আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস আজ

নদী জীবন্ত সত্তা হলেও অভিভাবকহীনতা

ডেস্ক নিউজঃ

আজ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। যাকে আরেকভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। নদনদীর গুরুত্ব ও সংরক্ষণে কর্তব্য উপলব্ধি থেকেই ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে ১৪ মার্চ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সবুজ-শ্যামল সজল প্রকৃতি প্রাণের বৈচিত্র্য মানেই বাংলাদেশ। এই প্রাকৃতিক বৈচিত্রের প্রাণশক্তিই হলো দেশের ৭ হাজার নদ-নদী জলাভূমি। সেই সঙ্গে আমাদের এসব নদীর সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য। আজ সচেতনতা ও সংরক্ষণের অভাবে নদীর ধার ঘেঁষে গড়া প্রাচীন নগরীর ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে গেছি। নদীকে ঘিরে মাঝি-মাল্লা, জুগী, জেলেসহ অজস্র জনগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়েছে। ভরাট, দখল দূষণে অজস্র প্রাণীর বিতাড়ন ও বিলুপ্তিতে জীববৈচিত্র্যও আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে।

এই নদীই একটি জীবন্ত সত্তা। ২০১৯ সালে, ৩ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশের মহামান্য হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি)’ বলে আদেশ জারি করেছে। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। দখল দূষণ ভরাটের সাথে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে রয়েছে আইনি অধিকার। এর আগে বিশ্বব্যাপী এ ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়া থেকে ২০১৭ সালে। সোনা আর কয়লার খনির কারণে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশটির সাংবিধানিক আদালত ‘রিয়ো এট্রাটো’ নামক একটি নদীকে এ অধিকার দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে নদীটিকে রক্ষার জন্যই আদালত একে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে। নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকে খুবই পবিত্র মনে করে এবং সেটিকেও জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কারণ নদীটি খাওয়ার পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নদী একটি জীবন্ত সত্তা বটে। প্রকৃতিতে প্রাণের সৃষ্টি যে জলজ পরিবেশে তা অনেকেরই অজানা নয়। যেখানে পানি নেই, সেখানে প্রাণের সৃষ্টিও নেই। অজস্র অনুজীব, শ্যাওলা, শামুক-ঝিনুক, সাপ, ব্যাঙ, মাছসহ, আগাছা ছোট-বড় বৃক্ষ-লতাসহ সব প্রাণের সৃষ্টি, বিকাশ, বিবর্তন, বৃদ্ধি এবং বিস্তৃতি জলাধারের প্রতিবেশকে ঘিরে। বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, রাতচোরা, শিশুক উদবিড়ালসহ হাজারও প্রাণের সমাহার। আবার মাঝি-মাল্লার পরিবহন, পারাপার যোগাযোগ; জেলেদের মাছ ধরা; জুগিদের শামুক ঝিনুক হতে চুন তৈরি ঘিরে ঐতিহ্যবাহী পেশা; চাষিদের ফসল উৎপাদনসহ অসংখ্য জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষভাবে জীবন-জীবিকা এবং কৃষি-কৃষ্টি সাহিত্য-সংস্কৃতি সবই এই পরিমণ্ডলের দ্বারা প্রভাবিত ও প্রচলিত। আবার আবহাওয়া ও জলবায়ু বৃষ্টি বাদল খরা সবই, নদী-নালার পানিপ্রবাহ দ্বারাই হাজার হাজার বছর ধরে নিয়ন্ত্রিত। এককথায় জলজ প্রতিবেশ তথা নদী হলো এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ ও আমাদের জীবন সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ।

রাষ্ট্রের যে পরিবেশ অধিদপ্তরের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রয়েছে তারা গতবছর জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ও তালিকা প্রকাশে উদ্যোগ নেয়। গত ২০২৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছে। সেই প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে- নদীর সংখ্যা, সংজ্ঞা, দৈর্ঘ্য, উৎস-পতনের মুখ, নদীর দৈর্ঘ্যসহ সবকিছু নিয়ে বেশকিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অভিযোগ তুলেছে নদী গবেষকসহ বিভিন্ন মহল থেকে।

এর আগে ৯ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে দেশের সব নদ-নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল নদী রক্ষা কমিশন। ওই তালিকায় নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ৯০৭টি। তালিকার ওপর মতামত ও আপত্তি আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেয় কমিশন।

তড়িঘড়ি করে ভুলেভরা তালিকা প্রকাশের পর থেকে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। নদী ও প্রকৃতি গবেষক- মাহবুব সিদ্দিকী ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন- আমার অনুসন্ধান অনুযায়ী দেশে নদ-নদীর সংখ্যা আমরা ১ হাজার ৯০৮টি পেয়েছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলা আছে। এ জেলাগুলোর নদীর সংখ্যা নিয়ে এখনো সঠিকভাবে জরিপ হয়নি। এ তিন জেলার নদীর তালিকা পেলে নদ-নদীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এগুলোর সবই অস্তিত্ব বিদ্যমান।

এখন প্রশ্ন হলো- কেন এতো আপত্তি? কেনই বা এতো অসামঞ্জস্যতা? তালিকায় আমাদের সেই নদী অন্তর্ভুক্তিকরণে অভিযোগ করতে গিয়ে বেশকিছু অসঙ্গতি মনে হয়েছে। জেলা প্রশানের নির্দেশের প্রেক্ষিতে কালেক্টরেট অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসসহ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়সমূহ তথ্য যাচাইয়ে আমার সঙ্গে বিছিন্নভাবে ফোনে যোগাযোগ করে। তাতে মোটাদাগে যেটা মনে হয়েছে- জেলা উপজেলার সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের মধ্যে ছিল না কোন সমন্বয়। তাদের উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট অফিস সমূহসহ পরিবেশ প্রকৃতি নদী বিষয়ে গবেষণা, সচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, সংগঠন সমন্বয়ে একাধিক সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া। যা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিহিত করে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নে সহায়তা করা। কিন্তু অপরদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ৭ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা চিঠি ডাকে প্রেরণ করে হতে পৌঁছেছিল ১১ তারিখ আর ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখের মধ্যে তথ্য চাওয়া হয়েছে। ৭ দিনেরও কম বেঁধে দেয়া সময়ে তড়িঘড়ি করে উক্ত সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। ফলে অনেক ভুলভ্রান্তি ও অসংগতি রয়ে গেছে। এটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাদের তালিকায় ১ হাজার ৮টি নদ-নদীর তালিকা দেয়া আছে। তার মধ্যে ৫৮১টি নদীর উৎসমুখ-পতিতমুখ-মোহনার উল্লেখ নেই। আবার তালিকায় অনেক নদী অন্তর্ভুক্ত না করার অর্থ হলো- নদীকে অনাথ তথা অভিভাবকহীন করা। এতে দখল দূষণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হবে। এতো অসংগতির ফলে নদীর অভিভাবক হিসেবে উক্ত কমিশন যে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়োজিত, তার অবহেলাই প্রতিয়মান হয়। নদীর গুরুত্ব তাদের বোধের বাইরে কিনা প্রশ্ন এসে যায়।

পৃথিবীর ছয় প্রকারের ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণ বৈচিত্র্যময় বাস্তুসংস্থানতন্ত্র বলা হয় নদী বা মিঠা পানির উৎসকে। কৃষি ও পানীয় জলের নিশ্চয়তা এবং উর্বরা ভূমির কারণে পৃথিবীর আদি সভ্যতাগুলোও নদী তীরেই গড়ে ওঠে। কোনো নদীর টিকে থাকার ওপর নির্ভর করছে কোনো সভ্যতা জীববৈচিত্রের অস্তিত্ব। বছর ২৫-৩০ পূর্বেও নদী নালায় কতশত প্রকারের মাছ পাওয়া যেত। ছিল অজস্র অনুজীব, শ্যাওলা, শামুক-ঝিনুক, পাখপাখালি, সাপ, ব্যাঙসহ, তীর জুড়ে বৈচিত্র্যময় আগাছা, ছোট-বড় গাছগাছালি। আজ চোখ বন্ধ করে ভাবলেই দেখা যাবে গত দুই দশকেই অসংখ্য প্রজাতির মাছ, শামুক ঝিনুক, অনুজীব বিলুপ্ত হবে গেছে।

আন্তর্জাতিক এক বেসরকারী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত প্রজাতির মধ্যে উভচর প্রাণীরা সর্বোচ্চ (৪১%) হুমকির মুখে রয়েছে। এভাবে নদনদী দখল দূষণে অজস্র জীবন ও জীবীকা বিপন্ন, বিধ্বস্ত চলতে চলতে ভবিষ্যতে মানুষজাতিকেও একদিন বিলুপ্তির বিষাদে তলিয়ে যেতে হবে। তাই দেশের নদনদী যথাযথ তালিকা প্রণয়ন ও তা গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করে নদীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণ, উন্নয়নে জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকেই প্রকৃত দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করত হবে এবং সেই সাথে সচেতন ব্যক্তি, সমাজ, সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে।


শেয়ার করুন