কোরবাণীর ইতিহাস ও ফজিলত

DSC_3492 (1)এম বজলুর রহমান :

কোরবাণ শব্দটি কুরআন শব্দের সাথে এক ওজন ও সাদৃশ্যমান। তার অর্থ আসলে এই অর্থে ব্যবহার হয় যে, যাকে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য উৎসর্গ ও মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত করা হয়, বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘উৎসর্গ’ চায় সে কোরবাণী কোন জন্তু কে জবেহ করে অথবা সদকা খয়রাতের মাধ্যমে। কিন্তু হযরত আবু বকর জাচ্ছাস (রঃ) এর চেয়েও অধিকতর সুন্দর অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- যে সমস্ত সৎকার্য সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়, তাকে কোরবাণ বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের পরিভাষায় কোন বস্তুকে জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর উদ্দেশ্য সপে দেয়ায় হচ্ছে কোরবাণ।
কোরবাণীর সূচনা:
ইতিহাস ও জীবনীমূলক কিতাবাদি থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে এমন কোন জাতি ছিল না যারা স্বীয় মাযহাব অনুসারে কোরবাণী করেনি। কোরবাণীর এ ধারা হযরত আদম (আঃ) এর সন্তান হাবিল কাবিলের মাঝে তাদের বোন আকলিমার বিবাহ নিয়ে দন্দ্ব দেখা দিলে হযরত আদম (আঃ) তাদেরকে এখলাসের সহিত কোরবাণী করার নির্দেশ দিয়ে বলেন- তোমাদের মধ্যে যার কোরবাণী কবুল হবে তার সঙ্গেই এ মেয়েকে বিবাহ দেওয়া হবে। তখনকার যুগে কোরবাণী কবুল হওয়ার আলামত ছিল, যে কোরবাণীটি কবুল হতো তাকে আসমান থেকে আগুনের মতো একটি অদৃশ্য বস্তু এসে নিয়ে যেতো। অতঃপর হাবিল ও কাবিল আদম (আঃ) এর নির্দেশে কোরবাণী করলো। তবে হাবিল পশু পালনের কাজ করতো সে তার পশুগুলো থেকে বেছে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর একটি ভেঁড়া আল্লাহর রাস্তায় কোরবাণী করলো, আর কাবিল অন্যায়ভাবে বিবাহ করতে চায় ও শরীয়ত বিরোধী কাজ করতে চায়। সে কৃষি কাজ করতো সে তার কৃষি পণ্য থেকে কোরবাণী দিলো এবং সেগুলোকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসা হলো অতঃপর হঠাৎ করে আসমান থেকে একটি অগ্নি প্রবাহ এসে হাবিলের জন্তুকে জ্বালিয়ে দিলো অর্থাৎ তার কোরবাণী আল্লাহ কবুল করে নিলো। কিন্তু কাবিলে কোরবাণী আল্লাহ কবুল করলেন না। সে ঘটনাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন করীমে এরশাদ করেন- হে হাবিব (স:) আপনি তাদেরকে পাঠ করে শুনিয়ে দিন আদমের পুত্রদ্বয়ের ঘটনাকে যথার্থরূপে, যখন তারা উভয়ে নৈকট্য লাভের জন্য কোরবাণী দিয়েছিল। (সূরা মায়েদাহ্, আয়াত ২৮)। অন্য একটি আয়াতে বলেন- আল্লাহ মুত্তাকীনদের কোরবাণী ছাড়া কবুল করে না।
কোরবাণীর ফযিলত:
কুরআন হাদিস ও ইতিহাস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই কোরবাণীর আমল আদম (আঃ) হতে শুরু করে সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের শরীয়তে ছিল বিশেষ করে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্মৃতি স্মরণে দ্বীনে মুহাম্মদীতেও কোরবাণী একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যা স্বয়ং রাসূল (স:) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তবে তাবেয়ীন এর যুগ হতে এ আমল আজও পর্যন্ত চলে আসছে, তাই এই কোরবাণী ইসলামের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। পবিত্র কুরআনে সূরা কাওসারে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় হাবিব (স:) কে হুকুম করেছেন- নিশ্চয়ই আমি আপনাকে হাউজে কাউছার দান করেছি। অতএব আপনার পালন কর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ ও কুরবাণী আদায় করুন। আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন- হে আমার হাবিব আপনি বলুন যে, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কুরবাণী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই মহান প্রতীপালকের জন্য।

এই জন্য ফুকাহায়ে কেরামগণ লিখেছেন যে, কুরবাণীর জন্য মৌখিক নিয়ত শর্ত নয়, বরং অন্তরের খুলুছিয়্যাত জরুরি। কেননা গোশত ও রক্তের প্রবাহ আল্লাহর নিকট পৌঁছে না বরং শুধু অন্তরের খালেছ নিয়ত ও আনুগত্যের আবেগ ও জযবা পৌঁছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন- নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট গোশত ও রক্তের কোন অংশ পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের আনুগত্যের জযবা। তাই সর্বপ্রথম আমাদেরকে নিয়ত খালেছ করা আবশ্যক। অন্য আয়াতে বলেন- যাতে তারা কতক নির্দিষ্ট দিনে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (স:) বলেছেন- কোনো আদম সন্তান কোরবাণীর দিন জন্তু কোরবাণীর চায়তে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আর কোনো আমল নাই। কেয়ামতের দিন জবেহ করা পশুকে তার শিং ও খুরসহ হাজির করা হবে। কোরবাণীর জন্তুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা খোলা মনে এবং সন্তুষ্টি চিত্তে কোরবাণি করো। (মেশকাত: খ: ১: ১২৮)। হুজুর (স:) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি সচ্ছল ও কোরবাণী করতে সক্ষম, অথচ কোরবাণী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়। (বাইহাকী শরীফ) হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (স:) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন কোরবাণীর পশুর চোখ ও কান ভালো রূপে দেখিয়ে লই এবং কানের সামনের দিকে কাটা অথবা পিছনের কাটা জন্তু দিয়ে এবং কানের ভিতর লম্বা কাটা এবং কানের ভিতর গোল ছিদ্র বিশিষ্ট জন্তু দিয়ে কোরবাণী না করি। কেননা এ ধরনের কান কাটা জন্তু দ্বারা তাদের বিভিন্ন দেব দেবী ও মূর্তির নামে মান্নত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে কানের মধ্যখানে গোল ছিদ্র বিশিষ্ট পশু বা অল্প কিছু কান কাটা জন্তু দিয়ে কোরবাণী করতে কোন অসুবিধা নেই। যদি কানের দুই তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। কেননা বর্তমান কোনো রোগের কারণে বা কোনো দূর্ঘটনায় এ রকম কান কাটা হতে পারে। এতে কোন দেব দেবী ও পীরের নামে এ ধরনের মান্নত করা হয় না। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত রাসূল (স:) দশ বৎসর মদিনাতে অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছর কোরবাণী করেছেন। (মেশকাত: পৃ: ১২৯)

লেখক: এম বজলুর রহমান, ঈদগাঁও।
ইসলামাবাদ, সদর, কক্সবাজার।


শেয়ার করুন