চার মাস পর চেনা রূপে ফিরছে পর্যটনকেন্দ্র

সিটিএন ডেস্ক:

করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় পাঁচ মাস বন্ধের পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার খুলছে পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে শেষ মুহূর্তের ধোয়ামোছা এবং সাজসজ্জার কাজ চলছে। হোটেল-মোটেলে অগ্রিম বুকিং শুরু হয়েছে। অনেক এলাকায় দুদিন আগে পর্যটকদের আনাগোনাও শুরু হয়েছে।

পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত এপ্রিল থেকে বন্ধ পর্যটন ও হোটেল-মোটেল ব্যবসা। এতে কর্মীদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে। সরকারি নির্দেশে ধারণক্ষমতার অর্ধেক দর্শনার্থী নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র চালুর খবরে সবার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। দর্শনার্থীদের বরণে প্রস্তুত পর্যটনকেন্দ্রগুলো। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখে টানা দু-তিন মাস চললেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে মনে করছেন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা। নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত

দুদিন আগেই কক্সবাজার সৈকতে ভিড় : বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আগেভাগেই ভিড় করছেন স্থানীয় হাজারো পর্যটক। প্রশাসন সরিয়ে দিলেও নানা অজুহাতে তারা সৈকতে নেমে পড়ছেন। তাদের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অবশ্য, সৈকতে আসা দর্শনার্থীরা বলছেন, করোনায় ঘরবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে সৈকতে এসেছেন তারা। সরেজমিনে গত সোমবার সৈকতে কয়েকশ’ দর্শনার্থী দেখা যায়। তাদের কেউ ঘোড়ায় চড়ে, আবার কেউ গোসল করে সৈকত ভ্রমণ উপভোগ করছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক দম্পতি মো. সাহেদুল ও নীলিমা আকতার বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে মনে হয় না করোনা কোনো সমস্যা করবে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সৈকত উপভোগ করছি। আর কতদিন বাসায় একা সময় কাটাব?’ মিনহাজ আলম নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘সৈকতে আসা বেশিরভাগ পর্যটকদের মুখে মাস্ক নেই। সংশ্লিষ্টদের শক্ত হাতে এগুলো মোকাবিলা করতে হবে।’

কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ সড়ক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুখিম খান জানান, আগেভাগেই অনেক পর্যটক এসেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের হোটেলে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সি-ওয়েলকাম রিসোর্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বদরুল হাসান মিলকী জানান, অলস কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে প্রাণ সঞ্চার করেছে সরকারি ঘোষণা। বৃহস্পতিবার থেকে চিরচেনা রূপে ফিরবে সৈকত।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আবাসিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট মালিকদের বলেছি, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হব।’

পর্যটক বরণে প্রস্তুত রাঙ্গামাটি : পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেওয়ার ঘোষণায় আশায় বুক বাঁধছেন রাঙ্গামাটির ব্যবসায়ীরা। দর্শনার্থীদের বরণে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। শেষ মুহূর্তের সংস্কার কাজের পাশাপাশি হোটেল-মোটেল ধোয়ামোছার কাজ চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

পাহাড় ও হ্রদে ঘেরা মনোরম প্রকৃতির লীলাভূমি রাঙ্গামাটিতে সাজেক ভ্যালি, ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই লেক, পলওয়ে পার্ক, আরণ্যক, সুবলং ঝর্ণাসহ বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। হোটেল গ্রিন ক্যাসেলের ব্যবস্থাপক আহমেদ ইমতিয়াজ ও হোটেল মতি মহলের ব্যবস্থাপক চন্দন কুমার জানান, হোটেল ব্যবসা পরিচালনায় শতভাগ প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।

রাঙ্গামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া জানান, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে পর্যটক আসবে। তাদের সেবায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

কমলগঞ্জে প্রস্তুত হোটেল-মোটেল : পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মৌলভীবাজারের পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি বিরাজ করছে। জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের হোটেল-মোটেল কর্মীদের মধ্যে প্রাণ ফিরে এসেছে।

বন্ধের মধ্যে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেকে জেগেছে প্রকৃতির ছোঁয়া। লাউয়াছড়া বনের গাছে গাছে রাজত্ব করছে বানরের দল। লাউয়াছড়ার ভেতর কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের আশপাশে দেখা মিলছে মায়াহরিণ ও বানরের। হোটেল প্যারাডাইজের মালিক আবুজার বাবলা জানান, আগামী দুই মাস পর্যটনকেন্দ্র খোলা থাকলে বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন তারা।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক জানান, যেসব হোটেল-রিসোর্ট সরকারি নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চেনা রূপে ফিরছে বান্দরবান : চার মাস ধরে সুনসান নীরবতা বান্দরবান পার্বত্য জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। সরকারি ঘোষণায় ভাঙতে চলেছে নীরবতা। জেলার নীলাচল, নীলগিরি, শৈলপ্রপাত, চিম্বুকসহ পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র ফিরছে স্বরূপে। সবুজ পাহাড় আর আকাশের মিতালি, মেঘ-বৃষ্টির খেলা, পাহাড়ের বুক বেয়ে পড়া ঝর্ণার সৌন্দর্য ফের উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা।

আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, বান্দরবান সদরে ৬০টির মতো হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। পর্যটন বন্ধ থাকায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্ষতি পোষাতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন বলে জানান তিনি।

গতকাল চিম্বুক সড়কে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে মোটরসাইকেল ও গাড়িতে এসে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। শৈলপ্রপাত ঝর্ণার পানিতে গা ভেজাচ্ছেন, অনেকে সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমে বন্দি করছেন।

শ্রীমঙ্গলে প্রাণসঞ্চার : শ্রীমঙ্গলে করোনায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৭০টির বেশি হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজের প্রায় ৩০ হাজার কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পর্যটন খোলার সিদ্ধান্তে তারা ছাড়াও পর্যটনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মকর্তাদের মধ্যে খুশির আমেজ বিরাজ করছে।

বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা।

ট্যুরিস্ট গাইড আহাদ জানান, ইকো-ট্যুরিস্ট গাইডরা আনন্দিত। তবে বিদেশিরা আসার সুযোগ না পেলে তাদের ভাগ্যে আলো ফিরবে না বলে জানান তিনি।

পর্যটকের অপেক্ষায় কুয়াকাটা : প্রায় পাঁচ মাসের অচলাবস্থা কাটিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে পর্যটক বরণে প্রস্তুতি নিয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। নতুন রূপে সাজানো হয়েছে হোটেল-মোটেল-কটেজসহ বিপণিবিতান ও দর্শনীয় স্থান। কাজ না থাকায় বাড়ি যাওয়া কর্মচারীরাও ফিরে এসেছেন। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কর্মচারীদের নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন ও মালিকপক্ষ।

কুয়াকাটা ট্যুরস অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রুমান ইতিয়াজ তুষার বলেন, ‘দুদফা লকডাউনে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু এখন তাদের যোগদান অনিশ্চিত। লোকসানের বোঝা কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে।’

কুয়কাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোশিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোতালেব শরীফ বলেন, ‘লকডাউনে কুয়াকাটার পর্যটন খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো প্রণোদনা মেলেনি। এখন সহায়তা না দিলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।’

সিলেটে আশার আলো : প্রকৃতিকন্যা সিলেটের জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, লালাখাল, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর, মাধবকু-, সারি সারি চা বাগান সারা বছর পর্যটকে মুখরিত থাকে। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস এ চিত্র নেই। এখন ফের পর্যটন খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আশার আলো দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

সিলেট হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমাত নবী চৌধুরী জুয়েল জানান, পর্যটনকেন্দ্র ও হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ খুলে দেওয়ায় এ খাতের সংশ্লিষ্টরা আশায় বুক বাঁধছেন। পর্যটন খাত স্বাভাবিক হলে কোনোমতে টিকে থাকার একটি পথ পাওয়া যাবে।

এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও আবাসিক হোটেল নির্ভানা ইনের কর্ণধার তাহমিন আহমেদ জানান, সবকিছু খোলার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা মেনে সবাইকে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কড়া নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সরকারি সিদ্ধান্তে গত এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছাড়াও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় রাইডস ও যন্ত্রগুলো নষ্ট হতে বসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১২ আগস্ট সরকার স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। করোনার প্রথম ধাপে এক বছরের বেশি পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় এ খাতের বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়ে।


শেয়ার করুন