পানামার প্রেসিডেন্ট ওমর তোরিজো ও সাহিত্যিক গ্রাহামগ্রীন

ঘাতক কর্পোরেটোক্রেসি

MONIR eমনির ইউসুফ :

“ওমরের আদর্শ হচ্ছে স্বাধীনতা। কোন মিসাইল এ আদর্শকে হত্যা করতে পারবে না” । ( ওমর তোরিজো)

“উত্তরের দানবের সঙ্গে টক্কর দেওয়া খুবই কঠিন,তবু ওমরের আদর্শের জয় হবে” । ( গ্রাহামগ্রীন)

উপরের উদ্ধৃতি দুটি এমন দু’জন মহান ব্যক্তির যারা দ’ুজনই নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য একযুগে কাজ করেছিলেন। একজন সরাসরি অস্ত্র ও নিজের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। অন্যজন সেই অঞ্চলসমূহের জনগণের মুখের ভাষাকে সম্বল করে। পানামার সাবেক দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট ওমর তোরিজো যিনি পরক্রমাশালী আমিরিকার বিরুদ্ধে মাত্র ২০ লাখ লোকসংখ্যা নিয়ে একাই যুদ্ধ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঘাতক কর্পোরেটোক্রেসির হাতে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, আমিরিকার তৈরি সাম্রাজ্যবাদের এই নতুন পলিসি কত যে ভয়ঙ্কর হতে পারে সে ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। ইকুয়েডর, এল সালভেদর, ইন্দোনেশিয়া, পানামা, সৌদিআরব, ইরান, ইরাক লিবিয়া ,কলম্বিয়া,কুয়েত, সিরিয়া, ফিলিস্থিন এইসব দেশের জনগণ বুঝতেই পারে নি তারা কি নির্মম নৃশংস ও নব্যঘাতকের শিকার হয়েছেন। তাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, লোক সম্পদ গ্রাস করার জন্য আমিরিকা এমন কোন সূত্র নেই ব্যবহার করে নি। আমিরিকার সঙ্গে যেসব দেশের সরকার কাজ করে নি তাদের পরিণতি হয়েছিল খুবই করুণ। সে করুণ হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার পানামার দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট তোরিজো। আমিরিকার তৈরি ঘাাতক শৃগাল বাহিনির হাতে বিমান দুর্ঘটনায অত্যন্ত করুণভাবে মৃত্যু হয়েছিল তোরিজোর। আমিরিকা অত্যন্ত কৌশলে তোরিজোকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাঁর আদর্শকে কোন ভাবে হত্যা করতে পারে নি। পানামা জেগে উঠেছিল, তাঁর সঙ্গে জেগে উঠেছিল ল্যাথিন আমিরিকার সমগ্র অঞ্চল। তোরিজো হয়ে উঠেছিল ল্যাতিন আমিরিকার জনগণের একমাত্র লোকনায়ক। কর্পোরেটোক্রেসি বুঝতে হলে আগে আমিরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন ধারাকে বুঝতে হবে। কর্পোরেটোক্রেসি আসলে কি, এই নতুন শব্দবন্ধটি আমিরিকা কিভাবে উদ্ভাবন করল। ইহা কোথায় এবং কি জন্য ব্যবহার করা হয়। কর্পোরেটোক্রসি হল আমিরিকার এমন এক নিরবঅস্ত্র যা পরমাণু বোমার চেয়েও ভয়াবহ। যে কোনো দেশে যে কোনো সময়ে জাতীয় উন্নয়নের নামে এই অস্ত্র প্রয়োগ ও ব্যবহার করে তছনছ করে ফেলে হয় সম্ভাবনাময় পৃথিবীর সব অঞ্চল। এক কথায় কর্পোরেটোক্রেসি হল বিশ্ব সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আমিরিকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও সরকার, রাজনৈতিক ও আর্থিক শক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদ মাধ্যম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যা সম্মিলিত ভাবে আমিরিকার স্বার্থকে রক্ষা করে। এর আবার বিভিন্ন ধরন আছে,আছে বিভিন্ন শাখা। বিশেষ করে এর অর্থনেতিক ঘাতক ও শৃগাল বাহিনি পৃথিবীতে নেই এমন কোনো হীন ও ঘৃণ্য কাজ করতে পারে না। প্রয়োজনে তারা যে কোন দেশের যেকোন গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করবে,আবার নিজেদের স্বপক্ষে কাজ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অর্থয়ও সম্মানে ভরিয়ে দেবে। তারা সরকারের মান্যবরদেরকে জাতীয় উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকার টোপ দেয়। সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর, ব্রীজ, কালভার্টসহ অবকাটামো নির্মাণের জন্য সরকারকে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক , সরকার থেকে লোন পায়ে দেয়ার কাজ করে। ‘কর্পোরেটোক্রেসিভুক্ত লোকেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ধাপ্পা দিয়ে লক্ষকোটি ডলার চুরি করে। আর্ন্তজাতিক সাহায্যদানকারি সংস্থার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তহবিলে পৌঁছে দেয়। এভাবে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারি গুটিকয়েক পরিবার প্রতিনিয়ত লাভাবান হয়। একাজে অর্থনৈতিক ঘাতকদের মূল অস্ত্র হচ্ছে ভুল তথ্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিবেদন, পাাতানো নির্বাচন,ঘুষ, চাপ প্রয়োগ, যৌণতা ও হত্যা। তাদের কর্মকাণ্ড সাম্রাজ্যের ইতিহাসের মতই প্রাচীন। বিশ্বায়নের এযুগে এসব কর্মকাণ্ড আরো নতুন ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে’। তখন কর্পোরেটোক্রেসির পূর্ণ যৌবন। এইতত্ত্ব বিভিন্ন্ দেশে পরীক্ষামুলকভাবে প্রয়োগ করে সফল হয়েছে আমেরিকা। এরা এমনভাবে জাল বিস্তার করছেন এই সামান্য গ্রহে নিরীহ দেশ প্রেমিকদের বেঁচে থাকা ও মর্ত্যে কোথাও এক ইঞ্চি জায়গায় ঠাঁই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। তোরিজোর সামনেও এর ভুরি-ভুরি উদাহরণ ছিল্, তাঁর সামনে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্টের মৃতু,্য ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়ার প্রাকৃতিক ও জ্বালানি সম্পদ লুট, আমাজনের পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের নির্মূল, নিজ দেশের পানামা যোজক প্রণালী আমিরিকা জোর করে দখল ইত্যাদি। পানামা যোজক প্রণালীর তীরে পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল শহর তৈরি করে নিয়েছে আমেরিকা। অবকাশ যাপন ও আমিরিকান জনগণেরে বিনোদনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, এক কথায় পানামাকে বানানো হয়েছে বিশ্বের স্মার্ট ও আধুনিক পতিতালয়।। নির্যাতিত দেশের ষোড়শী ও সুন্দরী মেয়েদের কৌশলে নিয়ে আসা হয় এইখানে, বেশ্যা হিসেবে এরা নাইট ক্লাব গুলোতে নাচে, মদ পান করে, আর শেতাঙ্গদের যৌণ সঙ্গী হতে বাধ্য হয়্। বিনিময়ে যা পায় তা দিয়ে বেঁচে থাকে। এবং বেঁচে থাকার অভিনয় করে। কর্পোরেটোক্রেসির এই ভয়াবহ রূপ সমন্ধে জানতেন তোরিজো, তারপরও মেরুদণ্ডসোজা করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমিরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদি শক্তির বহুমুখী ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে একাই পুরো ল্যাথিন আমিরিকাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি। ওমর তোরিজো পানামা যোজকপ্রণালী নিয়ে যখন নিজস্ব পরিকল্পনা আঁকছিলেন, পরাক্রমশালী আমিরিকাকে বুদ্ধির জালে ধরাশায়ী করে আমিরিকা থেকে পানামা যোজকপ্রণালী ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে তোরিজোই একমাত্র প্রেসিডেন্ট বিশ্বের অন্যান্য দেশকে যে কর্পোরেটোক্রেসি কুপোকাত করে ফেলেছিল সে কর্পোরেটোক্রেসিকে নিজ দেশের উন্নয়নের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। ওমর জানতেন চলমান এ যুদ্ধে যে কোনদিন যে কোন সময় তাকে হত্যা করা হতে পারে। সে সময়ের আমিরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে পানামা যোজকপ্রণালী পানামাকে ফেরত দেওয়ার চুক্তি করাতে রাজী করিয়েছিলেন, এ চুক্তিই কাল হয়েছিল তোরিজোর জন্য। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আমিরিকান বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো। তোরিজোকে যে কোনো মূল্যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে তারা, তাতে সফলও হয়। তোরিজোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল সাহিত্যিক গ্রাহামগ্রীন এর। একজন উদারমনা মানবকল্যাণকামী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তোরিজোকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন গ্রীন। তোরিজোর জীবন নিয়ে ব্যাপক শংকায় ছিলেন তিনি। বলতেন-“উত্তরের দানবের সঙ্গে টক্কর দেওয়া খুবই কঠিন।” তবুও তিনি আশাবাদী ছিলেন তোরিজোর মত নেতাদের হাতেই পানামার মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের মুক্তি সম্ভব। ঘটেছিলও তাই, একজন দৃঢ়চেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে পানামার সার্বভৌমত্বের প্রতীক পানামা যোজক প্রণালী তিনি উদ্ধার করেছিলেন, পানামার প্রাকৃতিক সন্তান হত দরিদ্র জনগণের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। পানামার প্রেক্ষাপটে ল্যাথিন আমিরিকার উত্তরের দানব আমিরিকা তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষুধাকে নিবৃত করতে পারে নি। তাঁর ক্ষুধা এতই বেড়ে গিয়েছিল, যেকোনা মূল্যে তাঁর কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে, এতে কে মরল ,কে বাঁচল কোন দেশ ধ্বংস হল, কোন দেশের প্রেসিডেন্ট এর মৃত্যু হল, তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তাঁর চায় সম্পদ আরও সম্পদ এবং সুগঠিত নিয়ন্ত্রণ। আমিরিকা ছাড়া বাকী বিশ্বের জনগণকে না খেয়ে মেরে ফেলাই কর্পোরেটোক্রেসির আরেক পলিসি। সে লক্ষে আমিকিার তাঁর শৃগাল বাহিনিকে লেলিয়ে দেয় তোরিজোকে যে কোনো মূল্যে হত্যা করার জন্য। আমিরিকার সুপ্রশিক্ষিত ঘাতক শৃগাল বাহিনি বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তোরিজোকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পৃথিবী জানলো বিমান দুর্ঘটনায় পানামার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট তোরিজোর মৃত্যু হয়েছে। আসলে এই হত্যা যে আমিরিকার কর্পোরেটোক্রেসির শৃগাল বাহিনির নিয়মিত ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড সে গোপন বিষয় গোপনই থেকে গেল। তোরিজোর মৃত্যুর পর গ্রাহামগ্রীন লিখলেন তোরিজোর জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘জেনারেলের সঙ্গে পরিচয়’। আমাদের সামনে ভেসে উঠলো একজন মানবদরদী, বুদ্ধিদ্বীপ্ত, প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের প্রতিকৃতি।

তোরিজোর চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে সে সময়ের নায়কে পরিণিত করেছিল। কিন্তু বাকী বিশ্বের কাছে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তোরিজোর নাম অপরিচিতই থেকে গেল। তোরিজোর একক সংগ্রামের সাহসী কথা মানুষ জানতেই পারল না। কি নির্মম বাস্তবতা। কর্পোরেটোক্রেসিরই এক অর্থনৈতিক ঘাতক জন পার্কিন্স এবং সাহিত্যিক গ্রাহামগ্রীন না হলে এই দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী লোকনায়কের কথা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যেতো। আর জন পার্কিন্স না হলে আমরা জানতেও পারতাম না আমিরিকার গোপন এই কার্যকলাপের এমন ভয়ঙ্কর চিত্র,মানব ইতিহাসের এমন ভয়ঙ্কর ও জগন্যতম নগ্ন অভিপ্রায়। তোরিজো সব সময় বলতেন ওমরের আদর্শ হচ্ছে স্বাধীনতা, কোন মিসাইল এ আদর্শকে হত্যা করতে পারবে না। তাঁর মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আমিরিকা কর্পোরেটোক্রেসিকে আরও সুক্ষ, আরও মসৃন করে তুলে। তছনছ করে ফেলে মানুষের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয় আরও নতুন কৌশলে। কিন্তু কোন দেশের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারে না। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে তার থাবা ছড়িয়ে দিতে পারে আমিরিক্।া মানুষ জাগবেই,সাম্রাজ্যই জেনে শুনে পান করেছে এ বিষ, এ বিষের যন্ত্রণায় তাঁর মৃত্যু হবেই। কিন্তু তার আগে পৃথিবীর মানুষকে সচেতন হতে হবে । পৃথিবীর আগের সাম্রাজ্যগুলো মানুষের এ রকম অপরুণীয় ক্ষতি করে নি আমিরিকা একাই যে পরিমাণ পৃথিবীর ক্ষতি করেছে। আমিরিকা যেখানে তাঁর থাবা ছড়িয়েছে সেখানেই মানুষ হত্যা, প্রকৃতি ধ্বংস, পরিবেশের উপর ক্ষতিকর অস্ত্রপ্রয়োগ করেছে। গ্রাহামগ্রীন ও তোরিজো এ যুদ্ধের অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছে। মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে আমিরিকার সচেতন এ কার্যকালাপের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হব্।ে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে হবে । তা না হলে মানব জাতির এই পর্যায়ের ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।


শেয়ার করুন