্রে এসব কিছু হয়নি। বরং কোন অভিযোগের সাথে সাথে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও র্যাব, বিজিবি এবং স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা মুহুর্ত দেরী না করে সেখানে উপস্থিত হয়ে ভূমিকা রেখেছেন। কোন কোন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার যে উদ্ভব হয়নি তা নয়। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ভূমিকায় তা সফল হয়নি। এতে করে আশ^স্থ হয়েছেন ভোটাররা। বিজয় হয়েছে গনতন্ত্রের।
ভোট কেন্দ্র গুলোতে পরিচিত অপরিচিত ভোটারদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, তারা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, এতে যেই নির্বাচিত হউক তাদের আপত্তি নেই। যার সাথেই কথা বলেছি প্রায় সকলেরই একই কথা এমপি (বদি) সাহেব না চাইলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।
বড় হাবিব পাড়া ভোট কেন্দ্রে দেখা হয়েছে বিএনপি নেতা আব্দুল্লার সাথে। তাঁর ছোট ভাই জিয়াউর রহমান টেকনাফ সদরে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলো। কিছু অনিয়ম হতে পারে এরকম আশঙ্কা করলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার তিনি প্রশংসা করেন। নির্বাচনে এমপি বদির কি ভূমিকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি বদি এই নির্বাচন নিরপেক্ষ হউক সেটা চাইবেন বলেই তার ধারণা।
দুপুর ১২টার দিকে সাবরাং উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা হয় ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি নেতা সোলতান (মেম্বার) এর। তিনি ভোটার ও মিডিয়া কর্মীদের সামনে ঘোষণা করেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট দানে কোন সমস্যা নেই। কোন অনিয়ম নেই। এভাবে নির্বাচন শেষে ফলাফল যাই হয় তা মেনে নেবেন বলেও ঘোষণা দেন তিনি। সেখানে আরো দেখা হয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিদ্রোহী প্রার্থী নুর হোসেনের শ^শুর শফিক মিয়ার সাথে। তিনিও স্বীকার করলেন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা।
দুপুরে টেকনাফ ষ্টেশনে দেখা হয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নুরুল আলমের বড় ভাই টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক টেকনাফ পৌর কাউন্সিলার নূরুল বশরের সাথে। তিনি বলেন, যারা নির্বাচন করছেন তারা সবাই তো এমপি বদির লোক। তিনি যাকে চান সেই নির্বাচিত হবে।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে টেকনাফ ষ্টেশনে দেখা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমের সাথে। তিনিও স্বীকার করেন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা। বাদ আছর টেকনাফ বড় মাদরাসার ক্যাম্পাসে দেখা হয় টেকনাফ পৌরসভা মেয়র হাজী মুহাম্মদ ইসলামের সাথে। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা চাই (এমপি বদিসহ) সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হউক।
এর আগে দুপুরে টেকনাফ ষ্টেশনে দেখা হয় জেলা অওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (সাবেক চেয়ারম্যান) মুজিবুর রহমানরে সাথে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে, তবে নৌকার প্রার্থী জিতবে কিনা নিশ্চিত নয়।
দুপুরের দিকে পল্লান পাড়া কেন্দ্রে একটি পক্ষ দলীয় প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে দেখা গেছে, ধানের শীষ প্রতীকের জিয়াউর রহমান ও আ লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী শাহজাহান মিয়া দু’জনেই এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ওখানেও দেখা গেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর রেপিড এ্যাকশন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকার, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিতে প্রার্থী মনোনয়নে অনেক তোড়জোর হয়েছে। দলীয় হাই কমান্ডের একক প্রার্থী দেয়ার নির্দেশিকা থাকলেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে অনেক জায়গায়। এ সুযোগে অনেক জায়গায় একক প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও দলীয় নিদের্শনার বাইরে গিয়ে বিদ্রোহ করে প্রার্থী হয়েছেন অনেক অওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতা। এমনকি একই ইউনিয়নে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীও দেখা গেছে। ২২ মার্চের নির্বাচনে টেকনাফের চার ইউনিয়নের তিনটিতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রেহীরা বিজয়ী হয়েছে। টেকনাফ সদরে শাহজাহান মিয়া, সাবরাং এ নূর হোসেন ও সেন্টমার্টিনে নুর আহমদ নির্বাচিত হয়েছেন নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে।
জানাগেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরষ্পর মত পার্থক্যের কারণে টেকনাফ সদর, সাবরাং, সেন্টমার্টিনে ও বাহারছরা ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচন করেছেন জিতেছেন। আরো জানাগেছে, দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে নাকি (স্থানীয়) এমপি বদির মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। এজন্যই নাকি এমপি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। জানাগেছে, দলীয় প্রতীকে যারা নির্বাচন করেছেন তাদেরকে অর্থ এবং বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতাও করেছেন তিনি। কিন্তু এমপি বদি ভোটের দিন কেটে-ছিড়ে, কেন্দ্র দখল করে প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ভোট নিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেননি। এই নির্বাচনে অন্তত এমপি বদি নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন না করার প্রশংসনীয় নজির দেখালেন। এতে অবশ্যই ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। তবে এমপি বদির এই ভূমিকায় জিতেছে গনতন্ত্র, বেড়েছে এমপি বদির ইমেজ ও প্রভাব।
হ্যাঁ, রাত ৮/৯টার দিকে সাবরাং এ আইন গুলা-গুলিতে ২জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি অবশ্যই দুঃখজক। হুসাইনিয়া এবতেদায়ী মাদরাসা কেন্দ্রে ২জন মেম্বার প্রাথীর সমর্থকদের বিরোধকে কেন্দ্র প্রিসাইডং অফিসার ফলাফল ঘোষণা করতে দেরী করে। এই ঘটনার সূত্র ধরে পুশি-জনতা সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় (কারো মতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে, আবার কারো মতে বিবাধমান গ্রুপের গুলিতে) ২জন প্রাণ হানির ঘটনা ঘটে।
আমাদের সরকার, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও মাননীয় সংসদ সদস্যরা সারা দেশে যদি এই নজির স্থাপন করতে পারেন, তা হলে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সুষ্ঠু, সুন্দর-নিরপেক্ষ ও সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা অসম্ভব নয় বলেই দেশবাসী মনে করে। আগামীতে সকল নির্বাচন গুলো এভাবেই হউক এটাই কাম্য।
টেকনাফে নির্বাচন নিয়ে ফের আলোচনায় এমপি বদি
শেয়ার করুন