আন্তর্জাতিক বন দিবস আজ

ঝিলংজার রক্ষিত বনের ৭০০ একরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র করার প্রস্তাব

কালেরকণ্ঠ

► আপত্তি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের
► বনের জমি জবরদখল ২৬৯০২২ একর

কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌজার রক্ষিত বনের ৭০০ একর জায়গার ওপর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং কর্মকর্তাদের থাকার জন্য নিজস্ব একটি ভবন নির্মাণ করতে চায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যাঁরা নতুন প্রবেশ করেন, তাঁদের থাকা এবং প্রশিক্ষণের জন্য ৭০০ একর জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেওয়ার আবেদন করেছে বিএএসএ। কক্সবাজারের সাগরপারে কলাতলী শুকনাছড়িতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমীক্ষার কাজও শুরু হয়েছে। তবে রক্ষিত বনের ভেতর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। বন বিভাগ বলছে, রক্ষিত বনের ভেতরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিলে একদিকে বনভূমি আরো সংকুচিত হবে, অন্যদিকে ওই এলাকার বন, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীও রক্ষিত বনের ভেতরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রক্ষিত বনের ভেতর কিছুতেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। বনের জমিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে দুই পক্ষ এখন মুখোমুখি অবস্থানে। প্রতিনিয়ত বনের জমি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজেদের নামে বন্দোবস্ত করে নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। এবারের বন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বন ও জীববৈচিত্র্য মূল্যবান অতি; হারালে অপূরণীয় ক্ষতি’।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইনস্টিটিউটের আদলে কক্সবাজারে বিশাল এলাকাজুড়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একাডেমি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে এসেছেন। এখন চলছে সমীক্ষার কাজ। আগামী এক বছরের মধ্যে সমীক্ষার কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যেই প্রকল্প তৈরির কাজও শেষ হয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে ভবন নির্মাণের কাজ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যে জায়গার ওপর পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একাডেমি ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি অকৃষি খাসজমি। এটি সরকারেরই জমি। সরকার চাইলে তার যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে জমি দিতে পারে।
জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, কক্সবাজারে একাডেমি কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সমীক্ষার কাজ চলছে। সেই সমীক্ষায় পরিবেশগত দিকও উঠে আসবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করলে ইতিবাচক হবে, নাকি নেতিবাচক হবে, তা সমীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বোঝা যাবে। তবে বন তো মানুষেরই জন্য। মানুষেরই প্রয়োজনে। একসময় তো পুরো বাংলাদেশেই বন ছিল। মানুষের প্রয়োজনেই তো বনের জমি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ১৯৯৯ সালে বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে ঝিলংজা ইউনিয়নকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। কোনো এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলে সেখানে প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন হতে পারে এমন কাজও নিষিদ্ধ। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারদের জন্য যদি ভবন নির্মাণ করা হয়, তাহলে রক্ষিত বন, বন্য প্রাণী, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। তাই প্রস্তাবিত ৭০০ একর বনভূমি দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনকে (বিএএসএ) বন্দোবস্ত না দেওয়ার সুপারিশ করেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তৈরি করা একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৩৫ সালের ১৩ জুলাই কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌজার দুই হাজার ১৪৫ একর জমিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। রক্ষিত এলাকাটি এখন বন বিভাগের আওতায় রয়েছে। ওই দুই হাজার ১৪৫ একর জমির মধ্যে ৭০০ একর জমিতে প্রশাসন ক্যাডার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে পাহাড়ের উচ্চতা ২০ থেকে ২০০ ফুট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সেখানে বনায়ন করা হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা চার শর মতো। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে বনায়ন ধ্বংস হবে। উপকারভোগীদেরও সমস্যা হবে। বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, রক্ষিত বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর, কড়ই, বাটনা, বহেড়াসহ বিন্নি প্রজাতির গাছ রয়েছে। ৭০০ একর জমি যদি দীর্ঘ মেয়াদে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, তাহলে এসব গাছ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া রক্ষিত বনে হাতি, বানর, বন্য শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও পাখির আবাসস্থল রয়েছে। সেখানে থাকা ও প্রশিক্ষণের জন্য ভবন নির্মাণ করা হলে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হুমকিতে পড়বে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবের হোসেন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারে রক্ষিত বনের ভেতর প্রশাসন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের একটি প্রস্তাবের কথা আমিও শুনেছি। রক্ষিত বনের ভেতরে এভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে পারে না। এমনিতেই দেশে দিন দিন বনের জমি কমে যাচ্ছে। যেসব জমি ইতিমধ্যে জবরদখল হয়েছে, আমরা সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছি। নতুন করে বনের কোনো জমি বেহাত হতে দেওয়া যাবে না।’

২৬৯০২২ একর জমি জবরদখল

এদিকে স্বাধীনতার পর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কত একর জমি জবরদখল হয়েছে, তার একটি হিসাব কষেছে বন বিভাগ। এতে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৬৯ হাজার ২২ একর জমি জবরদখল হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বনের জমি জবরদখল হয়েছে ঢাকা বা কেন্দ্রীয় অঞ্চলে, এক লাখ ৪০ হাজার ৫২ একর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জমি জবরদখল হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে, ৮৫ হাজার ৬৮১ একর। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বনের জমি জবরদখল হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৬ একর।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা মুসলমানরা কক্সবাজারে বনের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। এমনিতেই রোহিঙ্গাদের সামাল দিয়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের অবস্থা শোচনীয়। তার ওপর নতুন করে আরো ৭০০ একর জমি প্রশাসন ক্যাডারকে দীর্ঘ মেয়াদে বন্দোবস্ত দিলে বন বলতে কিছুই থাকবে না বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।


শেয়ার করুন