টানা বৃষ্টিতে দূর্ভোগের শিকার রোহিঙ্গা, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

মিয়ানমারের সহিংসতার ঘটনায় জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ৫ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়। এ দুই উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অনেক বেশি। আবহাওয়ার বৈরিতায় টানা বৃষ্টিতে নাকাল রোহিঙ্গারা। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
গত শনিবার থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও ত্রাণসহায়তাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। এতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে কিন্তু দুঃখ-দুর্দশা কমেনি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের। তবে সেনাবাহিনীর তৎপরতায় খুশি স্থানীয় ও আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটে আসছে দেশি-বিদেশিরা। মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসছে অসংখ্য দাতা সংস্থা। সড়কে ত্রাণের গাড়িবহর। অনেকে আবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে দূরদূরান্ত থেকে আসছে। এরই মধ্যে শুধুমাত্র দেখতে আসা দর্শণার্থীদের আটকে দিচ্ছে সেনাসদস্যরা।
লাখ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করা গেলেও এখনও শৌচাগার (ল্যাট্রিন) ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতি ৮৬০ জনের বিপরীতে মাত্র একটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত এক মাস ধরে যত্রতত্র পায়খানা-প্রস্রাবের ফলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে উখিয়ার কয়েকটি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারাও।
এদিকে রোহিঙ্গা আসাকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি, স্কুল-কলেজে পড়ালেখায় বিঘ্ন, পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আবার রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নেমেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। ভিক্ষাবৃত্তি করা এসব রোগাগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে নানা রোগ জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত মোট চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।তবে স্হানীয়দের দাবী মিয়ানমান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখের কাছাকাছি বলে তাদের দাবী।তিনি আরো জানান রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সরকারি এবং বিভিন্ন এনজিও কর্তৃক ১২শ ল্যাট্রিন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে ৫শ মতো। আনুপাতিক হারে ৮৬০ জনের জন্য মাত্র একটি শৌচাগার, যা কখনই পর্যাপ্ত নয়।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে গিয়ে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে ধানখেতসহ আশপাশের খোলা স্থানগুলোতে মলমূত্র ত্যাগ করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। বাদ যাচ্ছে না নারী-পুরুষও। যে মাঠে খেলাধুলা করছে সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করছে অসচেতন এসব রোহিঙ্গারা।
শৌচাগার যা বসানো হয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে দ্বিতীয়বার ব্যবহারেও উৎসাহ হারাচ্ছে অনেকে। অস্থায়ী এসব শৌচাগারের সামনে মেয়েদের লাইন দেখা গেলেও পুরুষদের তেমন লক্ষ্য করা যায়নি।
জানতে চাইলে কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থান নেওয়া রশিদা বেগম বলেন, টয়লেটে সব সময় ভিড় লেগে থাকে। তাই বাধ্য হয়ে বাচ্চাদের খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করাতে হয়।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই লাখের বেশি শিশু। যা এবার আসা মোট শরণার্থীর ৬০ শতাংশ। এছাড়া বাবা-মা বিচ্ছিন্ন হয়েছেন ১৩০০ শিশু।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত চিকিৎসকরা জানান, শতকরা ৮৫ ভাগই শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, সর্দি, নিউমোনিয়াসহ চর্মরোগে আক্রান্তের হার বেশি। পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বেসরকারি সংস্থা ‘অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার’ এর হিসাব অনুযায়ী, ৫৫ হাজার শিশু অপুষ্টিতে এবং ছয় হাজার ৭৭৫ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। গর্ভবর্তী নারীরাও ভুগছেন অপুষ্টিতে। তাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা জরুরি বলেও জানায় সংস্থাটি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশি উভয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা রোহিঙ্গাদের স্যানিটেশন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, লাখ লাখ অতিরিক্ত মানুষ যখন ঢুকে পড়ে তখন সেখানকার স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখা কঠিন। এসব রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও পুর্নবাসনে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে আসছে বলে তিনি জানান।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা অধিকাংশ শিশু সর্দি, জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, চর্মসহ নানা রোগে আক্রান্ত। তাই জরুরি ভিত্তিতে এসব শিশুদের হাম, পোলিও টিকা দেওয়া হয়েছে।


শেয়ার করুন