গাঁও-গ্রামে সাংবাদিকতা মানে

Muktomot-1
স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় ঈদ করে অনেক দিন পর গ্রামে এসেছি। একেবারে অজপাড়া গ্রাম বলা যাবে না। সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানা সদর লাগোয়া বাসুদেবকোল গ্রাম। সলঙ্গা অনার্স কলেজ, হাই স্কুল বৃটিশ আমলের সেই ডাকবাংলো, মহিলা কলেজ, মহিলা মাদরাসা আরও নানা প্রতিষ্ঠানসহ সলঙ্গা বাজারের বৃহদাংশ আমাদের গ্রামের (মৌজা) মধ্যে। পাশের গ্রাম থেকে আমার এক নানী (চাচার শাশুড়ি) বাড়িতে আসলেন কোনো এক সকালে। এসেই আমাদের খোঁজ-খবর নিলেন। কিন্তু মনটা তার খারাপ হয়ে গেল আমার সাংবাদিকতা পেশাটা নিয়ে। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি আমাকে বললেন, তোর নানাকে আমি অনেক চেষ্টা করে ওই পথ থেকে সরিয়ে এনেছি। খুব খারাপ একটা পেশা। মানুষ খুব খারাপ চোখে দেখে। এলাকার আরও দুই-চারজন সাংবাদিকের উদাহরণ দিলেন তিনি। স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতার সাংবাদিকতা পেশার নামে নানা কু-কীর্তিরও কয়েকটি উদাহরণ টানলেন তিনি। বললেন, সে (ওই সাংবাদিক) সারাদিন হাতে ক্যামেরা নিয়ে মোটরসাইকেলে করে থানার এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়ায়। বাল্যবিবাহ ঠেকায়, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, গ্রামের শালিশ-বৈঠক, মামলা-মোকাদ্দমা হলে ছুটে যায়। বিনিময়ে দুই-চার শ’ টাকা দিনশেষে বাড়ি নিয়ে ফেরে। শুধু কী তাই? থানায়ও যায়— পুলিশের কাছে ভাগ নেয়। এটা কোনো পেশা হল? তোর নানা অবশ্য এ সব করত না। কোথায় কোনো দুর্ঘটনা হলে সে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যেত। ছবি তুলতো। এরপর রিপোর্ট লিখত। তাতে কী; মানুষ খারাপ বলতো বলে তারে ওই পথ থেকে সরিয়ে এনেছি। বাজারে সে এখন দোকান দিয়েছে।
আমার আব্বা-মা ও পরিবারের আরও লোকজনের সামনেই নানী এভাবে সাংবাদিকতা পেশার পোস্টমর্টেম করলেন। তার কথা শুনে তেমন কিছু বলারই রইল না আমার। কারণ, তার চোখে সাংবাদিকতা মানে ‘চোরামি-ছেঁচড়ামি’। তিনিও তো সাবেক কোনো এক ‘মস্ত’ সাংবাদিকের বউ। নিজের চোখের সামনে তার স্বামীর ও অন্যদের বেহিসাবি, বেইনসাফি চলাফেরা ও আচরণ দেখেছেন। তিনি আমাকেও পরামর্শ দিলেন ‘তুই ওটা (সাংবাদিকতা) ছেড়ে দে। যেখানে (যে পরিবারে) বিয়ে করেছিস, সরকারি না হলে তো কমপক্ষে বেসরকারি ভাল চাকরি হবে। তাই-ই কর।’ আমি তার কথাগুলো শুধু শুনলামই। তার অভিযোগ ও মন খারাপের বিষয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি যুক্তি দিয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনাকে বুঝানো সাধ্য আমার হল না। কারণ, উনি সাবেক মফস্বল সাংবাদিকের (!) স্ত্রী।
আমার ওই নানা জানা মতে অষ্টম শ্রেণী পাস। তিনি আগে থেকেই কাজকর্ম করতেন না। ঘুরেফিরে চলতেন। তারই এক আত্মীয় ছিলেন বগুড়া থেকে প্রকাশিত এক দৈনিকের থানা প্রতিনিধি। ওই সাংবাদিক আত্মীয়ের মাধ্যমেই আমার নানা মহান সাংবাদিকতা পেশায় (!) যুক্ত হন। যদিও তিনি বছর তিন চারেকের মধ্যে এ পেশা (!) ছাড়েন।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে গেছি পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওই গ্রামে ঢোকার সময়ই রাস্তায় এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা। ভালমন্দ জিজ্ঞেসের এক পর্যায়ে সাংবাদিকতা পেশার নাম শুনেই মনটা যেন একটু ছোটই করলেন। আমাকে বললেন, আর কী কী কর। বললাম, আর তো কিছুই করার সুযোগ (সময়) হয় না। তিনি তখন বললেন, এভাবে চলে তোমার? তার এ প্রশ্নে বিব্রত হলাম। কিন্তু শিক্ষক মানুষ। রাগ তো আর করা যায় না। উনাকে অল্প সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। মফস্বল সাংবাদিকতা আর ঢাকায় সাংবাদিকতা এক নয়। কিংবা মফস্বলে যারা সাংবাদিকতা করে সবাই এক সমান নন। ঢাকায় যারা সাংবাদিকতা করেন তারা নির্ধারিত হারে বেতন পান। দেশের ভাল পত্রিকা, টিভি ও অনলাইন পত্রিকাগুলো ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন-ভাতা দেন। এ বেতন-ভাতা সরকারি যারা ভাল চাকরি করে তাদের চেয়ে কম নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশিই বটে। কিন্তু আমার ওই শিক্ষক পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন কিনা জানা নেই। ‘ও তাই নাকি’ এটুকু বলেই চলে গেলেন তিনি।
মফস্বল সাংবাদিকতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, (সবাই নন) এটাকে পেশা হিসেবে দেখতে চান না সাধারণ মানুষ। মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, সাংবাদিকতা কোনো পেশা নয়। এটা এক ধরনের চোরামি-ছেঁচড়ামি ছাড়া কিছু নয়। এক ধরনের মাস্তানীও বলা যেতে পারে। প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মফস্বল সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক, পেশাদারিত্ব থাকা না থাকা, সততা, অসততাসহ এ বিভেদ নানা কারণে। দেশের অধিকাংশ জেলা-উপজেলা বা থানা পর্যায়ে সাংবাদিকরা প্রেস ক্লাব একাধিক করে। যে যার যার মতো করে প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব-ইউনিটি গড়ে তুলছেন। যদিও মফস্বলের এখনো অনেকেই আছেন, যারা বস্তনিষ্ঠ, সৎ সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন। এ সব ভাল ও সৃজনশীল সাংবাদিকদের চারপাশে অসংখ্য ধান্দাবাজের আবির্ভাব ঘটছে। সাংবাদিকতার মতো জনহিতকর উচ্চমানের পেশার ওপর কালিমা লেপন হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক


শেয়ার করুন